সম্প্রতি ইসরাইলের দাবানল নেভানোর জন্য তুরস্কের জল-বিমান পাঠানোর খবরে অনেকেই এরদুগানের সমালোচনায় উঠেপড়ে লেগেছেন। স্থূল ও বালখিল্য সমালোচনাগুলো কোন বিবেকবান মানুষ কিছুতেই গ্রহণ করতে পারে না। এরদুগানের মতো সাহসী ও চৌকশ ব্যক্তি কাজটি সঠিকই করেছেন বলে মনে করি। কারণ ছয় বছরের সম্পর্কোচ্ছেদের পর কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন চুক্তি করেছে তুরস্ক ও ইসরাইল। সেই চুক্তির কারণে ইসরাইলকে জল-বিমান পাঠিয়ে সহযোগিতা করাটা স্বাভাবিক। রাসূল সা. মদিনায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ইয়াহুদীদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। এতে সকলকে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। অমুসলিমদের যার যার ধর্ম পালন ও আপন সহায়-সম্পত্তি রক্ষার অধিকার স্বীকার করা হয়। তাদের যাবতীয় মৌলিক অধিকার এবং যার যার দায়িত্ব ও কর্তব্যের রূপ ও সীমারেখা চিহ্নিত করা হয়। এই রাজনৈতিক দলীলের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য (যাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম সুসংঘবদ্ধ লিখিত সংবিধান বলা যেতে পারে যা অধ্যাবধি পূর্ণাঙ্গরূপে বিদ্যমান) এবং এই গভীর রাজনৈতিক, সংস্কৃতিক ও সামরিক বিষয়সমূহ রাসুল সা. এর প্রজ্ঞা ও ঐশী দিক-নির্দেশনা এবং অবস্থার পর্যালোচনার জন্য দেখুন ড. হামীদুল্লাহ, সাবেক অধ্যাপক আন্তর্জাতিক আইন, উছমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দারাবাদ-এর নিবন্ধ, যার আরবী তরজমা বর্তমান গ্রন্থকার [সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী] কর্তৃক مجموعة مباحث علمية দাইরাতুল মা’আরিফ আল-উছমানিয়া, হায়দারাবাদ থেকে ১৩৫৫ হি.তে প্রকাশিত হয়েছিল। [সূত্র: নবীয়ে রহমত,সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, অনুবাদ- আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী; প্রকাশনায়: মজলিস নাশরিয়াত-ই ইসলাম, জুলাই ১৯৯৭, পৃ. ২১১]
এবার চুক্তির খবরটি একটু পড়ে দেখুন-
সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ইসরাইল ও তুরস্ক একটি চুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ছয় বছর আগে গাজা অভিমুখী একটি ত্রাণবাহী জাহাজে ইসরাইলের অভিযানে ১০ তুর্কী ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছিল। এর পরেই তাদের মাঝে সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
আন্তর্জাতিক নৌ-সীমানায় অবৈধভাবে প্রবেশের অভিযোগে ত্রাণবাহী জাহাজটিতে হামলা চালানো হয় বলে ইসরাইলের দাবি। তখন এ নিয়ে তুরস্কের তরফ থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। দুদেশের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয়। ইসরাইলের এমন আচরণে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছিল তখন।
সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশই এ সম্পর্কের টানাপড়েন দূর করতে উদ্যোগী হয়। মূলত সম্পর্কের এই অধঃপতনের কারণে ইসরাইলকেই স্বার্থের দিক থেকে বেশি খেসারত দিতে হচ্ছে। কেননা তুরস্ক হচ্ছে ইসরাইলের জন্য একটা সম্ভাবনাময় গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ। এখানে গ্যাস রপ্তানি করতে পারলে তাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হবে। তবে এক্ষেত্রে দুদেশকে সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ন্যাটো সদস্য দেশ তুরস্ক এ অঞ্চলে তার স্বার্থ রক্ষা করতেও এটা করছে। গত রবিবার [২৬ জুন] রোমে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ফেরিদাম সিনিরলিউগলু এবং ইসরাইলের পক্ষ থেকে জোসেফ সিচানোভের এ নিয়ে আলোচনায় মিলিত হন।
তুরস্কের ডেইলি হুরিয়াতেও এই দুদেশের পুনর্মিলন চুক্তির বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চুক্তিতে বলা হয়েছে ২০১০ সালে গাজা অভিমুখী ফ্লেটিলা জাহাজে ইসরাইলের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ক্ষমা চাইবে ইসরাইল। সেই সাথে তুরস্কের যে সব ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছে তাদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসরাইলের এক কর্মকর্তা বলেন, চুক্তির বিষয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে আছে। দুই একদিনের মধ্যেই তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। -আল জাজিরা। [সূত্র: ২৭ জুন ২০১৬, দৈনিক ইত্তেফাক, লিংক- http://www.ittefaq.com.bd/world-news/2016/06/27/74216.html]
