আজ থেকে আড়াই বছর আগে লিখেছিলাম গল্পটি।
ডায়রী খুলে পড়ছিলাম। আমার চোখ ছলকে উঠলো। এক রাক্ষুসে ক্যান্সারের গল্প। আমার চেনা একটি গ্রামের স্কুলের দহিত এক নিস্পাপ পুস্প কলিকে নিয়ে গল্পটি লিখেছিলাম। উল্লেখ্য, “মুসলিম নন্দিনীর জীবন সফর” সিরিজ উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে কতদিন যাবত অন্য কিছুতে হাতই ধরতে পারছি না। আজ এই গল্পটা ছেপে দিলাম।
________________________
দহিত ফুলকলি…..
জিকরা একটি ছোট্ট খুকি। বাবুই পাখির বাসার মত চুল। চেহারা গোল। হাসলে একটি গঁজদন্ত বেরিয়ে পড়ে, তখন আরো মায়া লাগে। না চঞ্চল না শান্ত।
ঠোঁটের কোণে সব সময় হাসিখুশি লেগেই থাকে।
আজ স্কুল ফেরার পর থেকে তার মন খারাপ। বাচ্ছাদের মন লাগাতার দু’তিন ঘন্টা খারাপ থাকার কথা না। এর ভেতরে বাড়িঘরে আসার পর মন ভাল হওয়ার জন্য অনেক কিছুই ঘটে যায়। হ্যাঁ কানামাছি, গোল্লাছুট, পুকুরে সাঁতার, সারা দিনের ভেতর কত কিছু সাথীরা খেলেছে, কিন্তু কিছুতেই কারো সাথে খেলতে যায়নি জিকরা। চোখের পাতা ভারি ভারি করে তাকিয়েছে শুধু। কাল থেকে আর স্কুলেই যাবে না সে। বুবুর সাথে ওর খুব মিল। কথাটা সাফ সাফ বলে দিয়েছে বুবুকে। মিল থাকলেও কেন যাবে না সেটা বলতে পারে নাই। বলতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। ভ্যাক ভ্যাক করে কেঁদে দিয়েছে। “নাঁ বুবুঁ না আঁমি কতি পাঁরবঁনাঁনেঁ…”
কি ব্যাপার, এমন কঠিন অভিমান কিসের। যাবেই না। বই পত্র ছিড়ে ফেলতে চেয়েছে। বুবু ধরে বেঁধে আটকিয়েছে।
রাত। বাবা সারাদিন কাজ করে সদাই নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আগে দু’মুঠো খাবেন। তার আগে জিকরা গামছা দিয়ে নিজ হাতে বাবার হাত মুখ মুছে দেবে। আঙুল ধরে ধরে খেতে বসাবে। আকুলি বিকুলি করতে করতে সারাদিনের ইতিবৃত্ত শুনাবে।
কিন্তু কই, জিকরাকে তো দেখছেন না তিনি। ঘরে ঢুকে একবার নজরে পড়েছিল। তাও আবার সলাজ বিবর্ণ, বেশ ভারাক্রান্ত ছোট্ট মুখখানি।
পাক ঘরের মেঝোয় মাদুর পেতে খেতে বসেছে সবাই। জিকরা খাবেও না। আস্তে আস্তে জিকরার অভিমান প্রকট হচ্ছে। কিন্তু কেউ বুঝতেই পারছে না তাদের ছোট্ট সোনামনিটা এতো রূঢ়তর অভিমান কেন করছে।
