ড. আহমদ আবদুল কাদের :
আমাদের দেশে মাঝে মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর, তাদের উপাসনালয়, তাদের বাড়িঘর-সম্পত্তি ইত্যাদির ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। সাথে সাথে সেকুলার তথা ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার একে আলেম-উলামাসহ, ইসলামি সংগঠনের ওপর চাপিয়ে দেন। তারা এসব ঘটনার আসল রহস্য খুঁজে বের করার আগ্রহ বোধ করেন না। ভাবখানা যেন এমন, ধার্মিক লোকেরাই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। যারা সেকুলার রাজনীতির প্রবক্তা, তারা সাধারণত ইসলামপন্থীদের ওপর সব দোষ চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস চালান। সাথে সাথে সরকারের পুলিশ বিভাগ কর্তব্য পালনের নামে পাইকারি হারে নিরীহ লোকদের, ক্ষেত্রবিশেষে আলেমদেরও গ্রেফতারির মহড়া দেয়।
এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় এ ধরনের একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কাবাঘরের ছবির সামনে শিবের মূর্তি বসিয়ে একটি ছবি পোস্ট করা হয়। এটাকে কেন্দ্র করে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। দেওবন্দী আলেমদের নেতৃত্বাধীন ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে একটি এবং অনেকটা সরকার সমর্থিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ব্যানারে আরেকটি প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ দুটোতেই সরকারি কর্মকর্তারা হাজির হয়ে বক্তব্য রাখেন এবং জনতাকে শান্ত থাকতে বলেন। যথাসময়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ দু’টি শেষ হয়। এর মধ্যে কে বা কারা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে আক্রমণ চালালে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যায়। কয়েক দিন ধরে মাঝে মধ্যে এই অবাঞ্ছিত আক্রমণ ঘটতে থাকে। দেশের আরো কয়েকটি এলাকায় এ ধরনের কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে। ঘটনা স্থানীয় হলেও এর আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটে যায়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাসিরনগরের ইউএনও এবং ওসিকে বদলি করা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের একপক্ষ স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রী সাইদুল হককে দায়ী করে বক্তব্য রাখে, আরেক পক্ষ প্রশাসনকে দায়ী করেছে। অন্য দিকে এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতারের নামে উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় ব্যাপক পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়। অনেকক্ষেত্রে শিকার হয় এলাকার নিরীহ মানুষ। এর সাথে চলে গ্রেফতার-বাণিজ্যের রমরমা কারবার। যা হোক, শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিবাদ বা কোন্দলের সূত্র ধরেই এসব আক্রমণ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। মন্ত্রী সাইদুল হক ও তার বিরোধী গ্রুপের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ এ ঘটনা। এ কাজে ফেসবুকের আপত্তিকর পোস্টটি ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। মাঝখান থেকে নিরীহ মানুষ ও আলেম-ওলামা বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন, আক্রমণের শিকার হয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধারণ ও নিরীহ লোকেরা। এক কথায় এরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাজনীতির বলি। অথচ আমাদের রাজনীতি যদি ইনসাফ-ভিত্তিক হতো, হতো সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ, তাহলে এ ধরনের ঘটনা সৃষ্টি করার সুযোগ হতো না। সম্প্রদায়ের প্রতি ইনসাফ করবেন না অথচ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বলবেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্পিত সম্পত্তির ইস্যুটির সমাধান করবেন না, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বলে বেড়াবেন; এতে সঙ্কটের কোনো সমাধান হবে না। রাজনীতি হতে হবে ইনসাফ-ভিত্তিক, রাষ্ট্র হবে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ, তাহলেই সমাধান বের হবে। তা না হলে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির নামে সংখ্যালঘুর সম্পদ লুট হবে মাত্র। রাষ্ট্র স্থিতিশীল থাকার মূল ভিত্তি হচ্ছে- আইনের শাসন, সম্প্রদায় ও দলনিরপেক্ষভাবে এর প্রয়োগ আর সব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।
