সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ :
কারা ইতিহাসকে চেপে রেখেছিল? আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস! একাত্তরের চেতনার ইতিহাস! ইসলামি স্পীডের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে ঈমানী দাবানলের ইতিহাস। বাম লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদরা কখনো চাননি এদেশে আলেমরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ছিলেন এটা প্রমাণিত হোক। প্রমাণিত হোক মুক্তিযুদ্ধের ইসলামি চেতনার স্ফুলিঙ্গ। তেমনিভাবে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রও ইসলামি লেবাস আর লেবেল লাগিয়ে তাদের অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা করেছে। আলেমদের উার দোষ চাপিয়ে নিজেদের বদনামের তকমাকে কিছুটা হালকা করতে?
অপরদিকে অসংখ্য আলেম মুক্তিযোদ্ধা থাকার পরেও আমরা এমন কাউকে পাইনি যিনি আমাদেরকে আলেম মুক্তিযোদ্ধা গল্প, একাত্তরের গল্গগাথা শোনাবেন। স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও খোদ মাদরাসার পাঠ্যতালিকাতে আলেম মুক্তিযোদ্ধা ইতিহাস নেই। জীবনী নেই। গল্প-কবিতা নেই। কোন মোসাদ ষড়যন্ত্রে জাতীয় দিবসকে এতোদিন এড়িয়ে চলা হল মাদরাসার অানুষ্ঠানিকতা ও উদযাপন থেকে? কেন বিজয়ের সুঘ্রাণ নিতে দেয়া হয় নি আলেম প্রজন্মকে? কেন লাল-সবুজের প্রেমময় পতাকা এতোদিন ধরে পতপত করে উড়ানো হল না মাদরাসার আঙ্গিনায়। এতে কি লাভ হল? কার লাভ হল?
কেন আজ মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে মাদরাসার ছাত্ররা অজ্ঞতাবশত কথিত চেতনাধারী ও ঠিকাদারদের সামনে মুখ ছোট করে রাখতে হয়? কাদের অবহেলা ও দৈন্যতার কুফল এসব? এখনো কি এ নিয়ে আলেমদের ভাবনার সময় হয় নি? নিজ দেশে পরবাসির মতো, পরগাছা ভাব নিয়ে আর কতকাল?
স্বাধীনতার ৪৪ বছরে খুব পরিকল্পিতভাবে ইতিহাস বদল হল। কওমী আলেমদের ৯৫ ভাগ মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে কাজ করেও আজ আলেম বলতেই স্বাধীনতা বিরোধী। ইতিহাস বলে, দাড়ি-টুপিওয়ালা রাজাকারের চেয়ে দাড়িবিহীন প্যান্ট-শার্ট পরা রাজাকারের সংখ্যা একাত্তরে বেশি ছিল। কিন্তু এমন করে ইতিহাস বদল হল কার অবহেলা আর অপরাধে? কওমী মাদরাসার পাঠ্যবইয়ে কেন একাত্তরের আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস আজো নেই? বাধা কোথায়? কেন আধুনিক শিক্ষিত তরুণদের মাঝে আলেম মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধের ইসলামি চেতনা নিয়ে নুন্যতম কোন ধারণা নেই? কেন নেই? কাদের কারনে নেই? এই দ্বায়ভার কি আমরা এড়িয়ে যেতে পারব বা এড়িয়ে যাবার আর কোন সুযোগ আছে?
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের অস্থায়ি কার্যালয় ছিল কওমি মাদরাসা চট্টগ্রামের জামেয়া পটিয়াতে। এখানে বসেই শহীদ জিয়া একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। বিনিময়ে পটিয়া মাদরাসার মুহতামিম আল্লামা দানেশসহ ছাত্র-শিক্ষককে পুড়িয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা। যেমন পটিয়ার এই মোল্লাবাড়ি থেকে একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের ডাক এসেছিল ঠিক এভাবেই আলেম বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীকার আন্দোলনে আলেম জাতীয় নেতাদের ঐতিহাসিক অবদানগুলোকে আমরা ভুলে গেছি। শহীদ বুদ্ধিজীবী নামের তালিকায় আল্লামা দানেশের নাম নেই কেন?
আলেমরা যে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনেও চালকের আসনে ছিলেন এটা যেন এ প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্প। এদেশের নারী বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা, সংখ্যালঘু মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতীয় মুক্তিযুদ্ধা, বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা, কিশোর মুক্তিযুদ্ধা কতো কিছু নিয়ে কতো ধরনের কাজ হচ্ছে। কিন্তু আলেম মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বন্ধুবর শাকের হোসাইন শিবলীর ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’ গ্রন্থ ছাড়া তেমন কোন কাজ হয় নি । কেন কওমি মাদরাসা থেকে একজন শিবলী বের হয়ে আসতে সাড়ে তিন যুগ অপেক্ষা করতে কল?
ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে আজ অপরিচিত মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দূল হামিদ খান ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে স্বাধীনতার প্রথম ইঙ্গিতের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের প্রথম বৈঠক হয়েছিল এই মাওলানার সভাপতিত্ব। আওয়ামীলীগ সভাপতি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ এর ভাষা ও অধিকার আদায়ের জন্য পার্লামেন্টে গর্জে উঠার কাহিনী।
শহীদ বুদ্বিজীবী মাওলানা ওলীউর রহমান এর লিখিত বঙ্গবন্ধুর ৬দফার পক্ষে শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬দফা , ৬দফা ইসলামের বিরোধী নহে , যুক্তির কষ্টিপাথরে ৬দফা , জয়বাংলা ইসলাম বিরোধী শ্লোগান নহে ইত্যাদি প্রচারপত্র মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক জাগরণধর্মী প্রচারণা। কিন্তু এই মহান বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকাতে কেন আসেন নি আলেম হিসেবে? কাদের কারনে?
তেলিয়াপাড়া দিবস হিসেবে খ্যাত মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সামরিক বৈঠকে একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে মাওলানা আছআদ আলী এম এল এন এর উপস্হিতি ও ঐতিহাসি অবদান । তিনিই ছিলেন সেই বৈঠকের অন্যতম এক কারিগর। তার খাবার খেয়েই মুক্তিযোদ্ধকে সেক্টরকেন্দ্রিক ভাগ করে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। আর আজ সেই মাওলানারা…
খলিফায়ে মাদানী শায়খে লুৎফুর রহমান বর্ণভী, হাফিজ্জি হুজুর, ফখরে বাঙ্গাল, খতিব আমিমুল এহসান, মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমীর মুক্তযোযুদ্ধের পক্ষে ঐতিহাসিক ফতোয়া। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এর রাজনৈতিক দল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐতিহাসিক সমর্থন। যশোর রেল স্টেশন মাদরাসাতে আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবরের ঘটনাবলী ।
কলকাতায় জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষেষ ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ ও ফেদায়ে মিল্লাত সৈয়দ আসআদ মদনীর মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে ৩০০টি সমাবেশ করে জনমত তৈরি। পাকিস্তানের মুফতি মাহমুদ জালেম সরকারের রক্তচক্ষুর ভয় না করে বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠক ও মুক্তিযোদ্ধকে সমর্থন। রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ ভাষণে মাওলানা জালালাবাদীর তেলাওয়াত ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তার অবদান। কেন আলেম বিদেশি একাত্তরের বন্ধুদের নাম আড়ালে আবডালে চাপা পড়া।
আলেমদের রাজনৈতিক সংগঠন জমিয়তে উলামা প্রকাশ্যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জনমত তৈরি করে। জমিয়ত নেতা বাহুবলের পীর সাহেব আব্দুল হামিদ রহ এর মুক্তিযোদ্ধের পক্ষ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। সিলেটের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা আব্দুল্লাহ জালালালাবাদী, নারায়নগন্জের মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারীর স্বপরিবারে মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণ। হাতিয়া দ্বীপের সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা মোস্তাফিজের গল্প ।
চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মোহাম্মদ ইসহাক এর ঐতিহাসিক অবদান। একাত্তরে তার কামরাতেই থাকতেন ৭নং সেক্টর কমান্ডার এম এ জলিল বীর প্রতীক। চরমোনাই মাদরাসা ছিল মুক্তিসেনাদের ক্যাম্প। রাঙ্গুনিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা ইসহাক ও মাওলানা আবুল কালাম বাপ-বেটার স্বশস্ত্র লড়াইয়ের কাহিনী। চন্দ্রঘোনার মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা দলিলুর রহমান। রানীরহাটের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা মতিউর রহমান। চট্রলার গেরিলা কমান্ডার মাওলানা সৈয়দ।গঙ্গচড়ার মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা আলিফুর রহমানের বীরত্বগাথা। রংপুরেরে দুই আলেম বীর বন্ধু কারী আব্দুস সালাম সরকার ও মাওলানা মোহাম্মদ আলীর কৃতিত্ব। নরসিংদীর বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা বশির উদ্দীন। চান্দিনার সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা মুখলেছুর রহমানের দুঃসাহসিক অভিযান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মি মাওলানা খাইরুল ইসলাম সহ বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য আলেম বীর মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও আমরা জাতির সামনে তুলে ধরতে পারিনি।
সেই ইতিহাসকে ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন ইতিহাসবিমুখ মাওলানার দল। নিজ দেশে পরবাসি সংখ্যালঘু আজ আলেমরা। ফলে দাড়ি -টুপিওয়ালারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একাত্তরসহ শত বছর ধরে বারবার জীবন দিয়েও আজ রাজাকারের তকমা পাচ্ছেন। আজও কি সেই তকমা মুছন করে আলেম প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে কওমির পাঠ্যবইয়ে আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস লেখা হবে? -চলবে