এহতেশামূল হক্ব ক্বাসেমী,
ইসলাম শাশ্বত, সত্য, স্বভাবজাত ও বাস্তববাদী ধর্ম। ইসলামের প্রতিটি বিধান অত্যন্ত যৌক্তিক ও বাস্তবমুখী। চির সুন্দর,সহজ-সরল ও সর্বোপযোগী।
ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান হচ্ছে, নামায। আল্লাহপাক যা নবীজী (সা.)কে মি’রাজের রাতে পুরস্কার হিসেবে দিয়েছিলেন। নামায মহান প্রভুর দরবারে দীনতা,
নিয়ামতরাজির প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং তাঁর শাহী দরবারে বান্দার নানাবিদ চাহিদা পূরণের মিনতি জানানোর মাধ্যম। ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামায। তাই ঈমানের পরে, সকল ইবাদতের ঊর্ধ্বে তার স্থান। যে নামায কায়েম করল, সে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করল। আর যে নামায ধ্বংস করল, সে দ্বীন ধ্বংস করল। অর্থাৎ- যার নামায ঠিক তার দ্বীন ঠিক। আর যার নামায বরবাদ তার দ্বীন বরবাদ। অতএব, যে ব্যক্তির নামায যত সুন্দর হবে, তার দুনিয়া-আখেরাতের যিন্দেগীও তত সুন্দর ও সফল হবে। তবে নামাযের এ অসীম গুরুত্বের পাশাপাশি শরীয়তের আরেকটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। আর তা হচ্ছে, সকল ক্ষেত্রে সহজীকরণ। আল্লাহ পাক সাধ্যাতীত নির্দেশ দেন না, বরং যা সহজ তাই আল্লাহর নিকট প্রিয়।
ইরশাদ হয়েছে- لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا অর্থাৎ- “আল্লাহ তাআলা সাধ্যের বাহিরে কোন দায়িত্ব কারও উপর চাপিয়ে দেন না”। (সূরা বাকারা, আয়াত নং-২৮৬)। ইরশাদ হয়েছে- يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ অর্থাৎ- “আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য কঠিন করতে চান না”। (সূরা বাকারা, আয়াত নং-১৮৫)। অতএব, অবহেলা প্রদর্শন না করে নামাযের প্রতি পূর্ণ মর্যাদা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা যেমন আবশ্যক, তার সাথে নামাযকে সাধ্যাতীত না করে, বরং সহজ করে দেখাও আবশ্যক। এ দু’য়ের মাঝেই রয়েছে সীরাতে মুস্তাকীম। এই মৌলিক আলোচনার পর চেয়ারে বসে নামায আদায়ের কয়েকটি বিধান নিচে তুলে ধরা হল-
১. কিয়াম, রুকু ও সিজদা- নামাযের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; যা নামাযের রুকন বা ফরযের অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি এই রুকনগুলো সঠিকভাবে আদায় করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও অবহেলা করে ছেড়ে দেয় বা চেয়ারে বসে ইশারায় নামায আদায় করে, তার নামায আদায় হবে না। আর কেউ যদি কোন রুকন প্রকৃতপক্ষেই আদায় করতে সক্ষম না হয় বরং শরীয়তের দৃষ্টিতে সে মাযুর সাব্যস্ত হয়, তাহলে সে এ রুকনটি ইশারার মাধ্যমে আদায় করে নিবে। এতে তার নামায পরিপূর্ণ বলে গণ্য হবে এবং সে পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে। ( দ্র. রদ্দুল মুখতার; ১/৪৪২)।
হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাযি.) বলেন- كانت بي بواسير فسألت النبي صلى الله عليه وسلم عن الصلاة فقال صل قائما فإن لم تستطع فقاعدا فإنلم تستطع فعلى جنب (সহীহ বুখারী; হাদীস নং- ১১১৭)
