উবায়দুর রহমান খান নদভী:
কওমি মাদরাসা শিক্ষার স্বীকৃতি দিতে একদিকে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, অন্যদিকে দেশের কওমি মাদরাসাসমূহের সর্ববৃহৎ শিক্ষাবোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ (বেফাক) এর চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে আলেমসমাজ কর্তৃক এটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এ নিয়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে, উভয় মহলেই চলছে নানা হিসাব-নিকাশ, ঠিক সেই মুহূর্ত ও পরিস্থিতিতে আমার মতামত ও অবস্থান কী তা অনেকেই জানতে আগ্রহী। সেই সূত্রেই আমি বলতে চাই, ব্যক্তিগতভাবে আমি কওমি মাদরাসার উপর কোনো সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধী। স্বীকৃতি নিলে যদি হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন আসে তাহলে এমন স্বীকৃতিরও বিরোধী। তবে বিষয়টি যেহেতু এখন বিশেষ করে কওমি অঙ্গনে বহুল আলোচিত এবং প্রায় সবাই এ নিয়ে ভাবছেন, তাই আমিও সবিস্তারে আমার মতামত তুলে ধরছি।
একটি কথা সবারই স্পষ্টভাবে জেনে রাখা উচিত, বাংলাদেশের আলেমগণ তাদের মৌলিক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ। এমন ঐক্য সমাজের অন্যকোনো শ্রেণিতে পাওয়া যাবে না। যেমন, কওমি মাদরাসাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে কারো দ্বিমত আছে কি? দেশে এমন একজন আলেমও পাওয়া যাবে না যিনি চান কওমি মাদরাসার উপর সরকারি হস্তক্ষেপ চান। আমি বিশ্বাস করি, ভারতের মতো দেশে দারুল উলুম দেওবন্দ যেভাবে সরকারি হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে নিজ মূলনীতির উপর সগৌরবে টিকে আছে, বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোও সেভাবেই টিকে থাকুক- এটাই শতভাগ কওমি আলেমের চাওয়া। এর বাইরে একজন আলেমও নেই।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর যে প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয় এর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল, যাদের নিয়ে সরকার কমিটি করেছে তাদের সঙ্গে আগে যোগাযোগ না করা। দুয়েকজন ছাড়া বাকিরা জানতেনই না যে তারা এই কমিটির সদস্য। বিশেষ করে এতে কওমি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বড় বড় প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিগণ বাদ পড়েছেন যারা কওমি ঘরানার শতকরা আশিভাগ লোককে নিয়ন্ত্রণ করেন। পাশাপাশি প্রজ্ঞাপনের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব উভয়েই তাদের কাজে যেসব বাধা আসতে পারে সেসব দূর করার ক্ষেত্রে মনোযোগ দেননি। উক্ত প্রজ্ঞাপনটি কিভাবে গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর হতে পারে এ নিয়ে তাদের হোমওয়ার্ক ছিল না। তারা আল্লামা আহমদ শফীসহ দেশের অন্তত পাঁচ-সাতজন শীর্ষ আলেমের সঙ্গে বসতে পারতেন। কমিটিতে আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন এবং তাদের নিশ্চিত হওয়া জরুরি ছিল যে কমিটির কোনো সদস্য এ উদ্যোগের বিরোধিতা করবেন না। অথচ এমনটা হয়নি।
আল্লামা আহমদ শফী দেশের শীর্ষ আলেমদের নিয়ে প্রত্যাখ্যান করায় এ প্রজ্ঞাপন ও ‘কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৩’ এর খসড়া চূড়ান্ত করার কাজ পূর্ণতই বিতর্কিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়ে গিয়েছে। সরকার যদি কওমি মাদরাসা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তাহলেই কেবল এ উদ্যোগটি গণবিরোধী হলেও চাপিয়ে দিতে চাইবে। এটি তারা করবে কি না তাদের ব্যাপার। তবে কওমি ঘরানার নতুন উদ্যোগগুলো সরকারকে নমনীয় ও আশাবাদী করতে পারে। যেমন বোর্ড-বহির্ভূত হাজারো মাদরাসার দিশারী মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দের আট মূলনীতি রক্ষার পর বিশাল সংশোধনী দিয়ে সরকারি উদ্যোগ মেনে নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বেফাক ও অন্যান্য বোর্ড-বহির্ভূত সব মাদরাসার সাথে যোগাযোগ রেখে চলেন। সুতরাং স্বীকৃতির উদ্যোগে তার স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তর্ভুক্তিও অপরিহার্য। যেমন আহমদ শফী সরকারের বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি। তিনি শর্তসাপেক্ষে এবং কওমি মাদরাসাগুলোর স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে স্বীকৃতি নেয়ার পক্ষে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে দিয়েছেন সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে লিয়াজোঁ রাখার জন্যে। তিনি প্রজ্ঞাপনে আসা চারটি বোর্ডের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করবেন। দু’সপ্তাহের ভেতর তারা স্বীকৃতি বিষয়ে কওমি অঙ্গনের বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশ করবেন। সুতরাং এ বিষয়টি এখন যথেষ্ট ইতিবাচক রূপ নিয়ে কওমি অঙ্গনের প্রত্যাশার পথ খুলে দিচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এখানে আমি সংশ্লিষ্টদের বলব, উদ্যোগটি এভাবেই গ্রহণ করুন যাতে কওমি অঙ্গনের ছোট-বড় সকল বোর্ড, শীর্ষ ব্যক্তিত্ব ও স্টেক হোল্ডারের কেউই বাইরে থেকে না যায়। সরকারকে বলব, কওমি অঙ্গনের ভালো করতে চাইলে সবচেয়ে বেশি মানুষ খুশি হয় এমন সমন্বিত ও উদার পদ্ধতিই অবলম্বন করুন। এক্ষেত্রে যারাই ভূমিকা রেখেছেন এদের কেউই যেন ছিটকে না পড়েন। যাদের কথায় দেশবাসী প্রভাবিত হয় তাদের কেউই যেন বাদ না পড়েন। এ সমন্বয়টি সরকার কাকে দিয়ে করবেন, কিভাবে করবেন তা সরকারকেই ভেবে দেখতে হবে। কারণ কওমি অঙ্গন নিয়ে কাজ করা সরকারের জন্য অন্যতম কঠিন একটি বিষয়।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব