রশীদ জামীল:
স্বীকৃতিকে বিকৃতির কবল থেকে বাঁচাতে আনানিয়্যাতের অবসান হোক
কওমি মাদরাসা শিক্ষার সনদের স্বীকৃতি লক্ষ প্রাণের স্পন্দিত অধিকার। এই অধিকার কেড়ে নেয়ার অধিকার কারো নেই। গত কয়েকবছর যাবত আমরা লক্ষ্য করে আসছি স্বীকৃতির প্রশ্নে নীতিগতভাবে সবাই একমত। মুরব্বীদের কথা বলছি। ভালো লেগেছে। কিন্তু যে ব্যাপারটি ভালো লাগেনি সেটাহল আনানিয়্যাতের ব্যাপারটি। আগে তো তাও ছিল চার দেয়ালের ভেতরে। এখন তো রীতিমত পাগড়ি কোমরে বেঁধে মাঠে নামা হয়েগেছে। এমন তো কথা ছিল না!
বাংলাদেশের অভার এইটটি পার্সেন্ট কওমি মাদরাসার প্রতিনিধিত্ব করে ‘বেফাক’। বেফাকের আরবি প্রনাউনসিয়েশন হল ওয়েফাক্ব। ওয়েফাক্ব মানে সঙ্গতি বা একিভূতি। অর্থাৎ মতানৈক্যের উর্ধে উঠে বিভাজিত মাদরাসাসমূহকে একটি মজবুত ডোরায় বেঁধে রাখা। কিন্তু নিজের ঘরের স্তম্ভগুলিকে ব্যালেন্স পজিশনে রাখতে ব্যর্থতার পরিচিয় দেয়া হতে থাকলে নামের সাথে কাজের মিল খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া তো উপায় থাকে না।
স্বীকৃতির প্রশ্নে বেফাক কার্যত নির্লিপ্ত। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসঊদ কাজ করে যাচ্ছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় কীভাবে কী হতে পারে বা হওয়া উচিত, মতামত দেয়ার জন্য ৯ সদস্যের একটি উপ-কমিটি করে দিয়েছে সরকার। এখন গেল গেল গেল রব কেনো? কিছু যদি না-ই চাই, তাহলে কে নিল, কীভাবে নিল, কী আসে যায়! আর চাইলে চাওয়ার মত চাইতে লজ্জার কী ছিল!
দুই
-‘মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ’র নেতৃত্বে আমরা স্বীকৃতি চাই না’! তাহলে কার নেতৃত্বে চাই, বলি না কেনো? কাজ করি না কেনো? করলাম না কেনো?
-‘ফরিদ মাসুদ একজন বিতর্কিত বা বিচ্চুত কওমি আলেম’। তাহলে অচ্ছুতরা দূরে কেনো? তাঁরা কি শুনতে পান না বাতাসে বঞ্চিতির কান্নার শব্দ! তাঁরা কি দেখতে পান না অস্তিত্বের প্রশ্নে বিপর্যস্ততার থাবা ধেয়ে আসছে মূলের দিকে। ডালপালা ধরে ঝুলাঝুলির কি আরো সময় আছে? বাঁচতে হবে না? বাঁচানো দরকার না?
-‘মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ এখন আর কওমি উলামার মুরব্বি পর্যায়ের কেউ নন। তিনি লাইনচ্চ্যুত’। ভালো কথা। ‘রুহুল আমিন সাহেব আওয়ামি ঘরানার’। তাও মানলাম। কিন্তু বাকিরা যারা? অন্যান্য যাদের নাম কমিটিতে দেখছি, সুলতান যওক নদবি, আব্দুল হালিম বোখারি, আনওয়ার শাহ কিশোরগঞ্জি, উনারাও কি কওমি মুরব্বিয়ানা থেকে বরখাস্ত? কবে হলেন? কারা করলেন?
