শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ দুপুর ১:৫৬
Home / অনুসন্ধান / মুফতি শফীকে হযরত আতহার আলীর স্বীকৃতিবিষয়ক ঐতিহাসিক চিঠি
মাওলানা আতহার আলী ও মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ.

মুফতি শফীকে হযরত আতহার আলীর স্বীকৃতিবিষয়ক ঐতিহাসিক চিঠি

 মাওলানা আতহার আলী ও মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ.দেশের টক অব দ্যা কান্ট্রি এখন কওমী মাদরাসা শিক্ষাসনদের স্বীকৃতি। দেশের বেশিরভাগ মানুষই কওমী সনদ স্বীকৃতি হউক এটা কামনা করেন। আবার কিছু সংখ্যক লোক স্বীকৃতি চান না এমনও আছেন। স্বীকৃতির এই আন্দোলন নতুন কিছু নয়; বরং বৃটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই আমাদের আকাবিররা এই আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকে আবারো স্বাধীনতা লাভের পর ৯০-এর দশকে খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ থেকে শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক ও মুফতি ফজলুল হক আমিনী পর্যন্ত স্বীকৃতি আন্দোলনটি বেগবান হয়ে উঠে। কিন্তু স্বীকৃতি চাইলে কেন হওয়া চাই? বা না চাইলে কেন চাই না—এর বাস্তব ব্যাখ্যা জাতির সামনে তোলে ধরা প্রয়োজন।

শাইখুল ইসলাম হযরত আতহার আলী রহ. ১৯৬২ সালে আল মু’তামিরুল মাদারিসিল কাওমিয়া নামে অল পাকিস্তানে কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড  গঠন করে স্বীকৃতি আন্দোলন শুরু করেন। অতঃপর ১৯৭১ সালে তিনি তদানীন্তন নিখিল পাকিস্তানে স্বীকৃতি বিষয়ে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছিলেন। তিনি নিজে সেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। স্বীকৃতির বিষয়টি খোলাসা করে সেসময় তিনি মুফতি মুহাম্মদ শফীর রহ. কাছে একটি পত্র দেন। কওমীনিউজ পাঠকদের জন্য সেই পত্রটি ও এর উত্তর তোলে ধরা হলো—

পরম শ্রদ্ধেয় হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফী সাহেব (মুদ.),

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ

আশা করি কুশলেই আছেন। এ বিষয়ে আপনি ভালভাবেই অবগত আছেন যে, দেশের শিক্ষানীতিই দেশের দিক-নির্দেশনাস্বরূপ। বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক সরকার বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম সংশোধনের নিমিত্তে দু’টি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছে, যার প্রেক্ষিতে এখানকার উলামায়ে কেরাম আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে সরকার এয়ার ভাইস মার্শাল নূর খান প্রদত্ত শিক্ষানীতির উপর দেশের ৫৬ জন উলামায়ে কেরামের পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে দু’টি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে উপস্থাপিত প্রস্তাবসমূহ গ্রহণ করে নেয় এবং সঠিক দিক-নির্দেশনার জন্য নিজেদের নির্বাচিত বিশিষ্ট প্রতিনিধিদেরকে দু’টি কমিটিতেই অন্তর্ভুক্ত করে।

