ফুজায়েল আহমাদ নাজমুল ::
সময় ও স্বপ্ন দুটি আলাদা বিষয় হলেও সময়ের সাথে স্বপ্নের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সময়ই স্বপ্ন দেখায়। মানুষের জন্মের সাথে সাথে সময়ের হিসাব শুরু হয়ে যায়। হ্যা, জন্ম নেয়া শিশু শুরুতেই কথা বলতে পারে না। উঠে বসতে পারে না। দাড়াতে পারে না। দৌড়াতে পারে না। ভাল মন্দ বুঝে না। স্বপ্ন দেখার যোগ্যতা রাখে না। তবে একদিন একদিন করে সময়ের চাকা যখন ঘুরতে থাকে তখন শিশুর বয়সও বাড়ে। কথা বলা শেখে। উঠে দাড়ায়। পাঠশালায় যায়। জীবন চলার পথে কোনটি প্রয়োজনীয় আর কোনটি অপ্রয়োজনীয় বুঝতে পারে। জ্ঞান, বুঝ, বুদ্ধি, বিবেক ধীরে ধীরে যখন বাড়তে থাকে তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। মানুষের জীবনে অনেকগুলো স্বপ্ন থাকে। ক্যারিয়ার গঠনে কেউ কুরআনের হাফেজ, কেউ আলিম, কেউ শিক্ষক, কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সময়ের স্রোতের সাথে স্বপ্নের মিছিল লম্বা হতে থাকে। এ মিছিলে কেউ বিজয়ী হতে পারে আবার কেউ বিজয়ী হতে পারে না।
‘সময়’ হচ্ছে মানুষের জীবনের অন্যতম একটি স্তম্ভ। যার সময় নেই তার জীবন নেই। সময়কে মাইনাস করে মানুষের জীবন হয় না। জীবনের স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ দিতে হলে সময়কে কাজে লাগানো ছাড়া কোন উপায় নেই। যারা সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগায় না তাদের জীবনে কোন স্বপ্ন পূরণ হয় না। পৃথিবীতে যারা বড় হয়েছেন, যারা নিজেকে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে গেছেন তারা কেউই সময়কে অকারণে হারাননি। জীবনে তারা সময়ের মূল্য দিয়েছেন। সময়কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহারের মধ্যদিয়ে লক্ষ্যে পৌছেছেন। সফল হয়েছেন। বিজয়ী হয়েছেন।
সময়ের অতীত আছে, বর্তমান আছে। আবার ভবিষ্যৎও আছে। শুরু আছে, শেষও আছে। শৈশবকাল, বাল্যকাল, কিশোরকাল, যৌবনকাল, বৃদ্ধকাল বয়সের এই সময়গুলো কারো জন্য অতীত আর কারো জন্য বর্তমান। আমরা যারা বেচে আছি সবাই ইতিমধ্যে কিছু কাল অতিক্রম করেছি। কিছু কাল আগত। আবার সময়ের পরিক্রমায় মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করার মধ্যদিয়ে পরকালের দিকে যাত্রা করবো।
মৃত্যুর সাথে সবাইকে আলিঙ্গন করতে হবে এ বিষয়ে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সারা দুনিয়ার মানুষ একমত। আমিও বলি নির্দিষ্ট সময়ে প্রত্যেকেরই মৃত্যু হবে এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আল কুরআনে বলা হয়েছে : “ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ মরতে পারবে না। প্রত্যেকের মৃত্যুর সময়টি সুনির্দিষ্ট রয়েছে।” – (আল ইমরান : ১৪৫)
সময়ের চাকা ঘুরছে আর আমার জীবন ছোট হয়ে আসছে। জীবনকে কাজে লাগাবার সময় আমার হাতে একেবারেই কম। যেকোন মুহুর্তে আজরাইল (আ:) চলে আসতে পারেন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে। জীবনের অনেক স্বপ্ন থেকেই যাবে কল্পনার ডায়েরিতে। আজরাইলের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে মায়ার এ ভূবন ছেড়ে। আজকে ফেলে আসা সময়ের গল্পগুলো পর্যালোচনায় আনা জরুরী। সাথে আগামীকে নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। কারণ, ক্ষুদ্র জীবনের স্বল্প সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে ইহকাল ও পরকাল জীবনের সফলতা আশা করা কঠিন।
কুরআনুল কারীমে সুরা আল আসরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সময়কে কাজে লাগাবার কড়া তাগিদ করেছেন। তিনি বলেন – “সময়ের শপথ! মানুষ বড় ক্ষতির মধ্যে আছে। কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে উপদেশ করে সত্যের এবং উপদেশ করে সবরের্।” এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সময়কে চারটি মৌলিক কাজে লাগাবার কথা বলেছেন। চারটির প্রতিটি দফাই ব্যাপক অর্থবহ। এসব কাজে আত্মনিয়োগ করে যারা সময়কে কাজে লাগাবে না, তারা নিশ্চিত ক্ষতি ও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে।