World Economic Forum কর্তৃক আয়োজিত Davos Annual Meeting 2009 – Gaza: The Case for Middle East Peace শীর্ষক সেমিনারে ইসরাইলের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ যখন গাজার পক্ষে এরদুগানের সাহসী বক্তব্যের জবাবে এরদুগানের প্রতি অঙ্গুলি প্রদর্শন করে খোঁড়া যুক্তি পেশ করে খোঁচা মারলেন, এরদুগান তখন এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তার পাল্টা দাতভাঙ্গা জবাব দেন এবং তাঁকে কথা বলার জন্য সময় না দেয়ার কারণে তিনি অনুষ্ঠানস্থান ত্যাগ করেন। [সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=UcWGgtR1sOI পূর্ণ ভিডিও- https://www.youtube.com/watch?v=cR4zRbPy2kY&t=807s]
এরদুগানের এসব সাহসী পদক্ষেপকে পাঠক কীভাবে বিচার করবেন!?
তুরস্ক ইসরাইলে জল-বিমান পাঠালেও আল-কুদস শহর ও এর আশপাশে মাইকে আজান বন্ধে ইসরাইলের পার্লামেন্টে আনা বিলের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। খবরটি পড়ে দেখুন-
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, আল-কুদস শহর ও এর আশপাশে মাইকে আজান বন্ধে ইসরাইলের পার্লামেন্টে আনা বিল কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ইসলামের ওপর ইসরাইলের আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুসলমানদের ধর্মাচরণ চর্চার স্বাধীনতার ওপর হস্তেেপর শামিল। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
মঙ্গলবার তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ‘আল-কুদস ও সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ইন্টার-পার্লামেন্টারি কনফারেন্সে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, তুরস্কের অবস্থান সব ধর্ম এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতা চর্চা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে। বিনালি ইলদিরিম বলেন, সীমান্তে চেকপয়েন্ট বসানো এবং আল-কুদসের কাছাকাছি মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ধর্মাচরণ চর্চার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে ইসরাইল মানুষের ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার ওপর হস্তপে করছে। সেই সঙ্গে ওই জনপদের কাঠামো পরিবর্তনের চেষ্টা করছে ইসরাইল। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। [সূত্র: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬, দৈনিক নয়াদিগন্ত http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/175019]
অনেকেই বলছেন, তুরস্ক বার্মার বিরুদ্ধে জিহাদ না করে ইসরাইলে জল-বিমান পাঠাচ্ছে। শরিয়তের বিধান হল, কোন মুসলমান রাষ্ট্রের সকল জনগণের উপর জিহাদ ফরয হয়ে যায়। সুতরাং ওখানের আমীর জিহাদের জন্য আহ্বান করলে সকলের উপর জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হওয়া ফরয হবে। যদি ঐ রাষ্ট্রে জনগণ শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা না রাখে, তাহলে পাশের রাষ্ট্রের মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরয হয়ে যায়। যদি তারাও মোকাবেলা করার ক্ষমতা না রাখে, তাহলে আবার তাদের পাশের রাষ্ট্রের মুসলমানদের উপর জিহাদ ফরয হয়ে যায়। এভাবে পুরো মুসলিম বিশ্বের দিকে জিহাদের এ ফরয দায়িত্ব স্থানন্তর হতে থাকবে। [সূত্র: ইসলাহী খুতবাত, মুফতী তাকী উসমানী,বিশবকল্যাণ পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ২৮৪-২৮৫, ৫ম খন্ড]
এবার তুরস্ক কোন মুল্লুকে সেটা বোধহয় সমালোচনাকারীদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। সুতরাং তুরস্ক বা এরদুগানের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা আবেগপ্রসূত প্রচারণা চালানো কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। আল্লাহ আমাদেরকে বোঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।
সংগৃহীত পোস্ট