২. সুতরাং কেউ যদি দাঁড়াতে সক্ষম না হয়, কিন্তু মাটিতে বসে সিজদা করতে সক্ষম, তাহলে তাকে মাটিতে বসে সিজদা করে নামায আদায় করতে হবে। চেয়ারে বসে ইশারা করে রুকু আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রাহ.) বলেন- ولايصح الإيماء بهما – ( الركوع والسجود) – مع القدرة عليهما، بل شرطه تعذرهما۔
৩. তবে যে ব্যক্তি দাঁড়াতেও সক্ষম না এবং জায়নামাযে বসে সিজদা করতেও সক্ষম না, চেয়ার বা নীচে বসে ইশারার মাধ্যমে সিজদা করা ছাড়া তার উপায় নেই, এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিধান হল, যথাসম্ভব জায়নামাযে বসেই ইশারা করার চেষ্টা করবে। এটাই উত্তম। কারণ বৈঠকে অধিক বিনয় প্রকাশ পায় এবং বৈঠক সিজদার নিকটবর্তী অবস্থান। তবে কেউ যদি নীচে বসতে সক্ষম না হয়, কিংবা এতে তার অধিক কষ্ট হয়, এমন ব্যক্তির জন্যে চেয়ারে বসে ইশারায় নামায আদায় করতে কোন বাধা নেই। নিঃসন্দেহে তার নামায বিশুদ্ধ ভাবে আদায় হয়ে যাবে। ইমাম আল মারগীনানী (রাহ.) বলেন- والأفضل هو الإيماء قاعدا ، لأنه أشبه بالسجود (আল- হিদায়া- ১/১৬২)।
হযরত ইবনে আবী লায়লা (রাহ.) রর্ণনা করেন- عن عطاء قال في صلاة القاعد يقعد كيف شاء (মুসান্নাফু ইবনি আবী শায়বা ৬/৬৬, হাদীস নং- ৮৮৭৩)।
ইমাম সারাখসী (রাহ.) বলেন- والمصلى قاعدا تطوعا أو فريضة بعذر يتربع ويقعد كيف شاء من غير كراهة إن شاء محتبيا وإن شاء
متربعا لأنه لما جاز له ترك أصلالقيام فترك صفة القعود أولى. (جـ 1 صـ 902) ৪. যে ব্যক্তি দাঁড়াতে এবং বসতে সক্ষম কিন্তু সিজদা করতে সক্ষম না, সিজদা তাকে ইশারায় করতে হয়। এমন ব্যক্তির জন্য কিয়ামের ফরয আদায়ের লক্ষ্যে দাঁড়ানো আবশ্যক, না বসে নামায পড়লেও নামায আদায় হবে? এতে দু‘টি মত রয়েছে।আমাদের হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ মত হল, তার জন্য দাঁড়ানো আবশ্যক নয়; বসে পড়লেও তার নামায আদায় হয়ে যাবে।তবে অনেকের অভিমত হচ্ছে, যতটুকু সম্ভব দাঁড়িয়ে কিয়ামের ফরয আদায় করতে হবে। তারপর সম্ভব হলে রুকু করবে।তারপর তার জন্য দুটি পন্থা রয়েছে, যে কোন একটি অবলম্বন করতে পারবে। এক. বসে ইশারার মাধ্যমে সিজদা আদায় করা। ইহা উত্তম। দুই. দাঁড়িয়ে ইশারার মাধ্যমে সিজদা আদায় করা। তখন সিজদার জন্য মাথাকে রুকুর চেয়ে একটু বেশী নিচু করবে। وعن أبي جعفر الطحاوي : ولو قدر على بعض القيام ولو قدر آية أو تكبيرة يقوم ذلك القدر وإن عجز عن ذلك قعد، وإن لم يفعل ذلك خفتأن تفسد صلاته، هذا هو المذهب، ولا يروى عن أصحابنا خلافه، وكذا إذا عجز عن القعود وقدر على الاتكاء أو الاستناد إلى إنسان أو حائطأو وسادة لا يجزئه إلا كذلك. ولو استلقى لا يجزئه উভয় মতানুসারে বসার ক্ষেত্রে জায়নামায বা নীচে বসা আবশ্যক, নাকি চেয়ারে বসতে পারবে? এ বিধানটি তিন নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে। (দ্র. রদ্দুল মুহতার- ২/৯৮, ইলাউস সুনান; ৭/১৯৮ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা)। ৫. এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কে