সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ :
গতকাল “যে ইতিহাস জানতে দেয়া হয় নি ৪৫ বছরে” শিরোনামের আমার লেখাতে একজন প্রিয়ভাজন তরুণ নিচের মন্তব্যটি করেছেন। মন্তব্যটি পড়ে মনে হল এটি কেবল একজন তরুণ আলেমের মনের কথা নয়; বরং কিছু ইসলামপ্রিয় তরুণের ভিতর বিগত ৪৫বছরে খুবই সুপরিকল্পিতভাবে এই ভুল চেতনা বা বিষাক্ত বীজ ডুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এই চিন্তা-চেতনা কেবল একজনেরর নয়; বরং এই মিথ্যা ইতিহাস অনেক তরুণদের ভেতরই প্রবেশ করিয়ে দিতে তৎপর তাদের অজান্তেই একটি চক্র। এটা তাঁর দোষ নয়; বরং ইতিহাস না জানার ভুল বলা যেতে পারে। তিনি কমেন্ট করেছেন, “এর মানে এই না যে, আমি আপনার এ কাজের বিরোধিতা করছি। এখন দেশ স্বাধীন হয়েই গেছে। আমার বলা উদ্দেশ্য : * অখণ্ড পাকিস্তানই ভালো ছিল। * স্বাধীনতাযুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম বিপক্ষে ছিলেন। * স্বাধীনতার পরপর অনেক আলেম মুক্তিবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হন। তবে এখন আমরা বাংলাদেশের পক্ষে। স্বাধীনতাযুদ্ধে যেসব আলেম অংশগ্রহণ করেছেন তাদের ইতিহাস মূল্যায়িত হওয়া সময়ের দাবি। ধন্যবাদ।”
এখানে তিনি ৩টি অভিযোগ করেছেন ১. অখণ্ড পাকিস্তানই ভালো ছিল? #অখণ্ড পাকিস্তান ছিল রাজনৈতিক ভূল এটা তৎকালিন প্রায় সকল আলেমরা স্বীকার করেছেন। ৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষে্য মুসলীগের আযোজিত দিল্লী কনফারেন্সে উপস্থিত হয়েছিলেন যারা তাদের অন্যতম ছিলেন, পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা সিলেটের মাওলানা আব্দুর রহমান সিংকাপনী। তিনি সিলেট এসে উলামা সমাবেশ করে বলেছিলেন, “বড় একটি ভুল হয়ে গেল ১২শ মাইল দুরবর্তি দুই ভূখণ্ড নিয়ে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।” সূত্রঃ মুসলিম মনীষা ২য় খণ্ড।
যেখানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই ছিল ভুল সেখানে অখণ্ড পাকিস্তানই ভাল ছিল বলাটি কোন যুক্তিতে । স্বয়ং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ শেষজীবনে বারবার বলতেন “পাকিস্তান হচ্ছে আমার জীবনের বৃহত্তম ভুল” সূত্রঃ Guilty mcn of india’s prtion।
পাকিস্তানের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী প্রায়ই বলতেন, “মুঝকো জিন্নাহ ধোকা দিয়া” আমাকে জিন্নাহ (পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায়) ধোকা দিয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুতেই জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, কুতবে আলম শায়খুল ইসলাম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মদনী রহ. ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মতো দুরর্দশি রাজনৈতিক নেতারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বৃটিশদের ভুল রাজনৈতিক কূটচালের বিরুদ্ধে সোচ্ছার ছিলেন। ইতিহাস প্রমাণ করে ৪৭ থেকে ৭১ এর ভিতরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কোন চেষ্টা করেন নি জিন্নাহরা। এই অখণ্ড পাকিস্তান ভালতো নয়ই; বরং সীমাহীন খারাপ, শোষণ-জুলুম, নির্যাতন আর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিরাট বৈষম্য নীতির কারনে খোদ পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও কায়দে জমিয়ত মুফতি মাহমুদ বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করেছেন। ফেদায়ে মিল্লাত সৈয়দ আসআদ মাদানী রহ ভারতের আলেমদের নিয়ে ৩শতের অধিক সমাবেশ করেছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেছেন। তারাও জানতেন এই অখণ্ড পাকিস্তানের ভুল শোধরানো প্রযোজন একাত্তরে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। আপনি অখণ্ড পাকিস্তান না বলে যদি অখণ্ড ভারত বলতেন তাহলে মেনে নেয়া যেত।
২. স্বাধীনতা যুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম বিপক্ষে ছিলেন! #স্বাধীনতা যুদ্ধে একাত্তরের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমরা ছিলেন মুক্তিযেদ্ধের পক্ষে। তারাই ছিলেন মূল স্পীড। তাদের প্রেরণাতেই কৃষক-শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষ যুদ্ধে শরিক হয়েছিল। কমপক্ষে বাংলাদেশের শতাধিক শীর্ষ আলেম সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। সে তালিকা লিখলে লম্বা হয়ে যাবে। তবে কোন কোন আলেম মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধের কারনে নীরবতা পালন করেছেন। কিন্তু একজন আহলে হক দেওবন্দি আলেম স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন না। আপনি কি একজন কওমি আলেমের নাম যুদ্ধপরাধীদের তালিকাতে দেখাতে পারবেন? একজন আলেমের উপর জামাতি আলবদর রাজাকারের তকমা আছে? একাত্তরে ধর্ষণ-খুনের অভিযোগ কি আছে একজন আলেমের বিরুদ্ধে?