আমাদের দেশে যে রাজনীতি বিরাজমান, তার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সমস্যার তেমন কোনো সমাধান হচ্ছে না। যেকোনো দেশেই সংখ্যালঘুরা কোনো না কোনোভাবে চাপের মুখে থাকেন। পৃথিবীর বহু দেশই এ সমস্যা সমাধানের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এরপরও কোনো দেশেই সংখ্যালঘু সমস্যা- তা জাতিগত, বর্ণগত, গোষ্ঠীগত হোক বা ধর্মীয় হোক, সমাধান হচ্ছে না। ইউরোপের অনেক দেশই সেকুলার তথা ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার দাবিদার; অথচ সেখানে মুসলিম সংখ্যালঘুরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমরা, আফ্রো-আমেরিকানরা ভালো অবস্থায় নেই। প্রতিবেশী ভারত, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশের অবস্থাও একই রকম। সেখানে মুসলিম, খ্রিষ্টান বা নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায় নানা বঞ্চনা-বৈষম্য অত্যাচার-অবিচারের সম্মুখীন, এমনকি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে বারবার। কাজেই সেকুলার রাজনীতি সংখ্যালঘু সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারেনি।
আমরা যদি নিরপেক্ষ মানসিকতা নিয়ে প্রতিটি দেশের জাতিগত, সম্প্রদায়গত, বর্ণগত সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো- এগুলো প্রধানত ধর্মীয় কারণে সৃষ্টি হয়নি। এগুলোর পেছনে আছে হীন ও সঙ্কীর্ণ স্বার্থের দ্বন্দ্ব। একই ধর্মের লোকদের মধ্যেও জাতিগত, বর্ণগত বিদ্বেষ সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখলেই এসব সমস্যার সমাধান হবে না, বরং ধর্মের মহান মূল্যবোধ ধারণ করলেই সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান সম্ভব। ইতিহাসেও দেখা গেছে, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত ধর্মের বিশেষত ইসলামের মূল্যবোধ ধারণ করেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তিশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করেছে। ধর্মকে ধারণ করার কারণে নয়, বরং ইসলামি মূল্যবোধ পরিহার করে অন্যায় ও বৈষম্য সৃষ্টি এবং ন্যায়-ইনসাফকে ধারণ না করার কারণেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়। কাজেই সমস্যা সমাধানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো প্রকার অন্যায়-অবিচারের সুযোগ না দেয়া। ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাষ্ট্র ধর্মভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। এমনকি শুধু প্রাথমিক যুগে নয়, পরবর্তী সময়েও মুসলিম খেলাফতে বা মুসলিম সাম্রাজ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক সঙ্কট বা সমস্যা দেখা দেয়নি। ছয় শ’ বছর স্থায়ী তুরস্কের বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যে তেমন কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। তবে অটোমান শাসনের একদম শেষের দিকে ১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ানদের কথিত গণহত্যার মধ্যে যতটুকু সত্যতা থাকুক, তা মূলত ইসলামের মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে গিয়ে তুর্কি জাতিগত প্রাধান্য দেয়াতেই ঘটেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের মূল্যবোধ সক্রিয় ছিল, ততক্ষণ সেখানে সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দেয়নি। ভারতেও যতদিন পর্যন্ত মুসলিম শাসকেরা ইসলামের মূল্যবোধকে ধারণ করেছেন, ততদিন কোনো সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দেয়নি। যখন উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ বেনিয়ারা ভারতে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল, তখনই তারা হিন্দু এলিটদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টি