আমিন মুনশি :
নিজভূমিতে পরবাসী হওয়া কতটা কষ্টের সেটা আমরা জানি। বিনা কারণে শাস্তি পাওয়ার যন্ত্রনা কেমন হয়-সেটা আমরা বুঝি। পাকিস্তানি হায়েনারা যখন আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল, আমাদের মা-বোনকে ধর্ষণ করেছিল, আমাদের সঞ্চিত সম্পদ লুটপাট করে নিয়েছিল তখন আমরা বুঝেছি উদ্বাস্তু হওয়া কতটা বেদনার। লাঞ্ছনার তীব্র দহনে আমাদেরকে যখন পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল তখন আমরা অনুভব করেছি জীবন কতটা মূল্যবান। প্রাণের আকুতি কতটা বিষাদময় হয়ে থাকে। এই জীবনকে বাঁচানোর জন্য, স্বাধিকার আদায়ের জন্য আমাদের মন কতটা ব্যাকুল হয়েছিল!
চারপাশে ধ্বংসস্তুপ আর লাশ পোড়া গন্ধ দেখে আমরা কতটা ছটফট করেছিলাম-সেটা ইতিহাস স্বাক্ষী হয়ে আছে। পরিবেশ বীভত্স রূপ ধারণ করলে কতটা মনোক্ষুণ্নের কারণ হয় সেটা আমরা উনিশশো একাত্তর সালে খুব কাছ থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। সেই পৈশাচিক দিনগুলির কথা স্মরণ হলেই বুঝতে পারি ভিটেমাটি হারানোর তিক্ততা। বর্বরতার সেই ক্ষতগুলো আজও আমাদেরকে নাড়া দিয়ে যায়। শোকের মাতম যখন আকাশ-বাতাস ভারি করে তোলে তখন জলীয় বাষ্পের মত চোখের পানিগুলোও কেমন যেন বাষ্প হয়ে যায়! কণ্ঠস্বর ফ্যাকাশে হয়ে আসে! চাহনিতে কেমন অসহায়ত্ব খেলা করে- এ সবকিছুই আমাদের জানা আছে। আকুতিভরা আবদার নিয়ে আমরা যখন বিদেশিদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম তখন ভারত সরকার আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিল। শরনার্থী শিবিরে ঠাঁই দিয়েছিল। রিলিফের মাল নিয়ে হাজির হয়েছিল কত দেশের সাহায্য সংস্থা!
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল বলেই আমরা এত সহজে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিলাম। মুক্ত পরিবেশে এখন ধীরে ধীরে উন্নতির পথে হাঁটতে পারছি। আমাদের সংবিধানে তাই এই মানবিক সাহায্যের ব্যাপারটি অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। পৃথিবীর যে কোন দেশেই যখন কোন জাতি-গোষ্ঠী নির্যাতনের শিকার হবে তখন আমরা তাদের পাশে থাকবো। তাদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে কথা বলবো। ইতিপূর্বে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আমাদের অবস্থান ব্যাপক প্রশংসনীয় হওয়ার নজির রয়েছে।
আমাদেরকে এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতেই হবে। তাদের উপর বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের ব্যাপক হামলা, ধর্ষণ ও লুটপাটের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেই হবে। রোহিঙ্গাদের যারা প্রাণ বাঁচাতে আমাদের কাছে আশ্রয়প্রার্থী হচ্ছে তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করতেই হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধ যারাই করুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। সংখ্যালঘু হলেই কারো উপর যেন অবিচার না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোন মানুষকেই তুচ্ছ হতে দেয়া যাবেনা। আজ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের যদি আমরা সাহায্য না করি তাহলে বড় অকৃতজ্ঞা হবে। অর্যদের হাতে বাঙালিরা যখন নিষ্পেষিত হয়েছিল তখন এই রোহিঙ্গারাই আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিল। মানবিক সহমর্মিতা বলে যদি কিছু থাকে তবে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতেই হবে !!
লেখক : প্রবন্ধকার