রেজাউল কারীম আবরার :
সর্বপ্রথম এমন মারাত্মক ফতোয়া দিয়েছিলেন ড. জাকির নায়েক। এরপর কথিত শায়খ আকরামুযযামান বিন আবদুস সালাম এবং ড. সাইফুল্লাহও এমন ফতোয়া দিয়েছেন। সবচেয়ে মজার কথা হল, তারা কিয়াসকে শরীয়তের দলীল মনে করেন না! কথায় কথায় সহীহ হাদীসের ধোয়া তুলেন! অথচ ‘ওযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যাবে’ এ মাসআলায় তারা সহীহ হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করতে পারেননি; বরং উল্টো যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন! এর বিপরীতে একাধিক সহীহ হাদীস রয়েছে যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ওযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যাবেনা! প্রথমে আমরা এ সংক্রান্ত সহীহ হাদীসগুলো উল্লেখ করছি।
আবু বকর বিন হাযম রাঃ থেকে বর্ণিত,
إن في الكتاب الذي كتبه رسول الله صلى الله عليه و سلم لعمرو بن حزم : لا يمس القرآن إلا طاهر
অর্থাৎ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমর বিন হাযমের উদ্দেশ্যে যে চিঠি লিখেছিলেন, সেখানে লিখেছিলেন যে, পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ কুরআন স্পর্শ করবেনা। (মুয়াত্তা মালেক, হাদীস নং, ৬৮০. মা’রেফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, ২০৯. মিশকাতুল মাসাবিহ, ৪৬৫. কানযুল উম্মাল, ২৮২৯)
হাদীসটির ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে আবদিল বার মালেকী রহঃ লিখেন:
وكتاب عمرو بن حزم هذا قد تلقاه العلماء بالقبول والعمل وهو عندهم أشهر وأظهر من الإسناد الواحد المتصل وأجمع فقهاء الأمصار الذين تدور عليهم الفتوى وعلى أصحابهم بأن المصحف لا يمسه إلا الطاهر
وهو قول مالك والشافعي وأبي حنيفة وأصحابهم والثوري والأوزاعي وأحمد بن حنبل وإسحاق بن راهويه وأبي ثور وأبي عبيد وهؤلاء أئمة الرأي والحديث في أعصارهم
وروى ذلك عن سعد بن أبي وقاص وعبد الله بن عمر وطاوس والحسن والشعبي والقاسم بن محمد وعطاء وهؤلاء من أئمة التابعين بالمدينة ومكة واليمن والكوفة والبصرة
অর্থাৎ, আমর বিন হাযমকে উদ্দেশ্য করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি আলেমরা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন। তাদের নিকট একটি সনদে বর্ণিত মুত্তাসিল হাদীস থেকে এটি প্রসিদ্ধ এবং স্পষ্ট। সমস্ত শহরের নির্ভরযোগ্য সকল ফকীহ এ বষিয়ে একমত যে, ওযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যাবেনা। এটা হল ইমাম মালেক, শাফেয়ী, আবু হানিফা এবং তার সহচররা, সুফিয়ান ছাওরী, আওযায়ী, আহমদ বিন হাম্ভল, ইসহকি বিন রাহুয়াহ, আবু ছাওর, আবু উবায়দ রহঃ-এর মত হাদীস এবং ফিকহের ইমামদের মত।
এমনটি বর্ণিত হয়েছে সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস, আবদুল্লাহ বিন উমর রা., তাউস, হাসান বাসরী, শা’বী, কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ এবং আতার মত মদীনা, মক্কা, ইয়ামান, বসরা এবং কুফার প্রসিদ্ধ ইমাম তাবেয়ীন থেকে। (আল ইসতিযকার, ২/৪৭১. দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বায়রুত, ১ম সংস্করণ)
ইবনে আবদিল বার মালেকী রহ.-এর দীর্ঘ বক্তব্য দ্বারা মাসআলাটি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায়। যে মাসআলায় এতজন ইমাম একমত? আবার রয়েছে রাসূলের সহীহ হাদীস, তার বিরোধিতা করার স্পর্ধা কোথায় পেলেন তথাকথিত শায়খরা?
আবদুল্লাহ বিন উমর রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেন:
عن سليمان بن موسى سمعت سالم بن عبد الله بن عمر يحدث عن أبيه قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم لا يمس القرآن إلا طاهر
অর্থাৎ, পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ কুরআন স্পর্শ করবেনা। (আল মু’যামুল কাবীর, ১৩২১৭. আল মু’যামুস সাগীর, ১১৬২)
হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম হাইছামী রহ. বলেন:
رواه الطبراني في الكبير والصغير ورجاله موثقون
অর্থাৎ, হাদীসটি ইমাম তাবারানী ‘আল মু’যামুল কাবীর’ এবং ‘আল মু’যামুস সাগীর’ এ উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাকারী সকলেই বিশ্বস্ত এবং গ্রহণযোগ্য। (মাযমাউয যাওয়ায়িদ, হাদীস নং, ১৫১২)
ওযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যাবেনা এ বিষয়ে আরো হাদীস রয়েছে। এখানে মাত্র দুটি উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ বিস্তারিত জানতে চাইলে ইমাম যায়লায়ী লিখিত “নাসবুর রায়াহ”(১/১৭০. দারুল হাদীস) দেখতে পারেন। সেখানে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
সাহবাদের মত।
পূর্বে ইবনে আবদিল বার মালেকীর বক্তব্যে অনেক সাহাবীর মত তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া ইমাম নববী রহ. বলেন:
”وبأنه قول علي وسعد بن ابي وقاص وابن عمر ولم يعرف لهم مخالف في الصحابة”
অর্থাৎ, ওযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যাবেনা, এমনটি হল সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস এবং ইবনে উমর রা.-এর মত। সাহাবাদের মাঝে তাদের মতের খেলাফ কারো মত পাওযা যায়না। (আল মাযমু শারহুল মুহাযযাব, ২/৮০)
দেখুন, যে মাসআলায় সমস্ত সাহাবা একমত, তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কথিত শায়খরা নির্লজ্জভাবে ফতোয়াবাজি করেছেন! তাদের কি উদ্দেশ্য আল্লাহই ভালো জানেন।
আলোচিত মাসআলায় এখন কথিত শায়খদের নিকট গ্রহণযোগ্য দুজন আলেমের বক্তব্য তুলে ধরছি।তাদের একজন হলেন শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ো রহঃ। এবার দেখুন এবিষয়ে তার ফতোয়া কি?
هل يجوز مس المصحف بغير وضوء أم لا فأجاب مذهب الأئمة الأربعة أنه لا يمس المصحف إلا طاهر كما قال في الكتاب الذي كتبه رسول الله لعمرو بن حزم أن لا يمس القرآن إلا طاهر
অর্থাৎ, চার মাযহাবের ইমামরা এ বিষযে একমত যে, কুরআন ওযু ছাড়া স্পর্শ করা যাবে না। যেমনটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযা সাল্লাম আমর বিন হাযম রাঃকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন। (মাযমুয়াতু ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া, ২১/ ২৬৬.)
কথিত শায়খদের বরণীয় ব্যক্তিত্য সৌদি আরবের শায়খ উসাইমীন রহ. বলেন:
فإن القرآن لا تحل قراءته للجنب وأما من بحدثٍ أصغر فيجوز أن يقرأ القرآن لكن لا يمس المصحف لأن المصحف لا يمسه إلا طاهر لقوله صلى الله عليه وسلم في الكتاب الذي كتبه إلى عمرو بن حزم أن لا يمس القرآن إلا طاهر والمراد بالطاهر الطاهر من الحدثين الأصغر والأكبر
অর্থাৎ, জুনুবী ব্যক্তির জন্য কুরআন তেলাওয়াত জায়েয নেই। ওযুহীন ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করতে পারবে কিন্তু কুরআন স্পর্শ করতে পারবেনা। কেননা পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ কুরআন স্পর্শ করতে পারবেনা। যেমনটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমর বিন হাযম রা.কে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন। পবিত্র দ্বারা উদ্দেশ্য হল ছোট বড় সব ধরণের নাপাকী থেকে পবিত্র হওয়া। (ফতোয়া শায়খ উসাইমীন, বাব নং, ২০৩. মাকতাবাতুশ শামেলা)
শায়খ উসাইমীন রহ. অন্য জায়গায়ও এমন বক্তব্য দিয়েছেন। আরবী পাঠ নিম্নরূপ:
ومن النصيحة لكتاب الله عزّ وجل أن يقوم الإنسان باحترام هذا القرآن العظيم، فمن ذلك أن لا يمس القرآن إلا وهو طاهر من الحدثين: الأصغر والأكبر، لقول النبي صلى الله عليه وسلم :” لا يمسّ القرآن إلا طاهر”[267] أو من وراء حائل؛
(শারহু রিয়াযিস সালেহীন, ২/৩২১)
শায়খরা কুরআনে উল্লেখিত সূরা ওয়াকিয়ার আয়াতের অপব্যাখ্যার আশ্রয নিয়ে বরেছেন, ওযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যাবে! এতগুলো সহীহ হাদীস, সাহাবাদের ইজমা এবং তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য দুজন ইমামের বক্তব্য তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি! অথচ কুরআন ওযু ছাড়া স্পর্শ করা যাবেনা এ বিষয়টি প্রমাণ করতে কুরআনের এ আয়াত দ্বারা দলীল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়ে যায়। এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন ইমাম বুখারীর উস্থাদ ইসহাক বিন রাহুয়াহ রহঃ। তিনি বলেন:
قال إسحاق بن راهويه لا يقرأ أحد في المصحف إلا وهو متوضئ وليس ذلك لقول الله عز و جل ( لا يمسه إلا المطهرون ) الواقعة 79
ولكن لقول رسول الله صلى الله عليه و سلم لا يمس القرآن إلا طاهر
কুরআন ওযু ছাড়া স্পর্শ করা যাবেনা এ মাসআলা সূরা ওয়াকিয়ার আয়াত দ্বারা প্রমাণিত করার প্রয়োজন নেই। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়। (আল ইসতিযকার, ২/৪৭১)
শাযখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর ও এ ধরণের বক্তব্য রয়েছে। দেখুন, “মাজমুয়াতু ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া, ২১/ ২৬৬.
এ দীর্ঘ আলোচনার পর কথিত শায়খদের অন্ধ ভক্তরা কি বলবেন? আপনাদের শায়খরাতো কুরআন থেকে টাই সুন্নাহ সম্মত পোষাক হওয়ার দলীল বের করে ফেলেন! শায়খ নামীয় এ ধরণের খতরনাক প্রাণীদের থেকে আল্লাহ সাধারণ মুসলমানদের হেফাজত করুন।