করল এবং শেষ পর্যন্ত নবাব সিরাজুদদৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ব্রিটিশ রাজত্ব কায়েম করল। বস্তুত ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির কারণে। ইংরেজরাই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিয়েছে, লালন করেছে এবং এর বিকাশে সহযোগিতা করেছে। এ দেশের বর্ণবাদী এলিট হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজদের ইন্ধনের কারণে প্রথমে সাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে তারই প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানদের মধ্যেও এ মনোভাব, বিশেষত নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের জন্ম হয়। এর ফলে পাকিস্তানের সৃষ্টি। যদি সম্প্রদায়ের ভিন্নতার কারণে ইনসাফের খেলাফ কোনো কাজ না করা হতো, যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতারা মুসলমানদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতেন (দেশবন্ধু সি আর দাস ও নেতাজী সুভাষ বোসের অনুসরণে) তাহলে, রাষ্ট্রকে ভাগ করার প্রয়োজন সৃষ্টি হতো না। মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে যখন আশঙ্কা সৃষ্টি হলো, তখনই কিন্তু পাকিস্তান ইস্যুটি জোরদার হয়ে ওঠে। আর এর জন্য বর্ণ হিন্দুরাই দায়ী, মুসলমানেরা নয়। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ধার্মিক মুসলমানেরা কিন্তু কখনো সাম্প্রদায়িক মনোভাব দ্বারা আচ্ছন্ন হয়নি। উপমহাদেশের আলেম সমাজের বিপুল অংশ অখণ্ড ভারতের পক্ষে ছিলেন, অন্য পক্ষ সাম্প্রদায়িক কারণে নয়, বরং নিরাপদে ও স্বাধীনভাবে নিজস্ব আদর্শ ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হবে বিবেচনা করে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। আবার পাকিস্তানে যখন পূর্ব পাকিস্তানিদের ওপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য চাপিয়ে দেয়া হলো, তখন তারই প্রতিক্রিয়ায় এ অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চেতনা দানা বেঁধে উঠল, যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেয়। কাজেই সাম্প্রদায়িকতার মূল কারণ ধর্মীয় নয়, বরং কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি অবিচার ও বিদ্বেষই হচ্ছে মূল কারণ। সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সবার প্রতি ইনসাফ ও সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারলেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত হবে। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি অন্যায় হস্তক্ষেপ হলেই সেখানে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হয়। তখন ধর্মকে এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনকভাবে অপব্যবহার করা হয় মাত্র। কাজেই ধর্মের সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সংযোগ নেই। বিশিষ্ট কমিউনিস্ট লেখক বদরুদ্দীন উমরের ভাষায়, ‘ধর্মের সাথে তাই সাম্প্রদায়িকতার কোনো প্রয়োজনীয় তত্ত্বগত সম্পর্ক নেই। ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচার-আচরণকে ভিত্তি করে যে সমাজ ও সম্প্রদায় গঠিত, সে সম্প্রদায়ের ঐহিক স্বার্থই সাম্প্রদায়িকতার জনক। সাম্প্রদায়িকতার জন্য তাই ধর্মে নিষ্ঠাবান হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাম্প্রদায়িকতা এ অর্থে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ।’ (বদরুদ্দীন উমর, মুক্তধারা, ঢাকা ১৯৮০, পৃ. ৯)। কথাটি যথার্থ।
ইসলাম এমন একটি আদর্শ, যা সব সময়ই সাম্প্রদায়িকতার ঘোর বিরোধী। ইসলামে সুবিচার ও ন্যায়ের প্রশ্নে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদির পার্থক্য মোটেও বিবেচিত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায়কারী মুসলিম হলেও তা নিন্দনীয়, অমুসলিম হলেও নিন্দনীয়। অন্যায়কারী বাঙালি হলেও তা অগ্রহণযোগ্য আবার অবাঙালি হলেও তা অগ্রহণযোগ্য। অন্যায়ের কোনো জাতি নেই, ধর্ম নেই, বর্ণ নেই। অন্যায় অন্যায়ই। অন্যায়কে ন্যায় বানানোর জন্য তাকে ধর্মীয়, জাতিগত ও বর্ণগত রূপ দেয়া হয়। ফলে সৃষ্টি হয় সাম্প্রদায়িকতা, যা খুবই নিন্দনীয়। এ ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে : ‘এবং কোনো দলের শত্রুতা ও বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে এতটুকু ক্ষিপ্ত না করে যাতে অন্যায় অবিচার করে বসো। সুবিচার করো, তা তাকওয়ার নিকটবর্তী।’ (সূরা আল মায়েদা : আয়াত ৫)।
কোনো জনগোষ্ঠীর বা কোনো ব্যক্তির প্রতি ক্ষোভ-বিদ্বেষের কারণে কারো প্রতি অন্যায় আচরণ করা যাবে না, সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না। কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়-অন্যায় নির্বিশেষে কাউকে সহযোগিতা করা যাবে না। এ ব্যাপারে ইসলামের ঘোষণা দ্ব্যর্থহীন : ‘কোনো সম্প্রদায়ের বা জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন সীমা লঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। সৎ কর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে পরস্পরকে সাহায্য করবে না।’ (সূরা মায়েদা : আয়াত ২)।
কাজেই এটি স্পষ্ট, যেকোনো অবস্থায় ন্যায়ের পথ থেকে সরে এসে অন্যায়ের পথ অনুসরণ করা যাবে না। কোনো সম্প্রদায়ের কোনো একজন ব্যক্তির অপরাধের জন্য গোটা সম্প্রদায়কে দায়ী করে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ ইসলামে নেই। কারো মন্দির বা উপাসনালয়ে আক্রমণ চালানো, তাদের কোনো প্রতিমাকে ধ্বংস করা ইসলামি আইনে এক বড় অপরাধ। ইসলামে পরিষ্কার বলা আছে : দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই।’ (সূরা বাকারা : ২৫৬)। তাদের উপাস্যকে গালি দেয়াও যাবে না, তাদের প্রতিমাও ভাঙা যাবে না। আল কুরআন বলছে : আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যেসব উপাস্যকে ডাকে, তোমরা তাদের গালি দিও না।’ (সূরা আল আনয়াম : আয়াত ১০৮)।
কাজেই আমাদের দেশে যেসব ধর্মীয় সংখ্যালঘু রয়েছেন, যেমন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সম্প্রদায় অথবা জাতিগত সংখ্যালঘুÑ চাকমা, সাঁওতাল, হাজং, গারো যাই হোক না কেন, তাদের জানমাল-ইজ্জত সবই জাতির সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কাছে আমানত্। এ আমানতকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। তাদের জানমাল-ইজ্জতের ওপর কিছুতেই হস্তক্ষেপ করা যাবে না, তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি কোনো বাধা সৃষ্টি করা যাবে না- এটা তাদের অধিকার। ইসলাম এ অধিকারকে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়েছে। যখন কোনো জাতি বা ধর্ম অন্য জাতি বা ধর্মকে স্বীকৃতি দিতে চাইত না, তখনই ইসলাম এসব বিষয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে। মুসলমান হয়ে আমরা ইসলামের বিধান লঙ্ঘন করতে পারি না।
প্রকৃতপক্ষে দেশের আলেমসমাজ এবং ইসলামি আন্দোলনের নেতাকর্মীরা আল কুরআনের এসব নীতিমালা মেনে চলেন। তারা কারো ওপর বাড়াবাড়ি করেন না, কারো সম্পত্তি দখলের লোভে কারো বাড়িঘরে আক্রমণ করেন না। কারো মন্দিরে আক্রমণ চালিয়ে ভাঙচুর করেন না, করতে পারেন না। ইসলামপন্থীরা এসব কর্মকাণ্ড বরাবরই ঘৃণা করে থাকেন। শুধু ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদাররা, যাদের মধ্যে ন্যায়বোধ নেই, তারাই ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত বৈষয়িক স্বার্থে, ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক স্বার্থে সমাজের দুর্বল অংশ হিসেবে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ চালায়, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিগত ৪৫ বছরের বিভিন্ন ঘটনা এটা প্রমাণ করে। কাজেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক আদর্শ সম্প্রীতির জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, বরং ধর্মীয় আদর্শ ন্যায় ও ইনসাফের মূল্যবোধ ধারণ করা প্রয়োজন। আর তা ধর্ম অনুশীলন করলেই অর্জন করা সম্ভব, ধর্মকে পরিহার করে নয়। বাংলাদেশের উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা যত তাড়াতাড়ি এসব বিষয় উপলব্ধি করবেন, ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল।
লেখক : মহাসচিব, খেলাফত মজলিস