আবু যর (রা:) একবার মহানবীর (স:) কাছে জিজ্ঞেস করলেন – হযরত ইবরাহীম (আ:) এর প্রতি অবতীর্ণ গ্রন্থাবলীতে কি শিক্ষা ছিল? জবাবে মহানবী (স:) যে শিক্ষার কথা উল্লেখ করেন তার একটি অংশ হলো : “বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য হলো তার সময়কে ভাগ করে নেয়া। কিছু সময় সে ব্যয় করবে তার প্রভুর প্রার্থনায়। কিছু সময় ব্যয় করবে আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল বিষয়ে চিন্তা করে। কিছু সময় রাখবে আত্মসমীক্ষার জন্য। আর কিছু সময় ব্যয় করবে জীবিকার প্রয়োজনে।” – [ইবনে হিব্বান] এই হাদীসে সময়কে কাজে লাগাবার ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
বয়স যতই হোক না কেন, সময়কে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্যে পৌছতে হবে। লক্ষ্যহীন হলে চলবে না। সফলতার শেষ সীমানায় পৌছতে হবে। এজন্য প্রয়োজন জীবনের লক্ষ্য স্থির করা। নিজেকে কি বানাতে চাই। কোথায় নিয়ে যেতে চাই। কতটা উচ্চে উঠাতে চাই। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কতটা অবদান রাখতে চাই। স্রষ্টার কতটা সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে চাই। যদি জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই, সফল হতে চাই, বিজয়ী হতে চাই তাহলে প্রবল ইচ্ছা শক্তি নিয়ে কলম কাগজে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বার্ষিক, সাম্মাষিক, দ্বি-মাসিক, মাসিক, সাপ্তাহিক, দৈনিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ ও সময়কে ভাগ করে নিতে হবে। এ বছর কোন লক্ষ্যে পৌছবো। নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি,সমাজের প্রতি, স্রষ্টার প্রতি, সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য পালনে কতটুকু সময় ব্যায় করবো। প্রতিটি পরিকল্পনার লক্ষ্য মাত্রা ঠিক করতে হবে।
পরিকল্পনা নিয়েই শেষ নয়। বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট ইচ্ছা ও উদ্যোগ থাকতে হবে। সুশৃঙ্খল কাজের জন্য নিয়মিত ডাইরি মেনটেইন এবং ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে হবে। ‘দৈনিক রুটিন’ মোতাবেক কাজের তালিকা তৈরী করতে হবে। তালিকায় যে কাজগুলো গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরী, সেগুলোকে মার্ক করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে একবার মাসিক, প্রতি মাসে একবার দ্বি মাসিক, প্রতি তিন মাসে একবার সাম্মাষিক, ছয় মাসে একবার বার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে বসতে হবে। পর্যালোচনা করতে হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেসব বাধা রয়েছে সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। বাধাসমুহ উপড়ে ফেলার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সুপরিকল্পিত এ প্রক্রিয়ায় এবং সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহারের মধ্যদিয়ে জ্ঞানে, কর্মে, দক্ষতায়, চরিত্রে, উদারতায়, শৃংখলায়, সময়ানুবর্তিতায়, ইবাদতে, আল্লাহভীতিতে, বিনয়ে, ধৈর্যে, সেবায়, দূরদৃষ্টিতে, আচারে, ব্যবহারে, ব্যক্তিত্বে, বিশ্বাসে সবার সেরা হতে হবে। সব ধরনের যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে প্রতিদিন নিজেকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রতি মাসে অনেক দুর ছড়িয়ে যেতে হবে। প্রতি বছর অনেক সিড়ি পেরিয়ে যেতে হবে। সমাজে যারা বড় হয়েছেন এভাবেই হয়েছেন। সমাজকে যারা গড়েছেন এভাবেই গড়েছেন। সমাজকে যারা দিয়েছেন এভাবেই দিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে, আজকে যে সময়টা চলে যাচ্ছে সেটি আগামীকাল আর পাওয়া যাবে না। তাই আজকের কাজ আগামীকালের জন্য নয়, আজকেই করতে হবে। বার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পরিবারকে একটি আদর্শ পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জাহিলিয়াতের অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই সমাজটাকে একটি আদর্শ সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণময় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জীবনের স্বপ্নগুলোকে বিজয়ের চুড়ান্ত শিখরে পৌছে দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, জীবনে আমি সফল, আমিই সেরা।