মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:১৪
Home / কওমি অঙ্গন / কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি : আমার চিন্তা – মুহিব খান

কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি : আমার চিন্তা – মুহিব খান

জাগ্রত কবি মুহিব খান:

শাসকশক্তি আমাদেরকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেয়ে আমাদের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যই বেশি উন্মুখ।

  • মুহিব খান 01কওমি মাদরাসার প্রধান পরিচয় ও বৈশিষ্টই হলো- এটি আলিয়া মাদরাসার মতো সরকার-পালিত, স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত নয় বরং স্বাধীন, আত্মনির্ভরশীল এবং কৌশল ও উদ্দেশ্যগত কারণেই বিপুল গণসম্পৃক্ত।
    • এর একমাত্র উদ্দেশ্য ও কাজ হলো- সহিহ ইলমে দীন শেখানোর মাধ্যমে জাতির ঈমান আমল ও আখলাক গঠন এবং দীন সংরক্ষণ ও প্রচার। সনদ বা চাকরি এর অন্তর্নিহিত মিশনের অন্তর্ভুক্তই নয়।
    • এখানে পড়ি আমরা খাটি আলেম ও দাঈ হওয়ার জন্যেই। আর কিছু না। যদিও এর উসিলায় কিছু হালাল রিযিকেরও উপায় তৈরি হয়, তবে তা কখনোই মুখ্য নয়। কেননা নিরক্ষরদের জন্যও রিযিকের অনেক পথ আল্লাহ জমিনে খোলা রেখেছেন। রিযিক শিক্ষানির্ভর নয়। দেশ ও বিশ্বের অধিকাংশ ধনাঢ্যরাই অশিক্ষতি বা স্বল্পশিক্ষিত।
    • কেউ যদি কওমির পাশাপাশি অন্যকোনো উচ্চতর শিক্ষায়ও আগ্রহী হয়, তবে তাকে আন্যান্য শিক্ষালয়েই পড়তে হবে। এখানে তার পুরোপুরি সমন্বয় সম্ভব নয়: যেমন অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশিও উচ্চতর দীনি শিক্ষার পুরোপুরি সমন্বয় সম্ভব নয়। হলেও সবার জন্য নয়।
    • তবে কি আমরা আলেম হয়ে বেকার ও অকর্মা থাকবো? – মোটেও না। সরকারি সনদ ছাড়াও আমরা যার যার যোগ্যতা ও সামর্থ অনুযায়ী লেখক শিল্পী সাহিত্যকি বক্তা, কৃষিজীবি খামারি ব্যবসায়ী শিল্পপতি কমিশনার চয়োরম্যান মেয়র এমপি মন্ত্রী স্পিকার রাষ্ট্রপতি সবই হতে পারবো। এসব সরকারি সনদনির্ভর নয়। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার জন্য আমাদের সামনে হাজারও স্বনির্ভর মাধ্যম খোলা আছে।
    • এছাড়াও ব্যাক্তিগত বিকল্প চেষ্টায় অর্জিত বাড়তি কোনো যোগ্যতা ও দক্ষতাবলে প্রাইভেট চাকরিও করতে পারবো। দেশে বেসরকারি চাকরি আসন ৫ কোটির মতো আর সরকারি চাকরি আসন মাত্র ১৪ থেকে ১৬ লাখ। ইচ্ছে বুদ্ধি ব্যাক্তিত্ব ও প্রত্যয়ী শ্রম থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব।
    • এসব সত্ত্বেও সরকারি স্বীকৃতি চাইতে বা নিতে অসুবিধা কী? – অসুবিধা তো আছেই! স্বীকৃতির রকমটা কী রকম হতে পারে, এটাও তো প্রশ্ন। আমরা যা পড়ি; তা তো সরকারের আইন-বিচারিক প্রশাসনিক কুটনৈতিক অর্থনৈতিক সামরিক অধ্যাপনা চিকিতসা প্রকৌশল হিসাবরক্ষণ- কোনো কিছুর জন্যই প্রজোয্য নয়। কাজেই শুধু শিক্ষাবর্ষের হিসাব মিলিয়ে কওমি সিলেবাসকে এসএসসি এইচএসসি ডিগ্রি অনার্স মাস্টার্স এর সমমান দিয়ে দেয়া অসম্ভব ও হাস্যকর।