প্রতিটা ঘরে ঘরে কিছু না কিছু কচি কচি ফুল আছে। ফুলগুলো পাপড়ী মেলেনি, মোলায়েম সতেজ স্বরবৃত্তের ডালি নিয়ে মাত্র ফুটছে তারা। সমাজে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু ঘটে যায় তাদেরকে গিরে, ফলে তাদের নিস্পাপ পাপড়িতে টাচ লাগে। ইষত্ কালচেভাবে দাগ পড়ে যায়। সে দাগের সমিকরন বাইরে ভেতরে কাঁপিয়ে তুলে তাদেরকে। এই দাগগুলোর ব্যাথা কিংবা লজ্জা কিভাবে সইতে হয় ফুলেরা সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, কিভাবে কইতে হয় তাও বুঝতে পারে না, এটা কি নিয়ম তাও বুঝতে পারে না, এটা কি অনিয়ম তাও বুঝতে পারে না। বাচ্ছাগুলোর বোধ বিশ্বাসের রেখাপথে সমাজের যে ছায়া এসে পড়ে সে ছাঁয়ায় তারা তাদের পাখনা মেলে। উড়তে থাকে। পাখির মত, প্রজাপতির মত, সাদা মেঘের মত, আসমানির মত। তাদের ছাঁয়াপথে যত মানুষ নেমে আসে সবাইকে তারা খেলার সাথী ভাবে, উড়ার সাথী ভাবে, ঘুরার সাথী ভাবে।
এই সাথীদেরকে পেলে আরো সুবিন্যস্ত করে পেখম মেলে তারা। এই খেলার ছলে তাদেরকে যারা শিখাতে থাকে, বর্ণের বাহারী গুচ্ছতা। তারপর শব্দের আলপনা এঁকে রাজপুরীতে নিয়ে যায়। সেখানকার যত সভ্যতা আছে আস্তে আস্তে তাদের খোঁপায় ফুলের মত গুজে দেয়। ওদেরকে সাজায়, বুঝায়, হাসায়, কাঁদায়, মাতায়। পরম আদর্শে গড়ে তুলে। তারা আস্তে আস্তে কৈশোরে সমর্পিত হয়। যুবতী হয়। পুরো পাপড়ী খুলে তারপর তারা পৃথিবীকে সুভাস বিলায়। আর আমরাই হই আদর্শ গুরু। অথবা গরু!
গরু?
আর যখন ওদের ছাঁয়াপথে মানুষ নামে না। ভুল করে নেমে যায় পশু। ওরা থর থর করে কেঁপে উঠে। দুঃস্বপ্নে দুঃস্বপ্নে কেঁপে উঠে ফুলগুলো। ওদের পরিপাট মুখ জুড়ে নেমে আসে অনিহার ছাপ। গরু বলে ই তো এমন হয়। যেমন হল জিকরার। ওর কচি মানসপট জুড়ে যে ভয়াবহতা ছাপ ফেলেছে, কে মুছে দেবে এই অভিশাপটুকু।
জিকরার বাবা মেয়েকে ছাড়া কখনো খান না। কোনোমতে দু’মুঠো গিলে উঠে পড়েছেন। বুকের সাথে জড়ায়ে ধরে জানতে চাচ্ছেন “কিরে মা লক্ষি মা আমার বাবাকে বল কি হয়েছে? হু হু করে কেঁদে উঠে আট/নয় ছুঁই ছুঁই অবুঝ শিশুটি। “বাবা ও বাবা তুমি তো আমাকে আদর করো, পানু স্যারও তাই করে। কিন্তু বাবা, পানু স্যার আমাকে তারপর কেন এভাবে আদর করলো, স্যার যেন আরো কি ভা বে… আমার খুউউব ….”
তারপর বাবার বুকে মুখ গুজে ফুপাঁতে থাকে জিকরা। আর একটি কথাও যুগায় না তার বিক্ষত কন্ঠে। বাবাও কাঁদেন, বাবার কান্না আকাশ ছুঁয়ে যায়। অন্তর্যামীর আরশের তলে আছড়ে পড়ে একজন বাবা আর একজন কন্যা সন্তানের আর্তনাদ।
সমাজ ! তুমি ভালো হয়ে যাও। লজ্জাকাতর বাবা আর মেয়ে ইজ্জতের ভয়ে কিছু বলতে পারছে না তোমাকে। অন্তর্যামী কিন্তু ঠিকই পারবে। সব জানে। চিনে। কখন যে ধরে ফেলবে তোমায়।