অতীত অভিজ্ঞতা হলো এই যে, সরকার সাধারণত উলামায়ে কেরামের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায়ও প্রভাবিত হয় না। বর্তমানে উলামায়ে কেরামের জন্য সার্বিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে—সমস্ত কওমী মাদরাসার ধারক-বাহকরা একটি স্বাধীন বোর্ড গঠন করে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের কাছ থেকে এর স্বীকৃতি আদায় করে নেবে। কেননা, এটি ছাড়া সরকার তাদের মূল্যবান পরামর্শের কোনই গুরুত্ব দিবে না। কওমী মাদরাসাসমূহের সমন্বয়ে গঠিতব্য এ বোর্ড তিব্বী বোর্ড , কমার্স এসোসিয়েশান এবং শিল্প কোম্পানী ইত্যাদির মতো নিজেদের নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে স্বাধীন থাকবে। তবে নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থে সরকারের নিকট থেকে এর স্বীকৃতি নিবে। কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে উলামা প্রতিনিধি দল বিদেশে পাঠানো, বিদেশ থেকে আগত প্রতিনিধি দলের সাথে উলামাদের সাক্ষাৎ ও আলোচনার ব্যবস্থাকরণ, কিংবা শিক্ষাবোর্ড  গঠন এবং শিক্ষাবিষয়ক পরামর্শ গ্রহণ, সর্বোপরি ইসলামী গবেষণা ও আইন প্রণয়ন ইত্যাদি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে সরকার তাদেরকেই অগ্রাধিকার দেন যারা সরকার স্বীকৃত ডিগ্রিধারী। অথচ এদের দ্বারা দ্বীন ও জাতির উপর মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসে, আর সরকারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ স্বাধীন বোর্ডের স্বীকৃতি লাভের পর সরকার আর কওমী মদারাসাসমূহের উলামায়ে কেরামকে অবজ্ঞা করতে পারবে না।

মোটকথা, বর্তমান অবস্থা এবং সময়ের চাহিদা হচ্ছে এই যে, সমগ্র পাকিস্তানের কওমী মাদরাসাসমূহের জন্য একটি কেন্দ্রীয় বোর্ডের স্বীকৃতি কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আদায় করে নেয়া। এতদুদ্দেশ্যে এখানকার মাদরাসা পরিচালকবৃন্দের এক বিশেষ সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, সমগ্র পাকিস্তানের জন্য নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে ১১ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড গঠন কর হোক—

১. মাওলানা এহতেশামুল হক সাহেব
২. মুফতি মুহাম্মাদ শফী সাহেব
৩. মাওলানা ইউসুফ বিন্নুরী সাহেব
৩. মাওলানা শামছুল হক আফগানী সাহেব
৫. মুফতি মাহমুদ সাহেব
৬. মুফতি দ্বীন মুহাম্মাদ খান সাহেব
৭. মাওলানাআবদুল ওয়াহহাব সাহেব
৮. সিদ্দিক আহমদ সাহেব
৯. মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন সাহেব
১০. মাওলানা বজলুর রহমান সাহেব
১১. মাওলানা আতহার আলী (আহ্বায়ক)

এ বোর্ডের কার্যক্রমের এ বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কওমী মাদরাসার ধারক-বাহকরা সবাই যেন স্বেচ্ছায় ও সানন্দে এ ঐক্যের পতাকা তলে সমবেত হতে পারেন এবং আমাদের কোন কার্যক্রমে কারো কোন প্রকার শুবাহ-সন্দেহ সৃষ্টি করতে না পারে। উক্ত কমিটিতে কোন পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের প্রয়োজন মনে করলে অথবা বিশেষ কোন পরামর্শ থাকলে জ্ঞাত করানোর জন্য অনুরোধ রইল।

দুআ প্রার্থী—
মুহাম্মদ আতহার আলী
কনভেনার, মজলিসে মাদারিসে কাওমিয়া
১৪ জুন ১৯৭১, মোতাবেক ১৮ রবিউস সানী ১৩৯১ হিজরী।

নোট: সত্ত্বর উত্তর দানে বাধিত করবেন। এ পত্রের কপি বোর্ডের প্রত্যেক সদস্যের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে।