আমরা তো জানি এই নামগুলো কওমি অঙ্গনে এক একটি ব্র্যান্ড মতন। তবে কি ভুল জানি? আমরা তো জানি মাওলানা আনওয়ার শাহ বেফাকের সহ সভাপতির পদে আছেন। একটু আগে যে বললাম, ঘরের খুটিগুলোই ঠিক রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে বেফাক, ভুল বলেছি?
স্বীকৃতি দাবি সার্বজনীন। বেফাকের উচিত ছিল ময়দানের আওয়াজ কানে নেওয়া। যেভাবে যা হলে সবকিছু ঠিকটাক রেখে বাকিকিছু হতে পারে, পদক্ষেপ নেওয়া। বেফাকের উচিত ছিল বাংলাদেশের অন্যান্য ছোটছোট মাদরাসাগুলোর সাথে নিজ উদ্যোগে লিয়াজো করা, সবাইকে নিয়ে বসা, বারবার বসা। একটি কমপ্লিট রূপরেখা তৈরি করে সরকারকে দেয়া। সরকারের সাথে দেন-দরবার করা। মেনে নিলে তো ভালো। না নিলে সংবাদ সম্মিলন করে জাতিকে জানানো। তাহলে বিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি হত না। কিন্তু এক্ষেত্রেও বেফাক চরম ব্যর্থতার পরিচিয় দিল। আজ ঘুম ভেঙেছে বেফাকের। জরুরি সভা আহবান করা হয়েছে। আরো আগে হতে পারত না? ঘোলা জল গড়িয়ে গড়িয়ে বাইরে আসার আগে?
তিন
যা হবার হয়েছে। এখনো সময় আছে। এখনো সম্ভব স্বপ্নগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার। এখনো সম্ভব অস্তিত্ব ধরে রাখা। আর এ জন্য দরকার আনানিয়্যাতের কবল থেকে থেকে বেরিয়ে এসে খোলামনে সামনে আসার। লক্ষ লক্ষ কওমি ছেলেদের আগামীর কথা ভেবে ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে হাতে হাত রাখার। তা নাহলে কী হবে, সেটা আমাদের থেকে আপনারা আরো ভালো করেই জানেন।
আর যদি, আপনারা যারা আমাদের মুরব্বি, আপনারা যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন পরষ্পর গুনে গুনে একশ’ হাত করে দূরে থাকবেন, নিজের কব্জায় না হলে প্রত্যাখ্যান করবেন, তাহলে আম তো যাবেই, ছালাটুকুনও ধরে রাখা যাবে কিনা, বলা মুশকিল। এটা না বুঝলে আপানাদের কিছুই যাবে-আসবে না কিন্তু লক্ষ লক্ষ কওমি সন্তানদের আগামীর প্রশ্নে অনেক কিছুই যাবে আসবে। সো, প্লিজ, একটু দয়া করুন।
===============================
উৎসর্গঃ
‘বেফাক শাহেনশাহ’
কথাগুলো ‘বেফাক’কে এড্রেস করে বললেও মূলত বেফাকের স্থলে ‘বেফাক শাহেনশাহ’ পড়া উচিত। চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে পাশ কাটিয়ে তিনি তো সর্বেসর্বা। একচ্ছত্র কর্তৃত্বের জবর দখলকারী। ‘মান ইয়া না মান, মায় তেরা মেহমান’ স্টাইলে।
কৈফিয়তঃ
উৎসর্গ-পত্রের ব্যাখ্যা দিতে লাগলে অসুন্দর অনেক কথা বলা লাগবে। বলা লাগবে কীভাবে তিনি মিটিং ডেকে কমিটির যে যে আলেমকে উনার পছন্দ না, তাদের নামের আগে লাল কালির ক্রস চিহ্ন দিয়ে রাখেন! বলা লাগবে… থাক, আর বলার দরকার নাই। যা কিছু হয়েছে, হয়েই তো গেছে। যা কিছু হবে, ভালো হোক। আর শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।