শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ দুপুর ১২:২৬
Home / আকাবির-আসলাফ / শায়খুল হাদীস আল্লামা মুজ্জাম্মিল শায়খে বায়মপুরী রাহ.

শায়খুল হাদীস আল্লামা মুজ্জাম্মিল শায়খে বায়মপুরী রাহ.

আকাবির-আসলাফ – ৩৫

মাওলানা শফীকুর রহমান দরবস্তী :

বাংলাদেশের আধ্যাতিক রাজধানী সিলেট জেলার খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের সন্নিকটে ক’জন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আল্লামা মুজ্জাম্মিল সাহেব রাহ.। যাঁকে বিজ্ঞমহল যুগের কাশ্মীরীতে ভূষিত করেছিলেন।

জন্ম ও বংশ পরিচিতি
শায়খুল হাদীস আল্লামা মুজ্জাম্মিল সাহেব রাহ.। ১৯০৯ ইংরেজি ১৩২৯ হিজরীতে এক দ্বীনদার, সুশিক্ষিত ও অভিজাত খান্দানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ক্বারী মুহাম্মদ আলীম সাহেব রাহ.। মাতা মুছা. হাফিজা ছুফিয়া বেগম রাহ.। উভয়ই ছিলেন দ্বীনদার ও পরহেজগার। অতি অল্প বয়সেই আল্লামা মুজ্জাম্মিল হক সাহেব রাহ. পিতৃহারা হন, ফলে মায়ের তত্ত্বাবধানেই তিনি লালিত পালিত হন। আল্লামা রাহ. এর মাতা ছুফিয়া বেগম রাহ. বাংলা, উর্দূ ভাষায় শিক্ষিতা ছিলেন। শৈশবে স্বীয় মাতা ছিলেন তার উস্তায। মরহুম আল্লামা রাহ. মাত্র সাত বছর বয়সে কুরআন শরীফ উর্দূ ও বাংলা ভাষা আয়ত্ব করতে সক্ষম হন। যেমন শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন মরহুম রাহ. এর স্বীয় বড় ভাই আল্লামা বায়মপুরী রাহ. তাঁর মাতার কাছ থেকে। গুণবতী জননীর পরিচালনা ও দোয়ার বদৌলতে আল্লামা মুজ্জাম্মিল সাহেব রাহ.’র ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি সু-প্রতিষ্ঠিত হয়।

শিক্ষাজীবন
প্রাথমিক শিক্ষা স্বীয় মাতা হাফিজা সুফিয়া বেগমের কাছ থেকে শুরু করেন। এরপর নিজ গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অতঃপর দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের জন্য লালারচক মাদরাসায় ভর্তি হয়ে সাফেলা ৩য় বর্ষ পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করেন। তারপর ঐতিহ্যবাহী কানাইঘাট ইসলামিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে শরহে জামী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে ঝিঙ্গাবাড়ী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে আলিয়া ৬ষ্ঠ বর্ষ পর্যন্ত পড়ে তখনকার সময়ে আসাম বোর্ডে পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত হন। ঐ সময় হতেই শুরু হয় পড়াশোনার সাথে তাঁর চিন্তা ও গবেষণা। কোথায় কিভাবে উচ্চ শিক্ষা লাভ করা যায় এবং ইলমে দ্বীন অর্জন করা যায় এই চিন্তাই সবসময় তার মনে জাগরূক ছিল। সে জন্য জ্ঞান পিপাসা মেটানোর জন্য চলে যান কলকাতা আলিয়া মাদরাসায়। সেখানে অত্যন্ত সুনামের সাথে কামিল তথা টাইটেল পাশ করে বৃত্তি পান। সেই মাদরাসায় বুখারী শরীফের উত্তরপত্রে প্রায় পঞ্চাশ পাতায় জবাব দিয়ে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তবে একটি জিনিস না বললে না হয় সেটি হলো, যে বর্তমান যুগের আলিয়া মাদরাসা আর তখনকার যুগের আলিয়া মাদরাসা মধ্যে রাত-দিন ব্যবধান ছিল। সে সময়ে আলিয়া মাদরাসায় কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস, হিকমত, মানতিক, ফলসফা প্রভৃতি বিষয় পড়ানো হতো। কিন্তু বর্তমানে সে বিষয়গুলো অতিরিক্ত সাবজেক্ট রেখে পশ্চিমাদের শিক্ষাকে আগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এবং লেবাস-পোষাক, আচার-আচরণ চলা-ফেরা সবকিছুই কুরআন হাদীসের বিপরীত চলছে।

