যোগ্যতার ঝুলি খালি থাকলেও সুন্দর সে ইতিহাসটা দেখে অনুবাদের লোভ সামলে রাখতে পারি নি। অনুবাদ করছি মোবাইলের ছোট কীপ্যাড চেপে চেপে। তাও মোবাইলের এসডি কার্ডে সংরক্ষিত অস্পষ্ট পিডিএফ দেখে দেখে। একাগ্রতার সাথে একজায়গায় বসে অনুবাদের সুযোগ করতে পারছি না। কখনো ঘরে বসে, কখনো বাজারে বসে, কখনো যানবাহনে বসে যখন যেখানে সুযোগ হচ্ছে সেখানেই বসে লেখছি। অনুবাদ বা বানানের ক্ষেত্রে কিছুটা ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ থাকলো। –অনুবাদক
সমুদ্র ঈগল ১
দক্ষিণ স্পেনের উপকুলীয় ওয়াদি আলবাশারাত। তিনদিক থেকে প্রাকৃতিক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজের ঢেউখেলানো আলবাশারাত পর্বতশ্রেণি। সে পর্বতশ্রেণির শালির পাহাড়ের চূঁড়ায় একটা চাটানের উপর বসে রয়েছেন একজন লোক। লোকটা যেন সদ্যই যৌবনের উঠুন পেরিয়ে পৌঢ়ত্বের দরজায় কড়া নাড়াচ্ছে। তাঁর হাতে রয়েছে ছাগলের চামড়ার তৈরি একটা ছড়ি। দেখলে যে কেউ তাঁকে একজন রাখাল হিসেবেই মনে করবে। কারণ তিনি যেখানে বসে আছেন ঠিক তার নিচেই ঘাস চিবুচ্ছে একপাল মেষ-ছাগল।
প্রৌঢ় লোকটি বে-তাব দৃষ্টি মেলে শালিরের গা ঘেঁষে বয়ে চলা ফারদিশ নদীর তীরে রাহিবদের খানকাগুলোর দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি বারবার তাঁর দিলে হতাশার কামড় বসাচ্ছিল। তাঁর চাহনি দেখে মনে হচ্ছিল তিনি ওদিক থেকে কারো আগমনের ইন্তেজার করছিলেন।
আলবাশারাত শব্দের অর্থ সবুজ ঘাসে ছাওয়া ভূমি। গ্রানাডা শহরের দক্ষিণ দিকে যে সব সবুজ উপত্যকার মিছিল সাগরের উপকুল পর্যন্ত এগিয়ে চলেছিল পুরো আন্দালুসিয়ায় এরচেয়ে মনোরম কোনো এলাকা ছিল না। উপত্যকাটি ছিল সবধরনের ফসলের গাছের উৎসভূমি। বিশেষ করে আঙুর, নারাঙ্গি, আনজীর, লেবুর সমারোহ ছিল দেখার মতো।
এই আলবাশারাত ওয়াদিতে বসবাস করতো কতিপয় মুসলিম কবীলা। বীরত্ব আর ঐতিহ্যে এরা ছিল আন্দালুসিয়ায় অদ্বতীয়। কারো অধীন হয়ে থাকা ছিল তাঁদের স্বভাব বিরোধী।
আমরা যে কালের কথা বলছি— তখন মুসলিম আন্দালুসিয়ার ঐতিহ্যবাহী রাজধানীর পতন হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের শেষ শাসক আব্দুল্লাহ পরাজয় স্বীকার করে রাজা ফার্দিনান্দের হাতে গ্রানাডার চাবি তুলে দিয়ে অশ্রুসজল চোখে আফ্রিকায় চলে গিয়েছিলেন। তাঁর চলে যাবার পর স্পেনের খৃস্টান শাসকরা জোরপূর্বক মুসলমানদের নাসারা বানিয়ে নিচ্ছিল।
যে সব মুসলমানদেরকে ওরা নাসারা বানিয়ে নিতো, ওরা গির্জায় যেতো ঠিক, তবে ঘরে এসেই তারা নামাজ আদায় করে নিত। কারণ ওরা আত্মরক্ষার জন্যে বাহ্যত নাসরানিয়াত গ্রহণ করলেও অন্তরে অন্তরে তাঁরা ছিল সাচ্চা মুসলমান। সাধারণ নাসারা আর শাসকশ্রেণীকে আশ্বস্ত করার জন্যে তাঁরা গির্জায় গিয়ে বিয়ে শাদী করলেও বাড়িতে এসে তাঁদের ঐতিহ্য অনুযায়ী দ্বিতীয়বার আকদে নিকাহের আয়োজন করতো। আল বাশারাত ছাড়া পুরো স্পেনের অবস্থা ছিল একই ধরনের নাজুক। তবে আল বাশারাত ওয়াদিটা ছিল এ সব বিধি ব্যবস্থা থেকে স্বাধীন। কারণ তারা ছিল যুদ্ধা জাতি। আর তাদের সাথে চলছিল স্পেনের শাসকদের একেরপর এক লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা।
এটা ছিল সেই অভিশপ্ত সময়ের কথা— যখন নাসারা শক্তি পুরো স্পেন তাদের করতলগত করে নিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, তারা স্পেন জয় শেষে আফ্রিকার বিশাল একটা উপকুলীয় অঞ্চল জয় করে সেখানে তাদের সেনাবাহিনী রেখে দিয়েছিল।
হিস্পানীয় মুসলমানরা তাঁদের ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণ আলগ হয়ে পড়েছিল। তাঁদের সামনে হতাশার ভয়ঙ্কর সাগর আর নৈরাশ্যের ঘনকালো অন্ধকার ছাড়া কিছুই ছিল না।
তখনো আল বাশারাত ওয়াদিতে যে সমস্ত মুসলমান তাঁদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রেখেছিল এরা ছিল মোট দুভাগে বিভক্ত।
প্রথম দলটিকে বলা হতো আদনানী কবিলা। এদের মধ্যে ছিল— আরবের বানু হাশিম, বানু উমাইয়া, বানু মাখযুম, বানু ফিহর, বানু কেনানা, বানু হুযাইল, বানু তামীম, বানু সাকীফ, ও বানু রাবিয়া। আর দ্বিতীয় দলটিকে ডাকা হতো কাহতানী কবীলা নামে। এদের মধ্যে ছিল— বানু আযদিনী, বানু খাযরাজ, বানু আওস, বানু হামদান, বানু তাঈ, বানু খাওলান, বানু মুররা, বানু লাহাম, বানু জুযাম, বানু কিন্দাহ, বানু হিমইয়ার, বানু কুযা’আ, বানু হাওয়াজিন ও বানু কালব।
কাহতানীদের বেশিরভাগই ছিলেন বানু খাযরাজ আর আর বানু আউস। এদেরকে আনসারীও বলা হতো। কেননা এঁদের পূর্বপুরুষরাই রাসূলুল্লাহ সা. ও মুহাজিরদেরকে নুসরত করেছিলেন।
আন্দালুসিয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা পাবার পর তাঁদের বেশিরভাগই ওখানে চলে এসেছিলেন। মদীনায় তাঁদের উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিল না বললেই চলে।
তখনকার সময় কাহতানী কবীলার সর্দার যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল কাব বিন আমির, আর আদনানী কবিলার সর্দারের নাম ছিল সা’দ বিন সালামা।
কাহতানী সর্দার কা’বের ছিল এক ছেলে, তাঁর নাম ছিল মুগীরা বিন কাব, আর মেয়ে ছিল দু’জন যথাক্রমে নাবিল এবং মা’আজ। অপরদিকে আদনানী সর্দার সা’দের একমাত্র এক কন্যা ছিল তার নাম ছিল নুবায়রা।
