বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৪:৫৯
Home / দেশ-বিদেশ / জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আহ্বানে আয়োজিত বিশশান্তি সম্মেলন

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আহ্বানে আয়োজিত বিশশান্তি সম্মেলন

যে জন্য, যেখানে, যেভাবে, যাদের নিয়ে!

মুহাম্মাদ নাজমুল ইসলাম :

সরেজমিন রিপোর্ট : আমরা জানি বর্তমান হিন্দে মুসলমানরা এক নাজুক অবস্থা অতিক্রম করছে। বিশেষতঃ ‘মুসলিম পারসোনাল লো বোর্ড’ নিয়ে চলছে মুদি সরকারের রাজনীতির গভীর ষড়যন্ত্র। এক্সিসেবিল কোর্ট-এ তিন তালাক বিষয়ক মাসয়ালা নিয়ে চলছে মামলা মুকাদ্দামা। প্রত্যেক মুসলমানই নিজস্ব প্লাটফর্ম থেকে ঈমানী দায়িত্ববোধ থেকে এর প্রতিবাদ করে আসছেন।
কিন্তু তারপরও বিষয়টি যেনো মুদি সরকার এড়িয়েই যাচ্ছেন। এমতাবস্থায় মুসলিম মিল্লাতের ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করা আবশ্যক হয়ে পড়ছে। কিন্তু তা যে অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার! কে এর দায়িত্ব বহন করবে? তবে বিষয়টি কষ্টকর হলেও তা বাস্তবায়ন করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের জেনারেল সেক্রেটারি। যিনি ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের প্রাণপুরুষ সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানির দৌহিত্র এবং ফিদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানির সুযোগ্য সন্তান। যার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ভারতের সর্বমহলে স্বীকৃত। তার আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি, মত-পথ ভুলে এককাতারে সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতা ও উদ্যোগ তাকে পৌঁছে দিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। আজমিরের শান্তি সম্মেলন যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

মাওলানা সায়্যিদ মাহমূদ আস’আদ মাদানী দা.বা. এ পয়গাম নিয়ে একে একে গেলেন ভিন্ন ভিন্ন মাসলাক ও মাযহাবের সকল ইসলামী নেতার কাছে। হাতে হাত মিলিয়ে শক্তভাবে তা প্রতিহত করার সংকল্পের কথা জানালেন। তাদের কাছে বিষয়টি বোধগম্য ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো, তাই সবাই এক প্লাটফর্মে থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে তার প্রতিবাদ জানানোর জন্য মনস্থির করলো। সম্মিলিতভাবে তারিখ নির্ধারণ হলো।

203বিশ্ব মানবতার শান্তি ও মুক্তির মহান প্রেরণা নিয়ে তীর্থভূমি আজমির শরিফে অনুষ্ঠিত হল বিশ্ব শান্তি সম্মেলন। ভারতীয় মুসলমানদের অরাজনৈতিক সর্ববৃহৎ প্লাটফর্ম জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের উদ্যোগ ও আজমির দরবার শরিফের সহায়তায় শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। ভারতজুড়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হলেও সম্মেলনটি বিশ্বজুড়েই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ফেসবুক, টুইটার ছাড়াও ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচার হয় অনুষ্ঠানটি। খাজা মইনুদ্দীন চিশতি (র.)-এর দরবারকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে যে বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে এ সম্মেলনের মাধ্যমে দেওবন্দি ধারার আলেমদের সঙ্গে তাদের একটি সুসম্পর্ক ও ঐক্যের ভিত স্থাপিত হল। সর্বভারতীয় মুসলমানদের অংশগ্রহণে এ সম্মেলন সাড়া জাগিয়েছে বিশ্বজুড়ে। জমিয়ত ও আজমির শরিফের দ্বায়িত্বশীলরা ছাড়াও মঞ্চে বেরেলভি, হিন্দু, শিখসহ ভিন্ন ধর্ম ও মতাবলম্বী নেতাদের উপস্থিতিতে সম্মেলনটি এক ভিন্নরূপ ধারণ করেছিল। আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে এমন ঐতিহাসিক উদ্যোগ ব্যাপক দূরদর্শিতা ও উদার প্রমাণ বহন করে।

সম্মেলন শুরুর আগের দিন জমিয়ত নেতৃবৃন্দ ও দেওবন্দি আলেমরা আজমির শরিফে পৌঁছালে দরবারের বর্তমান গদিনশীল ও প্রধান খাদেম সাইয়্যেদ মঈন সরদার চিশতি, মাজার সেক্রেটারি ওয়াহিদ হুসাইন চিশতি, আঞ্জুমানে গদিনশীন পীর আরিফ হুসাইন চিশতি তাদের স্বাগত জানান। এ সময় তারা জমিয়ত নেতাদের আজমির শরিফের ঐতিহ্যবাহী লাল পাগড়ি পরিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী অভ্যর্থনা জানান। জমিয়ত নেতারা তাদের নিয়ে হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (র.)-এর মাজার জিয়ারত করেন। জিয়ারত শেষে জমিয়ত নেতৃবৃন্দ মাজার কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য মতাদর্শের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। সে বৈঠকে চূড়ান্ত হয় শান্তি সম্মেলনের প্রস্তাবনাবলী।

