এহতেশামুল হ্ক্ব ক্বাসেমী,
কোরবানীর মত আকীকাও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ গুরুত্বের সাথে আকীকার কথা উল্লেখ করেছেন, যা হাদীস শরীফের কিতাবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। বাচ্চা জন্মের সপ্তম দিনে এই কাজটি সম্পাদন করতে হয়। কোন কারণে এই দিনে আকীকা দিতে না পারলে পরবর্তীতে তা আদায় করার সুযোগ রয়েছে।
কোরবানী ও আকীকা আলাদাভাবেই করা উচিৎ। প্রশ্ন হল, কেউ যদি আকীকা এবং কোরবানী একসাথে দিয়ে দেয়, তাহলে সেটা কি অবৈধ হবে? বা একারণে আকীকা ও কোরবানী আদায় হবে না?
কোরআন সুন্নাহর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালে আকীকার সাথে কোরবানী দেয়া বৈধই প্রমাণিত হয়। বিষয়টি বুঝতে হলে কয়েকটি বিষয় বুঝতে হবে।
প্রথম কথা হল:
আকীকাও এক ধরণের কোরবানী। হাদীস শরীফে আকীকাকে কোরবানী বলা হয়েছে এবং কোরবানীর জন্য যে শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে আকীকার ক্ষেত্রে সেই শব্দটিই প্রয়োগ করা হয়েছে।
কোরআন শরীফে (সূরা আনআম, ১৬২) কোরবানীকে ‘নুসুক’ বলা হয়েছে তেমনিভাবে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের অসংখ্য কিতাবে কোরবানীকে নুসুক বলা হয়েছে। অপরদিকে কোরবানীর মত আকীকার ক্ষেত্রেও হাদীস শরীফে ‘নুসুক’ শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে যার অর্থ কুরবানী।
(দ্র. আলমুসান্নাফ, আব্দুর রাযযাক : ৪/৩৩০, হাদীস ৭৯৬১; আলমুসনাদ, আহমদ : ১১/৩২০; আসসুনান, আবু দাউদ (আকীকা অধ্যায়) ২৮৪২;আস সুনান, নাসায়ী : হাদীস ৪২১২; আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২৪ হাদীস : ২৪৭২৭)
(দ্র. আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২১, হাদীস : ২৪৭২২; আলমুয়াত্তা, ইমাম মালিক, আকীকা অধ্যায়, হাদীস : ১৪৪১)
সুতরাং বুঝা গেল, আকীকাও এক ধরণের কোরবানী। একারণেই তো হাসান বাসারী রহ. এবং ইবেনে সীরীন রহ. বলেছেন, বাচ্চার পক্ষ থেকে কোরবানী দিলে এটাই তার আকীকার জন্য যথেষ্ট হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২৯ হাদীস ২৪৭৪৩)
অার একারণেই তো কোরবানী এবং আকীকার গোশত, চামড়া ইত্যাদির বিধান এক।
হিশাম ইবনে হাসসান রহ., হাসান বাসারী রহ. এবং ইবনে সীরীন রহ. সম্পর্কে বলেন, আকীকা তাদের মতে কোরবানির মর্যাদা রাখে; আকীকা আদায়কারী নিজে এর গোশত খাবে এবং অন্যকে খাওয়াবে (যেমনিভাবে কোরবানীর গোশত নিজে খায় অন্যকে খাওয়ায়) [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১২/৩২৭ হাদীস ২৪৭৫০,২৪৭৫১)
এ-সম্পর্কে ইমাম মালিক রহ. এর বক্তব্য খুবই সুস্পষ্ট। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি তার সন্তানের আকীকা করল তার সেই আকীকা কোরবানীর পর্যায়ে; সেই আকীকায় চোখের জ্যোতি ক্ষতিগ্রস্ত, শীর্ণকায়, শিং ভাংগা, অসুস্থ প্রাণী জবাই করা যায়েজ হবে না। এর গোশত এবং চামড়া বিক্রি করা যাবে না….(যেমনিভাবে এগুলো দিয়ে কোরবানী যায়েজ হয় না) (মুয়াত্তা: হাদীস ১৪৪৮)
ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন, জুমহুর ফুকাহার মতও তাই। অর্থাৎ আকীকার মধ্যে ঐ-সকল দোষ থেকে পরিহার করা হবে, কোরবানীর মধ্যে পরিহার করা হয়। (আল-ইসতিযকার: ১৫/৩৮৪)
তিনি অন্যত্র বলেন, এ-বিষয়ে উলামাদের ইজমা রয়েছে যে, গবাদী পশুর মধ্য থেকে কোরবানির মধ্যে যা যায়েজ হয়, আকীকার মধ্যে শুধু ঐসকল পশুই জবাই করা যায়েজ হবে। (আল-ইসতিযকার: ১৫/৩৮৩)
দ্বিতীয় বিষয় হল:
দুই ধরনের কুরবানী (যেমন এখানে আকীকা এবং ওয়াজিব কোরবান দুটি) একটি পশু দ্বারা আদায় করা যায়েজ আছে কি না? তো এটি একটি ইজতিহাদী বিষয়। একারণে মুজতাহিদ ইমামগণের মাঝে এ বিষয়ে কিছু মতপার্থক্যও আছে। কিন্তু নস বা কুরআন-সুন্নাহর সুষ্পষ্ট কোনো বিধানে এ বিষয়ে নিষেধ আছে বলে আমাদের জানা নেই; বরং অনুমোদনের পক্ষে হাদীস-আছারের দলীল আছে। পক্ষে বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ‘আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহ. এর ফতোয়াটিই সম্ভবত বিজ্ঞজনের জন্য যথেষ্ট হবে। তিনি বলেছেন, ‘উট ও গরু সাতজনের পক্ষ হতে কুরবানী হতে পারে। আর এতে শরীক হতে পারে কুরবানীকারী, তামাত্তু হজ্বকারী এবং হজ্বের ইহরাম গ্রহণের পর হজ্ব আদায়ে অপারগ ব্যক্তি।
(দ্র. আসসুনান, সায়ীদ ইবনে মানসূর-আল কিরা লি-কাসিদি উম্মিল কুরা, পৃ. ৫৭৩)
দেখুন, সালাফের যুগেই একটি পশু দ্বারা তিন ধরনের কুরবানী আদায় হওয়ার ফতোয়া কত স্পষ্টভাবে দেওয়াহয়েছে।
তৃতীয় বিষয়:
গরু বা উটের ক্ষেত্রে একটি ‘জবাই’ সাত জনের সাতটি জবাইয়ের স্থলাভিষিক্ত গণ্য হয়। একারণেই একটি উট বা গরু সাত জনের পক্ষে যথেষ্ট হয়। সহীহ মুসলিম শরীফে জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমরা হজ্বের ইহরাম বেঁধে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকে আদেশ করলেন যেন প্রত্যেক উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করি। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল হজ্ব, হাদীস : ১৩১৮/৩৫১)
অন্য বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (একটি) গরু সাতজনের পক্ষ হতে এবং (একটি) উট সাতজনের পক্ষ হতে (কুরবানী করা যাবে)। (আস-সুনান, আবু দাউদ, হাদীস : ২৮০৮, কিতাবুল আযাহী)
সারকথা অাকীকাও একধরণের কোরবানী অপরদিকে ‘নুসুক’ বা কুরবানীর ক্ষেত্রে শরীয়তের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি এই যে, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে একটি ‘জবাই’ (إراقة الدم) দ্বারা একটি কুরবানী আদায় হলেও উট ও গরুর ক্ষেত্রে একটি ‘জবাই’ দ্বারা সাতটি কুরবানী আদায় হতে পারে। অর্থাৎ এখানে ‘জবাইয়ে শরীক হওয়া’ও (সর্বোচ্চ সাত জনের) কুরবানী আদায়ের পক্ষে যথেষ্ট। আকীকাও যেহেতু ‘নুসুক’ বা কুরবানী তাই এ মূলনীতিতে আকীকাও শামিল থাকবে। সুতরাং ‘একটি পশু জবাই’ করা দ্বারা যেমন তা আদায় হবে, তেমনি নির্ধারিত নিয়মে ‘জবাইয়ে শরীক হওয়ার’ (شركة في دم) দ্বারাও তা আদায় হবে।
এখানে এ-প্রশ্নের অবকাশ নেই যে, ‘আকীকায় তো পশু জবাই করতে বলা হয়েছে। অতএব অন্তত একটি পশু জবাইয়ের দ্বারাই তা আদায় হতে পারে।’ কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে পশু জবাই (إراقة الدم)-এর দায়িত্ব যেমন একটি পশু জবাই করার দ্বারা আদায় হয় তেমনি নির্ধারিত পশুতে ‘শরীক হওয়ার’ দ্বারাও (شركة في دم) আদায় হয়। আকীকার ক্ষেত্রে এই মূলনীতি প্রযোজ্য নয় বলে দাবি করলে ব্যতিক্রমের বিধানসম্বলিত দলীল লাগবে। আমাদের জানামতে এমন কোনো দলীল নেই।
বাকি থাকল দুই ধরনের কুরবানী এক পশু দ্বারা আদায় হওয়ার প্রশ্ন, এ বিষয়ে উপরে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।
আমাদের লা মাযহাবী ভাইয়েরা খুব সহজেই বলে দেন কোরবানীর সাথে আকীকা দেয়া যাবে না। হায়! তারা যদি উপরোক্ত কথাগুলো নিয়ে একটু ভাবতেন। আচ্ছা তারা যে সব কিছুতে হাদীস পেশ করার কথা বলেন, কোরবানীর সাথে আকীকা দেয়া নিষেধ, এ সংক্রান্ত কোন হাদীস কি তারা পেশ করেছেন? না, তবুও তারা অাহলে হাদীস!!
ইয়া আল্লাহ আপনি সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন, আমিন।