আকাবির- আসলাফ – ৩৪
রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক আলেমেদীন, যোগ্য সংগঠক এবং এ দেশের ইসলামী রাজনীতির মহান স্থপতি ও পথিকৃৎ আল্লামা আতহার আলী রহ.।
আ. ক. ম. আশরাফুল হক ::
হযরত আতহার আলী রহ. ১৮৯১ সন মোতাবেক ১৩০৯ হিজরী সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার গোঙ্গাদিয়া গ্রামের এক ধর্মপরায়ণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে, তার পূর্ব পুরুষগণ উত্তর ইরান থেকে প্রাচীন মুসলিম শাসকদের আমলে সিলেটে এসে বসবাস করেন। তিনি নিজ এলাকাতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর মুরাদাবাদের কাসেমিয়া মাদরাসায় ও রামপুর মাদরাসায় বিভিন্ন শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর সাহারানপুর ও পরে বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তঁর উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী, পাকিস্তানের অন্যতম প্রবক্তা মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী ও জাফর আহমাদ উসমানীর মত প্রমুখ মনীষীগণ। শিক্ষা সমাপ্তির পর আতহার আলী রহ. উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী সংস্কারক, আধ্যাত্মিক সাধক ও হাজারের অধিক গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর রহ. কাছে আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ লাভ ও রূহানী তাযকিয়াহ তারাক্কি অর্জন করেন এবং তার থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
উস্তাদদের প্রতি যে তার কত গভীর শ্রদ্ধা ছিল, তাদের পবিত্র স্মৃতি নিজের অন্তরে জাগরুক রাখার জন্যে পুত্রের নাম আনোয়ার শাহ এবং দাদা পীর হাজী এমদাদুল্লাহ মহাজিরে মক্কীর রহ. নামে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম জামিয়া ইমদাদিয়া নামকরণ থেকেই তা সহজে অনুমেয়।
দেশে ফিরে আল্লামা আতহার আলী ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি সিলেট এবং কুমিল্লার জামিয়া মিল্লিয়া (বর্তমানে কাসেমুল উলূম) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়াসহ একাধিক মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। অতঃপর কিশোরগঞ্জের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা ও পরে ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হন এবং একজন পীর হিসাবে ইসলামের যাবতীয় শিক্ষা আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। তখন তিনি ইসলামী আন্দোলন তথা রাজনীতির ফাউন্ডেশন বা প্রাথমিক স্তর বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন এবং মানুষকে এরশাদ ও নসীহতের মাধ্যমে ধর্মপরায়ণ করে তোলেন, জায়গায় জায়গায় মাদরাসা মক্তব স্থাপন করেন। ফলে তাকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জ এলাকায় একটি সুন্দর ইসালামী পরিবেশ গড়ে উঠে। তার খ্যাতি বাইরের অন্যান্য জেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে।
আল্লামা আতহার আলীর শিক্ষাজীবন যেসব মহামনীষীর সংস্পর্শে অতিবাহিত হয়ে ছিল, তারা যেমন ছিলেন ইসলামী বিশেষজ্ঞ, উঁচু স্তরের পণ্ডিত ও জ্ঞানতাপস, তেমনি ছিলেন বিশ্ব পরিস্থিতির ব্যাপারেও সচেতন এবং ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে ও রাজনীতিতে যাদের ছিল সক্রিয় পদচারণা। তার উস্তাদদের মধ্যে শাব্বীর আহমাদ উসমানী, জাফর আহমাদ উসমানী, আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী এবং আধ্যাত্মিক গুরু আশরাফ আলী থানবী রহ., যারা অবিভক্ত ভারতের আজাদী আন্দোলনের ত্যাগী ও সংগ্রামী সিপাহসালার ছিলেন। ফলে শিক্ষকদের প্রভাবে হযরত আতহার আলীর মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রজীবন থেকে রাজনৈতিক ভাবধারা ও সচেতনতার উন্মেষ ঘটেছিল।
আর যেহেতু পরাধীন ভারত থেকে ইংরেজ উৎখাত আন্দোলন ও ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূম দেওবন্দ, সেহেতু এর শিক্ষানবীশ পরিবেশটাও ছিল রাজনৈতিক ভাবধারায় আচ্ছন্ন। ফলে সে পরিবেশে অধ্যয়নের সুবাধে তখন থেকে তার মধ্যেও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার উম্মেষ ঘটে। তার এই চিন্তা-চেতনা ও সচেতনতা উত্তরকালে দেশ, জাতি ও ধর্মের মহান কল্যাণ সাধনে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে আনে। বস্তুত তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা নিজের শিক্ষা পরিবেশ ও তৎকালীন রাজনৈতিক পারিপার্শিকতা থেকে উদগত।
বৃটিশবিরোধী আজাদী আন্দোলন যখনই গতি সম্পন্ন হচ্ছিল, ভারতের জনগণ তখনই দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ছিল। (ক) মুসলিম দল (খ) হিন্দু দল। অর্থাৎ খণ্ড ভারত আর অখণ্ড ভারতের দুটি দলে। হিন্দুরা চেয়েছিল ইংরেজরা যেভাবে প্রায় দুইশত বছর মুসলমানদের শোষণ ও নির্যাতন চালিয়েছে, ভারতকে অখণ্ড রেখে মুসলমানদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বিনাশ করে ঠিক সেভাবে আজীবন তাদের শোষণ ও নির্যাতনের বন্দবস্ত করা। এতে ইংরেজদেরও সায় ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় ও মঙ্গলীয় আর্যদের এই নীলনকশায় বাঁধ সেধে বসে ছিল আপামর সচেতন মুসলিম জনগণ। আর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ছিলেন কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী, আল্লামা আযাদ সোবহানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আল্লামা আতহার আলী ও মাওলানা সৈয়দ মোসলেহ উদ্দীন প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। যে ভাবনার দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উদ্যোক্তা ছিলেন হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. ও আল্লামা ইকবাল রহ.।
আতহার আলী রহ. ১৯৪৫ সনে বঙ্গীয় ওলামা-মাশায়েখদেরকে নিয়ে নিখিল ভারতীয় ওলামা কনফারেন্সের আয়োজন করেন। ২৫ মে কলিকাতা মোহাম্মাদ আলী পার্কে আল্লামা আযাদ সোবহানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে মাওলানা শাববীর আহমাদ উসামানীকে প্রধান করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম গঠিত হয়। এই ঐতিহাসিক মহাসম্মেলন আয়োজনে আরো যেসব বঙ্গীয় ওলামায়েকেরামের অনবদ্য অবদান রয়েছে, তারা হলেন মাওলানা নেসার উদ্দীন আহমাদ (পীর সাহেব শর্ষীনা), মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন, মুফতী দ্বীন মুহাম্মাদ খাঁ ও মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.।
অতঃপর আল্লামা আতহার আলী পৃথক মুসলিম আবাসভূমি তথা পাকিস্তান কায়েমের লক্ষ্যে সমগ্র ভারতবর্ষ চষে বেড়ান ও প্রধান প্রধান শহরসমূহে সভা-সম্মেলনের আয়োজন করেন, বক্তৃতা দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন এবং মুসলমানদের মাঝে ঐক্যের প্রাচীর তৈরি করেন। তিনি মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক সিমলা কনফারেন্স ও বাংলার প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, মাওলানা আকরম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন ও তাজুদ্দীন খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুক হক কর্তৃক পঠিত প্রস্তাব প্রণয়নে তার অবদান ছিল সিংহভাগ। এবং তা তিনি করেছিলেন মুর্শিদ মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর রহ. বিশেষ ইঙ্গিতে। লাহোর প্রস্তাব ঘোষণার ঐতিহাসিক সেই ছবিতে শেরে বাংলার পাশেই আল্লামা আতহার আলী ছিলেন।
আর সিলেট রেফারন্ডমে যারপরনাই ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ সিলেট আজ বাংলাদেশের অংশ। যেহেতু সিলেট তার জন্মভূমি। তাই সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হবে না! বিষয়টি স্বভাবতই তার পক্ষে মেনে নেয়া ছিল দুস্কর। তাই তিনি উত্তর প্রদেশের পাশাপাশি সিলেট রেফারন্ডমে পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা পালন করেন। তাতে তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন রহ. এবং তাতে পাকিস্তানের পক্ষে সকল আলেম, রাজনীতিবিদগণ ও সমাজ সচেতন নাগরিকবৃন্দ বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