সক্ষম, কে অক্ষম, কে মাজুর বা কতটুক মাজুর এবং কে মাজুর না, সে বিষয়টি নির্ণয় করা। এ ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, বয়স্ক এবং প্রকাশ্যে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের অপারগতা সম্পর্কে অনেকটা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যদি এ সংক্রান্ত মাসআলা তাদের জানা থাকে। তবে এমন অভিজ্ঞ ব্যক্তি খুবই কম রয়েছেন।তাই উত্তম পন্থা হচ্ছে, নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ মুফতি সাহেবদের শরণাপন্ন হয়ে জেনে নেয়া। আর যারা বাহ্যিকভাবে সুস্থ, কিন্তু বিশেষ রোগের কারণে বিশেষজ্ঞ বিশ্বস্ত ডাক্তার তাদেরকে রুকু সিজদা করতে নিষেধ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও মাজুরের হুকুম প্রযোজ্য হবে। তবে তাদের জন্যও উচিত হবে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বিজ্ঞ মুফতিদের শরণাপন্ন হওয়া।
৬. আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যারা সঠিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চেয়ারে বসে নামায পড়ার অনুমতি পেয়েছেন বা চেয়ার ব্যতীত যাদের কোন বিকল্প নেই, তারা মসজিদে গিয়ে চেয়ারে বসে নামায পড়বেন, নাকি মসজিদের শোভা নষ্ট হবে এই অজুহাতে মসজিদ ছেড়ে ঘরে নামায আদায় করবেন? এ ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিতে সঠিক মত হল, তারা মসজিদে গিয়েই জামাতে শরীক হয়ে নামায আদায় করবেন, যদিও তারা চেয়ার ব্যবহার করতে বাধ্য। কারণ, ফরয নামায আদায় করার আসল রূপই হচ্ছে, মসজিদে গিয়ে সবাই মিলে জামাত করে নামায আদায় করা। সম্মিলিতভাবে বন্দেগী করা ও দাসত্ব প্রকাশ করা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয়। তাই মসজিদের জামাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এ বিষয়ে একাধিক আয়াত ও অসংখ্য হাদীস রয়েছে। যেমন- وَارْكَعوا مَعَ الرَّاكِعِينَ (সূরা বাকারা: ৪৩) وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ ( সূরা শুআরা-
২১৯)। عن أبي هريرة : أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: والذي نفسي بيده لقد هممت أن آمر بحطب،فيحطب، ثم آمر بالصلاة، فيؤذن لها،ثم آمر رجلا فيؤم الناس، ثم أخالف إلى رجال، فأحرق عليهم بيوتهم، والذي نفسي بيده لو يعلم أحدهم، أنه يجد عرقا سمينا، أو مرماتينحسنتين، لشهد العشاء (সহীহ বুখারী : হাদীস নং-৬৪৪)
عن أبي هريرة، قال : أتى النبي صلى الله عليه وسلم رجل أعمى، فقال: يا رسول الله، إنه ليس لي قائد يقودني إلى المسجد، فسأل رسول اللهصلى الله عليه وسلم أن يرخص له، فيصلي في بيته، فرخص له، তাই যারা জামাতে উপস্থিত হতে পারে, তাদের জন্য এর বিকল্প নেই। কেননা মসজিদের নামাযে যে প্রাণ থাকে, ঘরের নামাযে সেটা থাকে না। তাছাড়া এ ধরণের বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ রোগীর কষ্ট করে জামাতে উপস্থিত হওয়া, অন্যদেরকে মসজিদে গিয়ে জামাতে শরীক হতে উৎসাহী করবে এবং গাফেল লোকদের মসজিদমুখী হতে প্রেরণা যোগাবে। তাই