    • তাহলে শুধুই আলেম বা ধর্মবেত্তা হিসেবে স্বীকৃতি? –কী দরকার, এ স্বীকৃতি তো জাতির কাছে যুগ যুগ ধরে এমনিতেই আছে। সরকারও তো আমাদের আলেম হিসেবে অস্বীকার করছে না। হুজুর মাওলানা তো ডাকছেই। তবে হ্যা, চাকরি যদি উদ্দেশ্য হয়- তাহলে স্বীকৃত সনদে আমাদের শুধু সরকারি ধর্মীয় পোস্টগুলোত চাকরি হলে হতেও পারে। যেমন ইমাম, ধর্মীয়শিক্ষক, ইসলামিক স্টাডিজের প্রভাষক, দোয়া, খতম, মিলাদ, বিয়ের কাজি- ইত্যাদি। কিন্তু এটুকুও এতো সোজা নয়।
    • আমরা আমাদের মতো করে বোর্ড নিয়োগ ভর্তি প্রতিষ্ঠান শিক্ষক সিলেবাস প্রশ্ন পরিক্ষা ফলাফল সব নির্ধারণ করবো, আর সরকার শুধু তাতে সিল মেরে দেবে- আর বড় বড় চেয়ারে আমাদের বসিয়ে দেবে- এটা অবাস্তব স্বপ্ন, অযৌক্তিকও বটে। এক্ষেত্রে সরকারের কিছু নীতিমালা নিয়ন্ত্রন পর্যবেক্ষণ ও তদারকির সম্মুখীন আমাদের হতেই হবে। আর তখনই বাধবে সমস্যা। নানারকম নীতিগত দ্বন্দ্ব থেকে একসময় অস্তিত্বের টানাটানি।
    • তাছাড়া একেকটি চাকরিবান্ধব কওমি সনদের জন্য নকল দুর্নীতি সত্যগোপন মিথ্যাচার হিংসা দ্বন্দ্ব অসততা সবই তখন ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয় হয়ে দেখা দেবে ও জেকে ধরবে কওমি অঙ্গনকে। এ থেকে নিরেট ইলমে দীনের এই শতবছরের ঐতিহ্য সততা নিরাপত্তা স্বাধীনতা ও ধারাবাহিকতাকে বাচানোর গ্যারান্টি কোন্ আলেম বা বোর্ড দেবে তখন?
    • কাজেই বিদেশি ষড়যন্ত্রে পাকানো আর শাসকশক্তির দূরভিসন্ধিতে সাজানো স্বীকৃতির সেধে দেয়া দড়িতে গলা না ঢুকিয়ে- আমাদের উচিত আরও সময়োপযোগী ও অধুনিকরূপে দীনি শিক্ষার সিলেবাসকে সর্বোচ্চ সমৃদ্ধ করে তোলা। সময়ের বিবর্তনে অকার্যকর বা অপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি বাদ দিয়ে এবং একই বিষয়ের অতিরিক্ত পাঠ কমিয়ে তদস্থলে বিশ্বস্বীকৃত আধুনিক ইসলামি জ্ঞানসম্ভার প্রতিস্থাপন করা।
    • মাধ্যমিক পর্যন্ত সবার জন্য সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় সকল বিষয় আবশ্যিক করা এবং পরবর্তীতে শুধুমাত্র আগ্রহী শিক্ষার্থীদের থেকে কওমি সিলেবাসের পাশাপাশি সাধারণ সিলেবাস আয়ত্ত করার সার্বিক সামর্থবিচারে, বিশেষ মেধা ও আদর্শিক বিশ্বস্ততা যাচাইয়ের মাধ্যমে উত্তীর্ন ও বাছাইকৃতদেরকে সরকারি শিক্ষাবোর্ড থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি সনদ অর্জনের জন্যে প্রাইভেট প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাবস্থা রাখা; যেন সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন শাখায় ও স্তরে কওমি সন্তানদের অবস্থান তৈরি ও ক্রমান্বয়ে সুদৃঢ় করে তোলা যায়। সাধারণ সরকারি চাকরির খুব একটা দরকার আমাদের নেই।