অবশেষে বহু প্রত্যাশিত সেই দিবসটি আসল। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম কায়েমের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ১৪ আগস্ট ৪৭ সালে কায়েম হল পাকিস্তান। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একইসঙ্গে স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করলে পাকিস্তান আন্দোলনে দুই অগ্রসৈনিক সিপাহসালার আল্লামা আতহার আলীর দুই উস্তাদ মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী ও মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী।
সৃষ্টি হলো ইতিহাস। শুরু হলো নতুন দিনের যাত্রা। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট, বিতর্ক। ইংরেজ বেনিয়াদের মানসিক উত্তরসূরি আমলা ও ওজির-ওজারাদের বিপত্তির কারণে কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ প্রতিশ্রুত ইসলামী নেজাম কায়েমে হলেন ব্যর্থ। ইতোমধ্যে সাধারণ জনগণের চাপে এবং মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানীর বলিষ্ট নেতৃত্বের কাছে পরাজিত হয় মুসলিম লীগ অনীহা সত্ত্বেও ১৯৪৯ সনে ইসলামী হুকুমাত কায়েমের লক্ষ্যে একটি আদর্শ প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য হয়। কিন্তু এরইমাঝে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ও আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী দুইজনেই ইন্তেকাল করায় মুসলিম লীগে ঘাপটি মেরে থাকা ইসলামবিরোধী মহলটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং ইসলামী নেজাম কায়েমের লক্ষ্যে আদর্শ প্রস্তাবের পরবর্তী ধাপ হয়ে বাধাগ্রস্ত। জাতি আবার পতিত হয় হতাশার তিমিরে। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ আলেমই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত হয়ে যার যার কর্মক্ষেত্র মসজিদ, মাদরাসা ও খানকায়ে নির্দিষ্ট হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় আতহার আলী রহ. ইসলাম কায়েমের মহান ব্রত নিয়ে নিজ উস্তাদের অসামাপ্ত কাজকে আঞ্জাম দেয়ার লক্ষ্যে ভারতবর্ষে সুলতান শিহাবুদ্দীন ঘুরির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
এই উপমহাদেশে আলেমদের রাজনৈতিক তৎপরতার গৌরবময় অতীত রয়েছে। ঔপেনিবেশিক শাসনবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে তাদের রয়েছে গৌরজ্জোল ইতিহাস, ঐতিহ্য। এতদসত্বেও ইংরেজ শাসনের শেষমধ্য পর্যায় থেকে বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে আলেমদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা স্তিমিত হয়ে পড়ে। ১৮৫৭ সনে বিপ্লবের পর থেকেই রাজনীতির উত্তাপ থেকে নির্লিপ্ত থাকার মনোভাবের সূত্রপাত হয়। অতঃপর খেলাফত আন্দোলন ও ১৯৪৫ সনে কলকাতা মোহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত ওলামা কনফারেন্সের পর থেকে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ঝিলিক দেখা গিয়েছিল মাত্র। সুষ্ঠুভাবে ধারাবাহিক কোন রাজনৈতিক তৎপরতা তাদের ছিল না। যদ্দরুন পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরপরই মুসলিম লীগ যখন ইসলামী হুকুমাত কায়েম করতে ব্যার্থ হল। তখন আলেমরা কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেন না।
বস্তুত তা ছিল বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে আলেম সমাজের মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক স্থবিরতার বহিঃপ্রকাশ। রাজনীতিকে অনেকেই মনে করতেন তাকওয়ার খেলাফ। পার্লামেন্টের সঙ্গে মসজিদ, মাদরাসা ও খানকার হুজুরদের আবার কি সম্পর্ক? এ রকম একটা ভাব মাত্রই ছিল বিরাজমান। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনীতিবিদরা এ মনোভাবটাকেই কাজে লাগাতে চেয়েছে এবং এখনও চাচ্ছে। অন্যদিকে কোন কোন আলেমের কাছেও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও ইসলামী রাজনীতি উভয়ই ছিল সমান। রাজনীতি মাত্রই তাদের কাছে দুনিয়াদারী বিবেচিত হত। এহেন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মাঝে আল্লামা আতহার আলী রহ. এ দেশে নিয়মতান্ত্রিক ইসলামী রাজনীতির ধারা প্রবর্তন করেন।