……

জবাব

বিসমিহি তায়ালা

২৮ রবিউস সানী ৯১ হিজরী, রোজ মঙ্গলবার

আমাদের সম্মানিত নেতা (দা.),

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।

গতকাল কার্গো মারফত আপনার পত্র পৌঁছেছে। অদ্যই উত্তর লিখেছি। গতকাল পূর্বে প্রাপ্ত আরেকটি পত্রের উত্তর লিখেছি। সমগ্র পাকিস্তানভিত্তিক শিক্ষা কমিটি গঠন করার যে প্রস্তাব প্রেরণ করেছেন তা অত্যন্ত সমীচীন ও উত্তম । এতে যাঁদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে আমিও তাতে একমত। আশা করি প্রস্তাবিত ব্যক্তিবর্গ  যদি মিলেমিশে বসেন এবং আন্তরিকভাবে কজ করেন, তাহলে আমরা অনেক কিছুই পেতে পারি। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি যে, এ কমিটি তার কার্যক্রম বর্তমান সময়ে আরম্ভ করবে কি-না? কারণ, বর্তমান রাষ্টীয় নাজুক পরিস্থিতি চিন্তা-ভাবনার সকল পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে। জানা নেই যে, আগামী দিন অবস্থা কি রূপ ধারণ করবে। এজন্য কখনো মনে হয়—শিক্ষার মতো বিষয়ে মৌলিক ও গঠনমূলক পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এখন নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিষয়টি পরিষ্কার হয়। আবার কখনো মনে হয় যে, এ সুযোগে যদি কোন কাজ করে নেয়া যায় তাহলে আগামীতে তা কাজে আসবে ।

এ কমিটি গঠনের প্রেক্ষাপটে বর্ণনা করেছেন, সরকার একটি শিক্ষা কমিটি গঠন করেছে যাতে উলামায়ে কেরামের অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। আমি মনে করি যে, এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কেননা, এ কমিটি কোন স্থায়ী কমিটি নয়। এর দ্বারা মৌলিক কোন কোন কাজ নেয়াও উদ্দেশ্য নয়। শুধু সামরিক স্থবিরতা দূর করে কাজ চালিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ। আমার মনে হয়, রাষ্ট্রীয় কমিটি তখনই গঠিত হতে পারবে যখন এ সরকার কতদিনের তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর যাতের হাতে ক্ষমতা আসবে তারা পূর্বে গঠিত কমিটি কেনই বা বহাল রাখবে?

বর্তমান কমিটিতে জামায়াতে ইসলামী ব্যক্তিদের প্রাধান্য কোন আশ্চর্যের বিষয় নয়। কারণ, তারা খুব চতুর আর আমরা খুব পেছনে। তারা সরকারের সাহায্যের কথা বলে অগ্রসর হয়েছে তখন, যখন সরকারের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। আর আমাদের উলামায়ে কেরাম এ সময় নীরব ভূমিকা পালন করছেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সহায়তায় যারা সামান্যতমও এগিয়ে এসেছে। যাহোক, সরকারের তাদের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন ছিল। যারা পেছনে রয়ে গেছেন, সরকার যদি তাদের পেছনে ফেলে রাখে তাহেলে কোন অভিযোগ করার সুযোগ নেই। কাজেই নিজেদের অবস্থা শোধারানোর চিন্তা করতে হবে। তবেই ইনশাআল্লাহ কেউ ক্ষতি করতে পারবে না।

তোমরা যদি আল্লাহর (দ্বীনের) সাহায্যে এগিয়ে আস তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন। (আল কোরআন)

বর্তমানে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমীচীন মনে হয় না। শুধু কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে দুয়া করতে হবে, যেন আল্লাহ তায়ালা আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের এ বিষয়ের উপর মজবুত করে দেন যে, দেশে ইসলামের নিদর্শনাবলী মাথা উঁচু করে থাকে। আন্তর্জাতিক চাপ অথবা সাময়িক দুর্বলতা আঁচ করে যেন এমন কোন পদক্ষেপ না নেয়া হয়, যা চিরতরে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় অথবা পুনরায় ইসলাম ও ইসলামের নিদর্শনাবলী উজ্জীবিত হওয়ার সুযোগই না পায়। বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে উক্ত বিষয়ে আমার আশংকা হচ্ছে। এজন্য নতুন কোন পদক্ষেপের সাহস হচ্ছে না। আমার এই মতামত সম্পর্কে মাওলানা সিদ্দিক আহমদ সাহেব এবং মুফতি দ্বীন মুহাম্মদ সাহেব দুজনকে অবশ্যই অবহিত করে পরামর্শ নেয়া হোক। অতঃপর পদক্ষেপ নেয়া হোক।

ওয়াসসালাম।
দুআ প্রার্থী—
অধম মুহাম্মদ শফী

কওমী নিউজের সৌজন্যে

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...