    • আরেকটি বিষয়, ঘরে বাইরে গাছতলায় বাশতলায় জলে স্থলে বনে জঙ্গলে বা সম্ভাব্য যেকোন স্থানেই বৈধ উপায়ে ছোট বড় মাঝারি মাদরাসা হতেই পারে। কিন্তু বেফাকসহ অন্যান্য বোর্ডভুক্ত মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য অরও কিছু কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দরকার। মাদরাসার শিক্ষা-স্তর অনুযায়ী এর নিজস্ব ভূমি বা ভাড়াকৃত স্থাপনার আকার ও পরিমাপ, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, বেতন কাঠামো, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা, সুযোগ-সুবিধা, যোগাযোগ ব্যাবস্থা, পরিচালনা পরিষদ কাঠামো, সমপর্যায়ের অন্য মাদরাসা থেকে দুরত্বের ব্যাবধানসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় বোর্ড কর্তৃক সুনির্ধারিত ও শক্তিশালীভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকা উচিত।
    • পাশাপাশি সাধারণ মানুষের দান সহযোগিতার উপর নির্ভরশীলতা দ্রুত কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। দীনি মাদরাসায় সাধারণ মানুষ সাহায্য করতে চাইলে করবেন সওয়াবের আশায় কিন্তু মাদরাসাকে সে আশায় বসে থাকলে বা সে নেশায় ব্যাস্ত থাকলে চলবে না।
    • এখন সে ফকিরি আমল নেই, সবার হাতে দামি দামি মোবাইলে ইন্টারনেট ব্রাউজিং ফেইসবুকিং ঠিকই চলছে। তাই অস্তিত্ব ও আত্বনির্ভরশীলতার স্বার্থে ছাত্রদের উপর য়থায়থ পরিমাণ শিক্ষা ও আবাসিক বেতন নির্ধারণসহ আস্তে আস্তে মাদরাসার নিজস্ব জমি বিল্ডিং মার্কেট ব্যবসা ও অন্যান্য আয়ের ব্যাবস্থা করে নিতে হবে। তবে কোনো উতসাহী নাগরিক, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, প্রবাসী, এমনকি- সরকার, প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের নি:শর্ত অনুদান গ্রহনে বাধা নেই।
    • আমাদের বুঝতে হবে যে, শাসকশক্তি আমাদেরকে (কওমি মাদরাসা ও আলমেদেরকে) স্বীকৃতি দেওয়ার চেয়ে আমাদের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যই বেশি উন্মুখ। এতে যদি শাপলার লাল রক্ত কিছুটা ফিকে হয়ে অাসে আর চির জাগ্রত আপোষহীন সত্য-শক্তি কওমি অঙ্গনকে কায়দা করে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পরাধীনতা ও বাতিলবিরোধী মূল চেতনা ও ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন ও অথর্ব করে দেয়া যায়! সে প্রক্রিয়াই হয়তো চলছে।
    • আমরা না বুঝে অনেকেই খুব খুশি। অনেকের শুধু সম্ভাব্য সুবিধার দিকগুলোই স্বপ্ন হয়ে চোখে ভাসছে। অনেকে একে ঐতিহাসিক প্রাপ্তি ভেবে ইতিহাসের নায়কদের একজন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকতে উঠেপড়ে লেগেছেন। কওমি সংস্কার ও উন্নয়ণ নি:সন্দেহে সময়ের সর্বাধিক প্রয়োজনীয় স্বতন্ত্র একটি কাজ, এর সঙ্গে সরকারি সনদ গ্রহনকে এক না করাই উচিত, কারণ এখানে অন্য অনেক সতর্কতার বিষয় বিদ্যমান। শুধু এ সরকার নয়, সব সরকারের ক্ষেত্রেই কথাটি প্রজোয্য।