এমন লোকদের মসজিদের জামাতে উপস্থিতি আল্লাহ তাআলা, ফেরেশতা ও সকল সৃষ্টির কাছে পছন্দনীয়। তবে যারা আন্তরিকতার সাথে এ ধরনের লোকদের মসজিদে গিয়ে চেয়ারে বসে নামায পড়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করেন তাদের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, তাদের অপছন্দের উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্য। যা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এর উত্তরে বলব, অপারগতা ও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য অবৈধতার কারণ নয়। অর্থাৎ- মানুষ যা করতে বাধ্য, যা না হলে মানুষের জন্য কষ্টের কারণ হবে, এমন বিষয়ে সাদৃশ্যের বিধান প্রযোজ্য নয়। কারণ এ সকল বিষয় কারো সাদৃশ্য গ্রহণের জন্য করা হয় না, বরং প্রয়োজনে করা হয়। তাই এগুলোকে সাদৃশ্যের কারণে হারাম বলা যাবে না। তাছাড়া মূল রহস্য বা কারণ না বুঝে শুধু সাদৃশ্য দেখেই যদি ঢালাওভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়গুলিকে হারাম বলে দেওয়া হয়, তাহলে খাওয়া-দাওয়াসহ জীবন ধারণের অনেক মৌলিক বিষয়ও তার আওতায় চলে আসবে। কারণ, এসব বিষয় মৌলিকভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর এ সব হারাম হয়ে গেলে মানব জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই যে সকল বিষয় আবশ্যক, প্রয়োজনীয় ও উপকারী নয় বা যে সকল মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পথ ও পন্থা একাধিক হতে পারে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সাদৃশ্যপূর্ণ রূপরেখা বর্জন করে সাদৃশ্যহীন পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ করা হয়। আল্লামা ইবনে নুজাইম (রাহ.) বলেন- و(يكفّر) بوضع قلنسوة المجوسي على رأسه على الصحيح إلا لضرورة دفع الحر أو البرد، وبِشدّ الزنار في وسطه إلا إذا فعل ذلك خديعةفي الحرب وطليعة للمسلمين (আল-বাহরুর রায়েক ৫/২০৮) كفار كی وضع بلا ضرورت قويہ حسيہ كدفع الحر والبرد يا شرعيہ كخدع اهل الحرب والتجسس للمسلمين افعال كفر سے ہے(বাওয়াদিরুন নাওয়াদের- ৪৫৪)। পূর্বের আলোচনায় এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, নামাযে চেয়ার শুধু প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে পারবে। আর এটি তখন শরীয়তের দৃষ্টিতে ওজরের অন্তর্ভুক্ত হবে। অতএব, চেয়ারের এই বৈধ ও প্রয়োজনীয় ব্যবহারকে শুধু সাদৃশ্যের অজুহাতে অবৈধ বলা যাবে না। তবে যারা প্রয়োজন ছাড়া নামাযে চেয়ার ব্যবহার করে জেনে না-জেনে এটাকে ফ্যাশনে পরিনত করতে চলেছেন, তাদেরকে এ থেকে বিরত রাখার জন্য এ বিষয়ে সঠিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ইমাম ও খতীব সাহেবগণ যদি এ বিষয়ে সঠিক মাসআলা তুলে ধরে সময়ে সময়ে আলোচনা করেন, তাহলে চেয়ারের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার আশা করি, বন্ধ হয়ে যাবে। আর যারা প্রয়োজনে ব্যবহার করেন, তারাও মসজিদে এসে জামাতে শরীক হয়ে আল্লাহর বন্দেগী করার সুযোগ লাভ করবেন। والله اعلم بالصواب