আতহার আলী রহ.-এর একান্ত প্রচেষ্টা এবং মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন রহ.-এর সহযোগিতায় ১৯৫০ সনের ১৮, ১৯ ও২০ ফেব্রুয়ারী ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মাছিহাতায় (মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন রহ.-এর নিজ বাড়ীতে) সাবেক পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কাউন্সিল এবং ওলামা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এদেশে ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রথম সক্রিয় উদ্যোগ ছিল এই কনফারেন্স। যাতে সর্বমহলে আলেম-ওলামা শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবিসহ সাধারণ জনগণের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী। যা থেকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নতুন প্রত্যয় ও অঙ্গীকার নিয়ে ইসলামী নিজাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। উক্ত কনফারেন্সে শর্ষিনার মরহুম পীর সাহেব মাওলানা নেসার উদ্দীন রহ. ও আল্লামা আতহার আলী রহ.-কে যথাক্রমে সভাপতি ও কার্যকরী সভাপতি এবং মাওলানা শেখ আব্দুর রহীম (প্রফেসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)-কে মহাসচিব করে ৫২ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের কমিটি গঠন করা হয়। যার অন্যতম সদস্য ছিলেন আল্লামা রাগেব আহসান (সহ-সভাপতি), মাওলানা ফজলুল হক (পীর পাকুরীয় শরীফ, রংপুর সহ-সভাপতি), মাওলানা আব্দুল আজিজ, (খেলীফা, থানবী রহ. নোয়াখালী, সহ-সভাপতি), মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন (সহ-সভাপতি), ড. সৈয়দ নোমান যায়দী, ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ, মাওলানা ফয়জুর রহমান, (পরবর্তীতে এম.পি) ও মাওলানা মঞ্জুরুল হক (পরবর্তীতে এম.পি) প্রমুখ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, মণীষীগণ। শুরু হয় ইসলামী শাসন কায়েমের আন্দোলনের নব সূচনা। যোগ হয় নতুন যাত্রা। ধারণ করে নিয়মতান্ত্রিক ও ধারাবাহিক রাজনৈতিক পরিগ্রহ।
আল্লামা আতহার আলীর পরপরই তদানিন্তন সমস্ত পাকিস্তানব্যাপী ইসলামী শাসন কায়েমের আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দিয়ে ঝটিকা সফর শুরু করেন। গুরুত্বপূর্ণ ও বড় বড় শহরগুলোতে বিরাট বিরাট সভা-সম্মেলন আয়োজন করেন। সর্বস্তরের লোকজনকে উক্ত আন্দোলনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন এবং আদর্শ প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধান প্রণয়ন না করার দায়ে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তোলেন। যার মধ্যে ৫০ থেকে ৫২-এর ভেতরে সিলেট ও করাচিতে দুটি জাতীয় পর্যায়ের ইসলামী কনফারেন্সের আয়োজন করেন। যা থেকে পরবর্তীতে প্রণয়নকৃত ইসলামী সংবিধানের ২২ দফা রূপরেখা বা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল। সর্বোপরি ৫২ সনের মার্চের ১৮, ১৯, ও ২০ তারিখে কিশোরগঞ্জে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের কনফারেন্স আহবান করে আতহার আলী রহ.। দেশের গণমানুষের দাবি ও শ্লোগান ‘আমরা চাই নেজামে ইসলাম’ অনুসারে নেজামে ইসলাম পার্টি গঠন করেন। প্রথম সভাপতি ও সেক্রেটারী নির্বাচিত হন আল্লামা আতহার আলী রহ. নিজে এবং তার অন্যতম সহযোগী মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন রহ.। অতঃপর দলীয় দাবী ও শ্লোগান অনুযায়ী এবং পার্লামেন্টারী দলের নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে তার দল।