এই দুই যুদ্ধা জাতি স্পেনের পতনের পরও তাঁদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিল এবং তখনো তা টিকিয়ে রেখেছিল। যদিও তখন পুরো স্পেনের অবস্থা ছিল বর্ণনাতীত মর্মন্তুদ।
শালির পাহাড়ের উপরে বসে থাকা সেই প্রৌঢ় যিনি চূড়ার চাটানে বসে আকুল হয়ে ফারদিশ নদীর কিনারে গড়ে ওঠা রাহিব পল্লীর দিকে তাকাচ্ছিলেন হতাশা আর ক্ষোভে তিনি মাঝে মাঝেই হাতের ছড়িটা দ্বারা পাথরের গায়ে জোরে জোরে আঘাত হানছিলেন। কতক্ষণ এভাবে বসে থেকে কী যেন ভেবে তিনি উঠে দাড়ালেন। কয়েক কদম পায়চারি করলেন, আবার তিনি রাহিব পল্লীর দিকে তাকালেন। কিন্তু হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে তিনি গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন—
প্রভু হে কেমন করে শেষ হবে এ ইমতিহান।
আমাদের দিলে তো জ্বলছে হতাশার আগুন লেলিহান।
নিভে যাচ্ছে দিলের শামাদানে রাখা আশার চেরাগ।
পূর্বাকাশে নেই কাঙ্খিত আলো, পাখির কুজন রাগ।
চলিছে ভাঙার খেলা গড়ার নেই চিহ্ন কোনো।
মাহরুম মোরা বখত থেকে শুষ্কপত্র বৃক্ষ যেনো।
প্রভু! তোমার দুনিয়ায় কার কাছে চাব ইনসাফের বিচার,
সবই যে আজ আত্মক্লেদে ডুবন্ত উজাড়।
প্রভু! তুমি তো দেখছো চেয়ে কোথায় আমরা কোথায় আমাদের সন্তান।
মরে যাই যতোই তবু গাইব তব গান হে মেহেরবান।
এটুকু বলার পরই প্রৌঢ়ের আত্মলীন অবস্থাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কারণ প্রৌঢ় দেখতে পেলেন ঘোড়ায় চড়ে তাঁরই দিকে ছুটে আসছে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ উদ্ভিন্ন যৌবনা দুটি গোলাপ কমনীয় বালিকা। তাদের সাথে চলে আসছিল একজন কালো হাবশী। সম্ভবত লোকটা তাদের গোলাম হবে।
পাহাড়ে উঠে মেয়ে দুটো তাদের ঘোড়া থেকে নেমে পড়লো। তাদের দেখাদেখি কালো হাবশি লোকটিও তার ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ালো।
মেয়ে দুটো ছিল অনির্বচনীয় সুরঞ্জনা। তাদের গায়ের রঙ এবং গড়ন-গঠন ছিল প্রায় একাকার। তারপরও ছোট মেয়েটির চেহারায় ছিল আলাদা এক আকর্ষণ, যা কেবল অনুভব করা যায়। সেই অনুভবের গায়ে ভাষার চাদর জড়ানো কারো পক্ষেই বোধহয় সম্ভব নয়।
ছোট মেয়েটা প্রৌঢ়ের কিছুটা নিকটে এসে তাকে লক্ষ করে বলল: চাচা মুনজির বিন যুবাইর! আমি উপর থেকে আপনার অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করে আসছি। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আপনি চিরাচরিত অভ্যাসের বিপরীতে ফারদিশ নদীর তীরবর্তী রাহিব পল্লীর দিকে বে-চইন হয়ে বারবার তাকাচ্ছেন। আপনি কি ওখান থেকে কোনো তুফান জেগে উঠার সন্দেহ করছেন, নাকি ওখান থেকে কোনো কল্যাণের প্রত্যাশা করছেন? -চলবে