কর্মজীবন
আল্লামা মুজাম্মিল সাহেব রাহ. কলকাতা মাদরাসায় টাইটেল শেষ করার পর ১৯৪০ ইং থেকে কানাইঘাট মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের যাত্রা। সেখানে কয়েক বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৪৮ সালে কোন বিশেষ কারণে চলে যান বগুড়া জেলার মুসতাকিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে সেখানে প্রায় ৪/৫ বছর শিক্ষকতা করার পর পুনরায় চলে আসেন দারুল উলূম দারুল হাদীস কানাইঘাট মাদরাসায়। আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী ১৯৫৩ ইংরেজিতে দারুল উলূম দারুল হাদীস মাদরাসায় হাদীস সূচনা করার সময় তিনিও উস্তায ছিলেন। বিশ্বস্থ সূত্রে জানা যায় যে, মরহুম রাহ. পড়ানোর সময় কোন দিন কিতাব মুতালা‘আ করা লাগেনি। সে বিষয়ে একটি ঘটনা হলো যে, আল্লামা বায়মপুরী রাহ. যখন দেখলেন যে আমার ছোট ভাই আল্লামা মুজ্জাম্মিল সাহেব রাহ. বাড়িতে কিতাব মুতালা‘আ না করে মাদরাসায় এসে পড়াচ্ছেন। সুতরাং বায়মপুরী রাহ. একদিন ঘোষণা করে দিলেন যে, আজ থেকে কেউ আমার মাদরাসায় পড়াতে হলে কিতাব মুতালা‘আ করে আসতে হবে। অন্যথায় বেতন নেওয়া হারাম হবে। এ কথা জানানোর পর সকলে মুতালা‘আ করে আসলেন। কিন্তু আল্লামা মুজ্জাম্মিল সাহেব রাহ. কিতাব মুতালা‘আ না করে আসলেন। একদিন আল্লামা বায়মপুরী রাহ. মাদরাসায় সকল আসাতিযায়ে কেরামদেরকে একত্র করলেন এবং এই বিষয়টি জানিয়ে দিলেন যে আমার ভাই কিতাব মুতালা‘আ করেন না। এ কথা শুনে আল্লামা মুজ্জাম্মিল সাহেব রাহ. বললেন, আমার কিতাব মুতালা‘আ করা লাগবে না, যদি কোন অসুবিধা হয় তাহলে বলুন, কোন কিতাবের কত নাম্বার পৃষ্ঠা থেকে পড়াবো। আল্লামা বায়মপুরী রাহ. বললেন, হাদীসের কিতাব মুসলিম শরীফের মুকাদ্দিমার কয়েক পৃষ্ঠার পর থেকে আরম্ভ করো। সাথে সাথে  মুসলিম শরীফ বের করে পড়ানো আরম্ভ করলেন। তাঁর স্বীয় ভাই আল্লামা বায়মপুরী রাহ. বাইরে থেকে পড়ানো শুনলেন এবং অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আপনার আর মুতালা‘আ করা লাগবে না। এই হলো আল্লামা মুজাম্মিল সাহেব রাহ. এর কর্মজীবনের একটি ঘটনা। এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে। মরহুম আল্লামা মুজ্জাম্মিল সাহেব রাহ. উলূমে আক্বলিয়া ও নক্বলিয়ার শীর্ষস্থানে অবস্থান করেছিলেন। তিনি একজন মুনাযিরে যমান ছিলেন। ইলমে ফারায়িযে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। আল্লামা মুজ্জাম্মিল সাহেব রাহ. পাঠদান-পদ্ধতি ছিলো অনন্য। একজন উস্তাযের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর মাঝে ছিলো। আর সূক্ষ্ম ও কঠিন ইবারত এবং মাসআলার ক্ষেত্রে এমনভাবে তাহক্বীক্ব করতেন যাতে সকল স্তরের ছাত্ররা তা আয়ত্ত করে বুঝে নিতে পারে। তাঁর প্রভাষণে এ বৈশিষ্ট্য ছিল পুরো মাত্রায়। আরবী, উর্দূ, ফারসী এবং বাংলা ভাষার উপর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিলো। তিনি একজন কুরআন ও হাদীসের আশিক ছিলেন এবং সুন্নতে নববীর পাবন্দ ছিলেন। জীবনের প্রতিটি কাজ হুজুর সা. যেভাবে করেছিলেন তিনি সেভাবে করার চেষ্টা করেছিলেন। মরহুম আল্লামা পবিত্র হজ্বের উদ্দেশ্যে দু’বার গিয়েছেন এবং হজ্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শের মূর্ত প্রতীক পার্থিব লোভ লালসা তাঁকে তাঁর আপোষহীন নীতি থেকে একটুও সরাতে পারেনি। শিয়া মওদুদী তথা বাতিলের বিরুদ্ধে তার বিশেষ অবদান ছিলো। তিনি দারুল উলূম মাদরাসায় দেড় বছর শায়খুল হাদীস ও মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। প্রায় দেড় বছর দারুল উলূমের মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস ছিলেন।