বেরেলভি, রায়লভি ও বদরপুরীসহ অন্যান্য মতাদর্শের দায়িত্বশীলদের এ সময় জমিয়ত নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা সবাই মুসলিম ভাই ভাই। মতের ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা কেউ কারো শত্রু নই। পরস্পর হিংসা-হানাহানি ভুলে সবাই মিলে কাজ করলে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (র.) ইসলামের যে মানব প্রেমের দাওয়াত দিয়েছিলেন, তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। এ সময় আজমিরের পীর আরিফ হুসাইন চিশতি আবেগাপ্লুত হয়ে উর্দুতে বলেন, এ ঐক্য প্রক্রিয়া শুধু সাম্প্রদায়িক একতা নয়, বরং আল্লাহর বিশেষ রহমত।

202সম্মেলন শুরু হয় ১২ নভেম্বর দুপুরে। আজমির দরবার শরিফের ভেতরে অত্যাধুনিক প্যান্ডেলে প্রথম দিনের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনজুড়ে ছিল আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। সুসজ্জিত স্টেজ ও ডিজিটাল প্রজেক্টরের বিশাল বহর নজর কেড়েছে সবার। এদিন জমিয়তের বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করা হয় এবং ভারতীয় নেতৃবৃন্দই শুধু ভাষণ প্রদান করেন। এ ছাড়া শান্তি স্মারকসহ দুটি সম্প্রীতি স্মারকের মোড়কও উন্মোচন করা হয়। ১৩ নভেম্বর আজমির দরবার শরিফের বাইরের খোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বশান্তি সম্মেলনের সমাপনী ও মূল অধিবেশন। বিশাল ময়দানে জনতার স্রোত নামে। জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। জমিয়ত সভাপতি কারি সাইয়্যিদ উসমান মানসুরপুরী, কলকাতা জমিয়ত সভাপতি ও মন্ত্রী মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ, দেওবন্দের মজলিসে শূরার রুকন রহমত উল্লাহ কাশ্মীরি, ভারতের সেন্ট্রাল শরিয়া কাউন্সিলের সেক্রেটারি মাওলানা মাজউদ্দিন আহমদ, দেওবন্দের সিনিয়র মুহাদ্দিস সালমান বিন্নুরীসহ প্রত্যেক প্রদেশের সভাপতিরা বক্তব্য রাখেন। এ অধিবেশনে জমিয়ত সেক্রেটারি মাওলানা মাহমুদ মাদানি বিশ্বশান্তি সম্মেলনের প্রস্তাবনা পাঠ করেন। বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা ও দেশ থেকে আগত অতিথিরাও এ সময় বক্তব্য প্রদান করেন। আজমির শরিফের প্রধান খাজা আরিফ হুসাইন চিশতি, বেরেলভি প্রধান তাওকির রেজাখা, হিন্দু ধর্মীয় গুরু চখস্পতি পণ্ডিত, স্বামী গুরু মহারাজ ঠাকুর প্রমুখ বক্তব্য দেন। সবার বক্তৃতায় পারস্পরিক সম্প্রীতির বিষয়টি জোরালোভাবে ওঠে আসে। সম্মেলনে মোট আটটি প্রস্তাবনা পেশ করা হয়। পরধর্ম ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতিও বেশ জোর দেয়া হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ১২০ জন ইসলামিক স্কলার ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি জমিয়ত সভাপতি কারি উসমান মানসুরপুরীসহ অতিথিদের হাতে লাখো আলেমের স্বাক্ষরিত জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী ঐতিহাসিক ফতোয়ার প্রতীকী কপি হস্তান্তর করেন। জমিয়তের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদবিরোধী ঐতিহাসিক ফতোয়ার জন্য তাকে অভিনন্দন জানান হয়। লাখো জনতার সবান্ধব উপস্থিতিতে ১৩ নভেম্বর রাত ১০টায় কারি সাইয়্যিদ উসমান মানসুরপুরীর শান্তি প্রস্তাবনা পাঠ ও মোনাজাতের মাধ্যমে ঐতিহাসিক বিশ্ব শান্তি সম্মেলন সমাপ্ত হয়। সব দল-মতের মিলনে ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হল গোটা বিশ্ব। আজমির শরিফে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলন অশান্ত পৃথিবীকে শান্তির পথ প্রদর্শন করুক, শান্তির আবহ ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়।

সুত্র:আ/যু/ফে।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...