    • সরকার অপাতত যেকোনো ভাবে যেকোনো বোর্ড কমিটি সমিতি বা কর্তৃপক্ষের হাতে কোনোরকম স্বীকৃতিটি গছিয়ে দিতে চাইছে। কাজটা হয়ে গেলেই এ বোর্ড-বহির্ভুত সারাদেশের পাড়া মহল্লা মসজিদ অলি গলিতে চলা অসংখ্য দীনি মাদরাসাকে অনিবন্ধিত, অপ্রয়োজনীয়, অস্বীকৃত ও বেআইনী বলে বন্ধ করে দেয়ার পর্বটি সহজ ও যুক্তিসম্মত হবে। জনগণ বাধা দবে না। জনগন এখন আর কিছুতেই বাধা দেয় না। সরকার তখন ধুমসে প্রচার করবে- আমরা কওমি মাদরাসাকে স্বীকৃত দিয়ে এর সার্বিক উন্নয়নে কাজ করছি। আর অবৈধ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিচ্ছি। সুতরাং পাওয়ামাত্রই ধরিয়ে দিন।
    • অনেকে আবার সনদের বিরোধিতা করে থাকেন কেবল রাজনৈতিক কৌশল থেকে। তারা এ সরকারের কাছ থেকে নয়, তবে অন্য সরকারের কাছ থেকে সনদ নিতে রাজি। তারা কিন্তু আরও বেশি পাজি। এদের থেকেও সতর্ক থাকা আবশ্যক। সনদের পক্ষ বিপক্ষ রাজনৈতিক স্বার্থে গড়ে ওঠা বিপজ্জনক। অমুক হুজুর পক্ষে থাকলেই আমিও পক্ষে বা বিপক্ষে থাকলে আমিও বিপক্ষে- এমন কারও হওয়া উচিত নয়। আমি শুধুই কওমি অাদর্শ, ঐতিহ্য, লক্ষ্য ও চেতনার প্রকৃত নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্নিতার চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে সবাইকে পুরো ব্যাপারটি ভাবতে বলবো।
    • ছাত্রদের কিছু হয়তো এতো গভীরে না যেতে পেরে বা না যেতে চেয়ে কোনোমতে শুধু শিক্ষাজীবনের কষ্টার্জিত সনদটির সরকারি স্বীকৃতি পেযে যাওয়াটাকেই সফলতা মনে করছে। আগ্রহে অধীর হয়ে আছে। ভালো চাকরি, সামাজিক মূল্যায়ণ আর বিয়ের পাত্র হিসাবে নিজের গুরুত্ব বৃদ্ধির ব্যাক্তিগত স্বপ্নে হাবুডুবু খাচ্ছে। আসলে কওমি মাদরাসার শুধু ছাত্র হওয়া আর কওমি চিন্তা চেতনার সৈনিক হওয়া এক কথা নয়। আল্লাহ সবাইকে ইলমের সঙ্গে সমঝও দান করুন।
    • অনেকে ভাবছেন- সরকারের কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়া স্বাধীন অবস্থানে থেকে স্বীকৃতি নেয়া যেতে পারে। সরকারও হয়তো বিষয়টি এখন এভাবেই তুলে ধরবে। বুঝাবে। কিন্তু এ কথার কোনো বাস্তব ভিত্তি আদৌ নেই। কুরবানির পশুর দড়ি খুলে নেওয়া হয়- মুক্ত করে দেওয়ার জন্য না, কায়দামতোন পেচিয়ে ধরাশায়ী করে ছুড়ি চালানোর জন্য।
    • আচ্ছা, নানা আশঙ্কা চিন্তা করে স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করার পর সরকার যদি জবরদস্তি কওমি মাদরাসা বন্ধ করার পায়তারা শুরু করে তাহলে? –সরকার যেখানে ঢাকার রাজপথের অবৈধ ফুটপাত মার্কেট উঠাতে পারে না, অভিজাত এলাকার অবৈধ বস্তি সরাতে পারে না, সেখানে হাজারো হাজার দীনি মাদরাসা বন্ধ করে দিতে পারলে ওলামা মাশায়েখ ও নেতৃবৃন্দের গদ্দিনশীন থাকার আর দরকার কী! তবে হ্যা, বস্তিবাসী ও হকারদের মধ্যে যে অটুট ঐক্য আছে, আমাদের মধ্যে তা নেই। অনৈক্যের কারণে যদি আমরা কালের দৃশ্যপট থেকে সমূলে উচ্ছেদ হয়ে যাই- সে দায় আমার নয়। আল্লাহই চুড়ান্ত হেফাজতকারী।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...