ইখলাস বা একনিষ্ঠতা
ইখলাস-এর অর্থ হল সকল কাজ-কর্মে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার রেযামন্দী বা সন্তুষ্টি লাভের প্রেরণা সঞ্চার হওয়া, অন্তরে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেরণা ছাড়া অন্য কোন লাভ-লোকসানের প্রতি খেয়াল না আসা।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহীম আ.-এর মুখ দিয়ে এভাবে ইখলাসকে প্রকাশ করেছেন, আমি একনিষ্ঠভাবে ঐ সত্তার দিকে মুখ ফিরিয়েছি, যিনি নভোম-ল ও ভূম-ল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (সূরা আনআম-৭৯ আয়াত, ৭ম পারা)
হযরত মুজ্জাম্মিল রাহ. তাঁর সমগ্র জীবনে এই ইখলাসকে নিজের চলার পথের আলোকবর্তিকারূপে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি কর্মে, প্রতিটি পদক্ষেপে এই ইখলাস বা একনিষ্ঠতাই তাঁকে বিরাম-বিশ্রামহীন সাধনা-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। ইবাদত-বন্দেগীতে তো অবশ্যই মু‘আশারাত ও মু‘আমালতে ও এই হানীফী ইখলাসই ছিল তাঁর দিশারী। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি কর্মে তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। অন্য কোন কারণ বা উদ্দেশ্য তা যতো মহৎই হোক না কেন, প্রশংসনীয় ও কল্যাণপ্রসু হোক না কেন তাঁকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়নি। তিনি তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মবহুল জীবনে এই সুরের মূর্ছনায় তন্ময় ও বিভোর হয়েছিলেন। এই সুরের টানে তিনি দারুল উলূম কানাইঘাটে দারুল হাদীছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুখারী শরীফের দরস দান করেছেন, আল্লাহ প্রেমিকদের মাঝে প্রেমের সুধা বিলিয়েছেন, প্রতিটি রাতে আঁধারে তাহাজ্জুদ নামায শেষে কচি শিশুর মত কান্নাকাটিতে এই সুর তাঁকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে।

ওফাত
আল্লামা মুজ্জাম্মিল সাহেব রাহ. ১৯৭৩ ইংরেজী মোতাবেক ১৩৭৯বাংলা আষাড় মাসের প্রায় ১৯ তারিখ রোজ সোমবার ফজরের পূর্বে তিনি নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তিন বিবি চার ছেলে চার মেয়ে সহস্র সহস্র বন্ধু-বান্ধব, ছাত্র ও ভক্তকে শোকসাগরে ভাসিয়ে মাওলার সন্নিধ্যে ইহজগৎ থেকে পর জগতে তাশরীফ নেন। ইন্নালিল্লাহি……………..। মৃত্যুর সময় বয়স ছিলো ৬৪ বছর। মরহুম রাহ. জানাযার ইমামতি করেছিলেন আল্লামা চটি হুজুর রাহ.। যিনি পরবর্তীতে ১৫ বছর দারুল উলূম মাদরাসার শায়খুল হাদীস ও মুহতামিম ছিলেন। আল্লামা মুজ্জাম্মিল সাহেব রাহ. কে দারুল উলূম মাদরাসার সম্মুখে তার স্বীয় ভাই আল্লামা বায়মপুরী রাহ. এর কবরের কাছে তাকে সমাহিত করা হয়।

আরও পড়ুন : আকাবির-আসলাফ – ৩৪। ইসলামী রাজনীতির স্থপতি আল্লামা আতহার আলী

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...