নিকট অতীতের যে দু’জন শীর্ষ আলেমের ব্যক্তিত্ব আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল তাদের একজন হলেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। তাদের উভয়ের কাছে সরাসরি পড়ার সৌভাগ্যটুকু আমার হয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের উভয়েই জান্নাতবাসী হয়ে গেলেন। একজন ছাত্রের কাছে তার উস্তাদ মহান হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার প্রিয় এই দু’জন উস্তাদের ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতি শুধু তাদের ছাত্রদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাদের পরিচিতির ব্যাপ্তি যেমন সর্বময় বিস্তৃত ছিল তেমনি তাদের ভক্ত-অনুরাগীও নির্দিষ্ট কোনো সীমায় ও গন্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। সবাই ছিলেন তাদের অতি আপন, আর তারা ছিলেন সবার অতি প্রিয় ও
কাছেরজন। শুধু যোগ্যতা ও খ্যাতিতে নয়, তাদের মতো আকাশছোঁয়া ও ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেম আজ আক্ষরিক অর্থেই বিরল। প্রাণখুলে শ্রদ্ধা করা, অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়া এবং কর্ম ও চিন্তায় জড়ানোর মতো আলেমের সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার বিভা দিয়ে পুরো আলেমসমাজকে নাড়া দেয়ার মতো ব্যক্তিত্বের অভাব আজ প্রচণ্ডভাবে অনুভব করছি। নানা সংকটেও আজ ওলামায়ে কেরাম ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে আসতে পারছেন না। যোগ্য নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেমের অনুপস্থিতিই এর প্রধান কারণ। বর্তমানে আলেমদের যে শীর্ষ শ্রেণীটি বিচ্ছিন্নভাবে হলেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা অতীত হলে এ ময়দানের শূন্যতা ও হাহাকার ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
গত চার দশক ধরে বাংলাদেশে আলেম সমাজের সম্মিলিত এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যেখানে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর প্রত্যক্ষ বা পারোক্ষ ভূমিকা ছিল না। ছদর সাহেব ও হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর পরবর্তী সময়ে তিনিই ছিলেন আলেম সমাজের অবিসংবাদিত নেতা। স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে শায়খুল হাদিস রহ.-এর সরব উপস্থিতি ছিল না। জাতীয় ও ধর্মীয় ইস্যুতে সারা দেশের আলেম-ওলামা চাতকের মতো তাকিয়ে থাকতো শায়খুল হাদিসের নির্দেশনার প্রতি। ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ লংমার্চ থেকে শুরু করে ফতোয়াবিরোধী রায়ের প্রতিবাদে সর্বাত্মক জাগরণে শীর্ষ ভূমিকাটুকু পালন করেছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই মহান নেতা। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ হয়ত শায়খুল হাদিসকে ততটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও উঁচু হিম্মতের ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত ছিল না। আজকে যারা এদেশের ইসলামী রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে শায়খুল হাদিসের শাগরেদ বা ভাবশিষ্য। সুতরাং আগামী কয়েক দশকও এদেশের ধর্মীয় অঙ্গনে শায়খুল হাদিস রহ.-এর সুস্পষ্ট ছাপ অনুভব করা যাবে।
এদেশে আলেম-ওলামা মাশাআল্লাহ কম নয়। সমাজে তাদের প্রভাবও মোটামুটি আছে। তবে তাদের বেশির ভাগই নির্দিষ্ট বিষয় ও অঙ্গনে পারদর্শী। কিন্তু শায়খুল হাদিস রহ. নির্দিষ্ট কোনো বিষয় ও অঙ্গনের বলয়ে আবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার ব্যাপ্তি ছিল দশদিকে প্লাবিত। আর তিনি প্রতিটি অঙ্গনেই সাফল্যের অনুভবযোগ্য ছাপ রেখে গেছেন। আমার জানামতে, বাংলাদেশে নিকট অতীতে এমন প্রভাবশালী, সর্বপ্লাবী ব্যক্তিত্ব ও কর্মমুখর আলেম আর অতীত হননি। তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতা ছুঁয়ে দেখার মতো ছিল না, বিষয়টি ছিল অনুভবের। বাংলাদেশে হাজারো ‘শায়খুল হাদিস’ থাকা সত্ত্বেও উপাধিটি তাঁর সঙ্গে যেভাবে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়েছিল তা আর কারো ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এই উপাধির ওজন বহন করার মতো যোগ্যতা পুরোপুরি তাঁর ছিল। ‘শায়খুল হাদিস আল্লামা’ আজকাল যে কারো নামের সঙ্গে যোগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সম্মানসূচক এই উপাধিটি ‘আজিজুল হক’ নামটির সঙ্গে যেভাবে ফিট হতো কারো ক্ষেত্রে তেমনটা আর হয় না।
দুই.
শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। তাঁর মতো আলেমব্যক্তিত্ব প্রতি শতাব্দীতে দু’একজন জন্ম নেন কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিশেষ করে আমাদের অনুর্বর এই ভূখণ্ড যেখানে হীরকতুল্য ব্যক্তিত্বের সম্মান ও অবস্থান বোঝার মতো লোকের যথেষ্ট অভাব। প্রায় পৌনে এক শতাব্দী যিনি এদেশে মাটি ও মানুষকে অকাতরে দিয়ে গেছেন তাঁকে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখার দায়িত্ব বর্তায় পরবর্তীদের ওপর। এতে শায়খুল হাদীসের মতো ব্যক্তিত্বকে মহিয়ান করার কিছু নেই, বরং অনাগতদের ভবিষ্যত আরো সমৃদ্ধ ও স্বপ্নীল করার জন্যই তা করা উচিত। দুর্ভাগ্যজনক ট্রাজেডি হলো, আমরা মহান ব্যক্তিদের জীবিত থাকাকালীন যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারি না। রত্নতুল্য অনেক মনীষী আমাদের অবমূল্যায়ন ও অবজ্ঞায় বিস্মৃতির আঁধারে তলিয়ে গেছেন। এজন্যই আমাদের সমাজে এমন গুণীজন জন্মায় কম। জীবদ্দশায় শায়খুল হাদিস রহ.ও কম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অবমূল্যায়নের শিকার হননি। তবে তিনি ছিলেন আকাশের মতো উদার ও সমুদ্রের মতো বিশাল মনের অধিকারী। যারা তাঁকে অবমূল্যায়ন করার পাঁয়তারা করেছেন তাদেরকে তিনি কাছে টেনে নিয়েছেন। যারা শায়খুল হাদিসের ব্যক্তিত্বে ও যোগ্যতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে নানা কূট-চক্রান্ত করেছেন তাদেরকে আজ কেউ স্মরণ করে না। শায়খুল হাদিসই আজ মহান, খ্যাতির শীর্ষে। যারা শায়খের নানা কর্মকান্ডে এককালে নাক ছিটকাতেন তাদেরকেও শায়খুল হাদিসের ইন্তেকালের পর তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের কথা অকপটে স্বীকার করতে দেখা গেছে।
আমরা যদি শায়খুল হাদিস রহ.কে বিগত এক শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলি তবে আমার মনে হয় একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। এমন একজন যুগশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শ, সান্নিধ্য, করুণা যারা পেয়েছি তারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। এখন আমাদের নিজেদের স্বার্থেই ক্ষণজন্মা এই মহান পুরুষকে বাঁচিয়ে রাখা, তাঁর আদর্শকে ধরে রাখা, তাঁর কীর্তিময় জীবনের প্রতিটি মিশন সচল করা একান্ত জরুরি। আমাদের দেশের অপসংস্কৃতি হলো, আমরা আকাবিরের কথায় ভক্তিতে গদগদ করলেও তাদের কর্ম ও আদর্শকে সজীব রাখার উদ্যোগ কম নিই। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই, অন্তত শায়খুল হাদিস রহ. এর ক্ষেত্রে চিরাচরিত ধারার কিছুটা ব্যত্যয় ঘটবে। কারণ শায়খুল হাদিস রহ. তাঁর সুযোগ্য সন্তানদের রেখে গেছেন, যারা তাঁর আদর্শ জীবন্ত করে রাখার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা রাখেন। এছাড়া দেশের এমন কোনো থানা-ইউনিয়ন খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে শায়খুল হাদিসের কোনো রূহানী সন্তান নেই। বিশ্বের নানা প্রান্তেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শায়খের অগণিত ছাত্র-ভক্ত-অনুরাগী।
শায়খুল হাদিস রহ. যেসব দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে গেছেন সেগুলোতে যেন তাঁর চলে যাওয়ার কোনো প্রভাব না পড়ে। ইসলামী রাজনীতির নতুন যে ধারার তিনি সূচনা করেছিলেন তা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের। ব্যক্তিস্বার্থে যেন শায়খের স্বপ্নের এই আন্দোলন অকার্যকর ও নির্জীব না হয়ে পড়ে সে দিকে সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। লেখনির যে ভান্ডার শায়খুল হাদিস রহ. রেখে গেছেন সেগুলো যেন আম-জনতার উপকারে আসে এবং সবার দোড়গোড়ায় পৌঁছে যায় সে ব্যাপারেও ভাবতে হবে। পার্থিব কোনো চাওয়া-পাওয়ার জন্য নয়, একমাত্র ‘শায়খুল হাদিস’ নামটির জন্য যারা যেকোনো সংগ্রাম-সাধনায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন তাদের জন্য ঐক্যবদ্ধ কোনো প্লাটফর্ম গড়ে তোলার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ, একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে এমন জাগরণ বাংলাদেশে সত্যিই বিরল। শায়খুল হাদিসের জীবদ্দশায় তাঁর নামে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা হয়েছে, এর কার্যক্রম গতিশীল করা দরকার। শায়খুল হাদিসের আজীবনের স্বপ্ন ছিল কুরআনের শিক্ষা প্রসারে মক্তব আন্দোলনকে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেয়া। শায়খুল হাদিস ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ সফল হতে পারে। যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সবার প্রিয় শায়খুল হাদিস সে স্থানটিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে বিশাল কমপ্লেক্স, যা দ্বীনের দুর্গ হিসেবে বিবেচিত হবে।
মহীরুহতুল্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী সবার প্রিয় (আজিজ) শায়খ আজ আর নেই-ভাবতেই কেমন যেন একটি শূন্যতা অনুভব হয়। দিকহারা বহুধা বিভক্ত এই আলেমসমাজ আশ্রয় লাভের শেষ ভরসাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ভূমিকা তেমনটা অনুভব করতে না পারলেও আজ আমরা বুঝি কী রত্ন আমরা হারিয়ে বসেছি। অমূল্য এই রত্ন সহসাই লাভ হবে সে আশা ক্ষীণ। থানভী-মাদানী, ছদর-হাফেজ্জীর যুগ আমরা পাইনি। আমরা শায়খুল হাদিসকে দেখেই তাদের বিশালত্ব অনুমান করতাম। কিন্তু তাঁকে হারানোর পর ওই মনীষীদের বিশালতা অনুভব করার মতো সার্বিক বিবেচনায় যোগ্য ব্যক্তিত্বের অভাব প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে। জানি না, সেই অভাব আদৌ কোনোদিন পূর্ণ হবে কিনা! প্রভুর কাছে মিনতি, এ জাতিকে কখনো শায়খুল হাদিসের মতো সর্বপ্লাবী আলেমের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না। আল্লাহুম্মা আমীন।