আলেমদের নীরবতাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বলে ধরে নিতে পারি। কারন নীরবতাও সম্মতির লক্ষণ। কিন্তু নীরবতাকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা বলতে পারেন না। এমনকি একাত্তরের কথা, সাহিত্য পর্যন্ত আলেমদের কথা ইচ্ছা অনিচ্ছাতে ফুটেওঠেছে। হুমায়ূন আহমদের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘জোৎসনা জননীর গল্পে’ শহীদ মাওলানা ইরতিযাজ উদ্দীন ও আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাসে নারিন্দার পীর সাহেবের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার কথা ফুটে উঠেছে। এসব বললে বহু ইতিহাস আর বহু কথা বলা যাবে; কিন্তু বাস্তবতা হল সে ইতিহাস আর কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে পড়া আলেমদের একাত্তরের যুদ্ধ কাহিনীকে বিগত ৪৫ বছর ধরে ভুলিয়ে দিতে, ডান বাম মিলে ইতিহাস বদলের কম ষড়যন্ত্র করা হয় নি। যার ফলে আজ কওমি তরুণরা মনে করে তাদের মুরুব্বীরা বুঝি স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী ছিলেন। তারা জানে না, বা জানানো হয় নি যে, তাদের অগ্রজ আলেমদের রক্তসিড়ি বেয়েই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকির ভাষায়, “নষ্টভ্রষ্টরা মুক্তিযুদ্ধ করে নি, মুক্তিযুদ্ধ করেছে ঈমানদের দেশপ্রেমিকরা”।
৩. স্বাধীনতার পরপর অনেক আলেম মুক্তিবাহিনীর হাতে নির্যাতনে স্বীকার হয়েছেন! #মুক্তিবাহিনী বা মুজিব বাহিনী আলেমদের নির্যাতন করার ঘটনা ইতিহাসে খুজে পাওয়া যায় নি। দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে তকখনকার নানা উত্তেজক পরিস্থিতিতে। যে মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরে আলেমদের আশ্রয়ে থেকে যুদ্ধ করেছেন, তাদের দোয়া নিয়ে ময়দানে গেছেন তারা কী করে আলেমদের নির্যাতন করতে পারেন। বরং রাজনৈতিক কারনে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাসদ বাসদ কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়াকার্স পার্টি ইত্যাদি দলের উপর খড়গহস্থ হয়ে ছিলেন। তা না করলে আজ বামরাই হত বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল। কমিউনিস্ট শাসনের পথে পরিচালিত হত দেশ। বাকশালের সময় বঙ্গবন্ধু সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করলেও আলেমদের রাজনৈতিক দল ‘জমিয়তে উলামা’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন নি; বরং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে বঙ্গবন্ধুর আলেমদের প্রতি সীমাহীন দরদ ভালবাসার ইতিহাসকে কি অস্বীকার করা যাবে? ফেদায়ে মিল্লাত রহ.কে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আনানো, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.সহ কিছু আলেমকে কূটনৈতিক তৎপরতার জন্য মধ্যপাচ্যে প্রেরণ। তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের মুসলমানদের দাওয়াতি তৎপরতাকে জোরদার করার চেষ্টা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। যা বিগত কয়েকদিন পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আল্লামা শাহ আহমদ শফি দা.বা.এর চিঠিতেও উল্লেখ করেছেন।
আরও পড়ুন :যে ইতিহাস জানতে দেয়া হয়নি ৪৫ বছর!