এবার আতহার আলী রহ. শুরু করলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির নামে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েমের রাজনৈতিক কর্মসূচী। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম লীগের বর্তমান নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশে ইসলামী নেজাম কায়েম করা কখনও সম্ভব হবে না। অতএব, তিনি মুসলিম লীগের সরকার পতনের ডাক দিলেন এবং ৫৩ সনে নেজামে ইসলাম দিবস পালনের আহ্বান করলেন।
৫০ সনে মাছিহাতার, ৫১ সনে করাচীতে, ৫২ সনে হয়বতনগরে (কিশোরগঞ্জে), ৫৩ সনে ঢাকায় ইসলামী কনফারেন্সগুলো অত্যন্ত সফলভাবে আয়োজন করে আল্লামা আতহার আলী দেশের সর্বস্তরের আলেম-ওলামা, শিক্ষাবিদ ও ইসলামী বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি প্রকাশ করেন। যা প্রণয়নেও আতহার আলী রহ.-এর অবদান সিংহভাগ।
ইসলামী নেজাম কায়েমের লক্ষ্যে তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচীর পাশাপাশি লেখনি ও প্রচার মাধ্যমের দ্বারা হুকুমাতে ইসলামিয়ার পক্ষে সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ‘ইসলামী শাসন কেন চাই’ এ নামে সর্বপ্রথম একখানা ছোট্ট বই লিখেন। বাংলা ভাষায় এ ধরনের এটাই ছিল সর্বপ্রথম কোন বই। পরবর্তী পর্যায়ে ‘নেজামে ইসলামের আলোতে’ ও ‘ইসলামী জীবন দর্শন’ নামে আরো দুখানা বই তিনি রচনা করেন। বই তিনখানা ইসলামী রাজনীতির সূচনা পর্বের জন্য খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল। অতঃপর হযরত আতহার আলী ‘নেজামে ইসলাম’ নামে সাপ্তাহিক এবং ‘নাজাত’ নামে দৈনিক পত্রিকা দুটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। পত্রিকা দুটি সেদিন ইসলামী নেজামপন্থীদের বিরাট সহায়ক হিসাবে কাজ করেছে।
ইসলামী হুকুমত কায়েমের লক্ষ্যে আতহার আলী রহ.-এর সার্বিক সক্রিয় এ তৎপরতা সেদিন ইসলামের দিকে জনগণকে দারুনভাবে উদ্বুদ্ধ করে। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও কর্ম তৎপরতা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। আর তাই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ চৌধুরী মোহাম্মাদ আলী তার নিজ দল তেহরিকে এসতেহকামে পাকিস্তান দলটি বিলুপ্তি করে নেজামে ইসলাম পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। কুমিল্লার আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমাদ, সৈয়দ মঞ্জুরুল আহসান ও মাওলানা সাখাওয়াতুল আম্বিয়া, মাওলানা আশরাফ আলী ধরমণ্ডলী, খতীবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমাদ, আদালত খাঁর মত প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটেছিল নেজামে ইসলাম পার্টিতে।
ইসলামী নেজাম কায়েমের লক্ষ্যে আল্লামা আতহার আলী সেদিন সমস্ত বিরোধী দল থেকেই সম্মতি ও সমর্থন আদায় করেছিলেন এবং তিনি শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, মাওলানা ভাষানীর আওয়ামী মুসলিম লীগ, (সোহরাওয়াদী) ও খেলাফতে রাব্বানী পার্টি নিয়ে ৫৪ সনে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করেন। ফলে ৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনে ‘হক- আতহার-ভাষাণী’ ফ্রন্টের কাছে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে।
পক্ষান্তরে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ব্যবধানে বিজয় হয়। সে নির্বাচনে নেজামে ইসলাম পার্টির প্রাদেশিক পরিষদে লাভ করে ৩৬টি আসন এবং কেন্দ্রে পায় ৪টি। পূর্ব পাকিস্তানে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে ভাষাণী, সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলে অবস্থান নেয়। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী সভায় নেজামে ইসলাম পার্টির পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী শিক্ষামন্ত্রী, অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দীন আহমাদ আইনমন্ত্রী এবং অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমাদ কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী।
