ফাহিম বদরুল হাসান ::
‘জাতিটি মারাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল’-এই ট্যাগ মুসলিমদের উপর সেঁটে আছে বেশ ক’বছর ধরে। অবশ্য এই ট্যাগের শতভাগ মালিকানা মুসলিমদের হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। আল্লাহ, রাসুল কিংবা ইসলাম-সংশ্লিষ্ট কিছু নিয়ে কুৎসা রটনা বা অপমানজনক কিছু করলে মুসলিমদের খুনে আগুন ধরে। অন্য ধর্মালম্বীরা এসবে তেমন নজর দেয় না।
অবশ্য অনুভূতিতে আঘাত অনুভূত হওয়া একান্তই ব্যক্তিগত। কেউ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখাক না দেখাক, মুসলিমরা সেটা দেখাবেই। কারণ, মুসলিমদের বিশ্বাসের অংশ হচ্ছে আল্লাহ, রাসুল এবং ইসলাম সংশ্লিষ্ট সবকিছুর সম্মান রক্ষা করা তথা-হিফাযাতে ইসলাম। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিক্রিয়ার ধরণটা কী হবে? প্রতিবাদের ভাষাটা কেমন হবে?
ক’দিন পূর্বে (০২.০৯.১৬) সিলেটে জুম’আর নামাজের সময় স্থানীয় ইসকন মন্দিরে মাইকে গান বাজানো নিয়ে উত্তেজনার এক পর্যায়ে ‘হিন্দু-মুসলিম’ ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। অভিযোগ করা হয়, একদল মুসলিম ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে মন্দিরে হামলা করে ভাংচুরসহ বেশ ক্ষতি করে। দু মাসের মাথায় আবার গত রোববার (৩০.১০.১৬) ফেসবুকে পবিত্র কাবার ছবির উপর হিন্দু দেবতা বসানোকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘ব্যাপক’ হাঙ্গামা হয়ে যায়। বরাবরের মতো মিডিয়ার সেই একই নিউজ- ‘ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে হিন্দুদের বাড়িঘর, মন্দির সহ মূর্তি ভাংচুর এবং ব্যাপক লুটপাট’।
এসব ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর যার যার অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করেন। কেউ এসব আঘাতকে ধর্মানুভূতিতে আঘাতই মনে করেন না। যেমন, কাবার ছবিতে দেবতার ছবি- এটাকে স্রেফ ছবি হিসেবেই দেখতে চান। তাদের বলতে শোনা যায় ‘কাবার ছবি কাবা নয়, তাই ছবির অপমানে কাবার অপমান হয় না’। তাদের এই বিশ্লেষণও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কারণ, তাদের কথার পিঠে কথা চলে আসে- ‘কাবার ছবি যদি কাবা না হয়, তাহলে মূর্তিও ভগবান নয়। মূর্তি ভাঙলে ভগবানের কী?’
সরকার এবং বিরোধী রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা থেকে এসবকে ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি’ বলে চালাতে থাকেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিশ্লেষণ হচ্ছে, ধর্মীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইস্যুকে বিশালাকার বানিয়ে একদল হুজুগে মুসলিম অতিরিক্ত আবেগে এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে। অনেকে এসব কর্মকাণ্ডের সাথে ইসলামের যোগসূত্র নেই বলে কুরআন হাদিসের কোটেশন দিতেও দেখা যায়। বলতে দেখলাম- ‘যদি সত্যিই তারা মুসলমান হত তাহলে তো তাদের জানার কথা যে বিদায় হজের ভাষণে হযরত মুহম্মদ সা. স্পষ্ট বলেছেন, একজনের অপরাধে সেই ব্যক্তির পুরো সম্প্রদায়কে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।
হাদিসে আছে, যুদ্ধরত নয় এমন বিধর্মীদের কোনো ক্ষতি করা চলবে না। বরং শান্তিপ্রিয় বিধর্মীকে নিরাপদে তার ঘরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব একজন মুসলমানের উপরেই বর্তায়’। যারা যেভাবেই এসব ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করেন না কেন- এসব যে ধর্মীয় উন্মাদনা, এটাতে সুশীল, প্রগতিশীলসহ অধুনা সবাই একমত এবং ইসলাম বিষয়ে অজ্ঞতার কারণেই প্রতিক্রিয়ার এমন হাঙ্গামাময় বহিঃপ্রকাশ, এতেও প্রায় সবাই সম্মত।
ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশে সকল ধর্মের নিরাপদ সহাবস্থান সবাই চায়। কিন্তু মুখের চাওয়ার সাথে আসলেই মনের চাহিদার মিল আছে? একদিকে বলা হয়, কেউই এমন উন্মাদনা চায় না; অন্যদিকে, যে কারণে উন্মাদনার সৃষ্টি হয় বলে বিশ্বাস করা হয়, সেই ধর্ম-অজ্ঞতা দূরীকরণও চায় না তারা। বরং ধর্মশিক্ষাকে দিন কে দিন জাদুঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিমির থেকে তিমিরতর পথে যাচ্ছে, ভবিষ্যত প্রজন্ম। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের বর্তমান ধর্মশিক্ষাকে ধর্মশিক্ষা বলা হলে এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা এরকম ভাঙচুর আর হাঙ্গামাকে নৈতিক দ্বায়িত্ব বলে চালিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করবে না।
বাস্তবে এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে জাতিকে পরিত্রাণ দিতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে ধর্মশিক্ষাকে অত্যাবশ্যকীয় করার কথা সকলে বলতো। উঠে পড়ে লেগে যেতো ধর্মের শিক্ষায় জাতিকে শিক্ষিত করতে। যাতে করে, ‘কীসে অন্যের অনুভূতিতে আঘাত হানে’ সেটা আঘাতকারী বুঝে এবং ‘কীসে আঘাত পাওয়া উচিত’ সেটা আঘাতপ্রাপ্তও বুঝে। এরকম না করে উল্টো পথে হাঁটতে দেখলে, ধর্মানুভূতিতে আঘাত-পাল্টা আঘাতের মাধ্যমে এবং ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার যে অভিযোগ তোলা হয়- সেটা জাতির কাছে আরো প্রবলতর হয়ে ওঠে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক, নবকণ্ঠ।