সংসদে নেজামে ইসলাম পার্টির আসন সংখ্যাধিক্যের হিসাবে তেমন বেশী না হলেও আল্লামা আতহার আলী রহ.-এর ব্যক্তিত্বের দরুন সেখানে নেজামে ইসলাম পার্টির প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নেজামে ইসলাম পার্টির সংসদ সদস্য এবং আতহার আলী রহ.-এর আশির্বাদপুষ্ট চৌধুরী মোহাম্মাদ আলীর প্রধানমন্ত্রীত্বে নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় সরকার গঠন এবং ৫৬ সনের ইসলামী শাসনতন্ত্র বিল পাশ করান ও অনুমোদনের মাধ্যমে। যে সংবিধানের বদৌলতে পাকিস্তান হয়েছিল একটি কল্যাণমুখী ইসলামী প্রজাতন্ত্র। আল্লামা আতহার আলী সবচেয়ে বড় সাফল্য সংসদে ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন এবং পাশ করণ। এ ছিল তার অনন্য অমর কীর্তি। যা ছিল হাজার বছরের মুসলিম আশা-আকাঙ্ক্ষার ও শত চেষ্টার চূড়ান্ত সফলতা। যা তার হাতেই পেয়ে ছিল পূর্ণতা এবং বাস্তবরূপ।
আতহার আলী রহ. আইয়ূব খানের ইসলামবিরোধী পারিবারিক আইনসহ যাবতীয় ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড ও মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে ৬৫ সনে তাকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করেন। সেসময় তিনি সমস্ত বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে মুহতারামা ফাতেমা জিন্নাহকে একমাত্র প্রতিদন্ধি মনোনীত করেন এবং দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা চালান। কারচুপির কারণে নির্বাচনে আইয়ূব খান বিজয়ী হবার পর সর্বপ্রথম আতহার আলী রহ.-কেই কারারুদ্ধ করা হয়। ৬৫ সনের পাক-ভারত যুদ্ধ শেষের সামান্য পূর্বে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
৫৯ সালে কিছু বিপথগামী এবং দিল্লী ও মধ্যপন্থী কিছু রাজনৈতিক দল যখন ৫৬-এর ইসলামী সংবিধানের বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে ছিল, তখন তিনি শারীরিক অক্ষমতা ও বার্ধ্যক্যজণিত অসুস্থতা সত্ত্বেও ৫৬- এর সংবিধান পুনরুদ্ধার আন্দোলনে বলিষ্টভাবে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু আইয়ূব মার্শাল ‘ল’-এর দশকে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অনেক মজবুত ভিত গড়ে নিয়েছে। ফলে অনিবার্যভাবে ৭০-এর নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের পেছনে হঠতে হয়েছে এবং ইসলামবিরোধী ও সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রপন্থী দলগুলো বিজয়ী হয়েছে। এরিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের স্বৈরতন্ত্রের কারণে শুরু হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। অবশেষে অনেক রক্তের বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরাচারীদের কবল থেকে ৭১ সনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
কিন্তু আওয়ামী কর্তৃপক্ষও আইয়ূব খানের মত মাওলানা আতহার আলীকেই সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করল। ফলে তাকে বিনা কারণে ৭১ থেকে ৭৪ পর্যন্ত প্রায় তিন বছর কারা ভোগ করতে হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। অত্যধিক পরিশ্রম দীর্ঘ কারাভোগ এবং বয়সের ভারে নূব্জ্যমান হওয়ার কারণে তার স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। অতঃপর প্রায় দুই বছর বার্ধ্যক্যজনিত রোগ ভোগের পরে ৭৬ সনের ৫ অক্টোবর ইহজগত ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তার মত মহান নিঃস্বার্থ কর্মবীর ও মর্দে মুজাহিদের অভাব এদেশের ইসলামী রাজনীতির অঙ্গনে কখনো আর পূরণ হওয়ার নয়। আল্লাহপাক তার সৎকর্মপরায়ণতা এবং ইসলাম কায়েমের সার্বিক প্রচেষ্টা কবুল করুক এবং তাকে অশেষ জাযায়ে খায়ের দান করুক। এই মর্দে মুজাহিদের ইসলাম কায়েমের কর্মতৎপরতা আগামী দিনে ইসলামী রাজনীতিতে প্রেরণ জোগাবে যুগে যুগে।
লেখক: সম্পাদক, কওমীনিউজ