খতিব তাজুল ইসলাম:
বাবা-মা সন্তানকে ভালবাসেন। স্বামী স্ত্রী একে অন্যকে ভালবাসেন। সন্তান তার পিতা-মাতাকে ভালবাসে। উস্তাজ-শিক্ষক একে অপরকে ভালবাসেন। নেতা জনগণকে জনগণ নেতাকে ভালবাসে। ভালবাসার উদাহরণ বেহিসেব আছে। যারা যে প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ে করে তাদের সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য হয়ে যায় নাড়ির টান। এও এক ভালবাসা। একজন ইমাম যখন কোন মসজিদে থাকেন তখন মুসল্লিরা তাকেও ভালবেসে ফেলে। খরিদ করে ভালবাসা সৃষ্টি করা যায় না কৃত্রিমতা ছাড়া। কেউ কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলে ভালবাসতে পারে নাও পারে। চাকরির খাতিরে চাকরি করে ভালবাসার জন্য নাও হতে পারে।
প্রিন্সিপাল হাবীবুর রাহমান সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ‘পড়লেন আলিয়ায় গড়লেন কওমি ! কারণ কী’? বললেন ভালবাসার কথা। বললেন, ‘এখানে আধ্যাত্মিকতা আছে। সুন্নতে নববীর রৌশনী আছে। ইলমে ওহীর ঔজ্জ্বল্য আছে’। আচ্ছা, সেই তিনি যখন প্রিন্সিপাল শব্দটি নামের পাশে লিখলেন, শুরু হলো ফতোয়ার বাহার। গোমরাহ শব্দটি ছিলো সর্বনিম্ন ফতোয়া।
সেই তিনি যখন আবার কিছু বাংলা-অংক-ইংরেজি-বিজ্ঞানের বই মাদরাসার পাঠ্য তালিকায় সংযোজন করলেন, শুরু হলো নতুন ফতোয়াবাজি! কাজিরবাজার মাদরাসা স্কুল হয়েগেছে। এই মাদরাসায় আর দ্বীন বলতে কিছু বাকি নেই…
আল্লাহর শুকরিয়া, ১৯৭৪-২০১৬ পর্যন্ত ৪২ বসন্ত মাদরাসাটি মাথা উচুঁ করেই দাঁড়িয়ে আছে। ২০১০ ইং সনে সেই সিপাহসালার নির্দেশে মূল মাদরাসা ক্যাম্পাসে কায়েম হলো কিন্ডারগার্টেন। আজ যেটা হাইস্কুল হয়ে ম্যাট্রিকের কাছাকাছি। তুষের আগুনের মতো জ্বলেপুড়ে অনেকে অংগার হয়েছেন। হায় হায়! গেল গেল! দ্বীন গেল! বরকত গেল! রহমত গেল! অপবাদ প্রপাগাণ্ডা দেশে বিদেশে সমান্তরালভাবে চলেছে। কিন্তু তাঁরা পরাজিত হয়েছে, হতে থাকবে।
প্রিন্সিপাল হাবীবুর রাহমান যখন আল-মারকাজুল খাইরী আল-ইসলামী করে আর্তমানবতার আরেক নজির স্থাপন করলেন, তখন অবশ্য ফতোয়াবাজিটা স্তিমিত হয়ে আসলো। তথদিনে তারা নিজেরাও প্রিন্সিপাল লিখা শুরু করে দিয়েছেন। তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে বাংলা অংক ইংরেজি বিজ্ঞানকে(নামকাওয়াস্তে হলেও) পাঠদানের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। দ্বীনী প্রতিষ্ঠানে বহুমূখী কর্মসুচির কর্ণধার হলেন এই মর্দে মোজাহিদ, এটা তাঁর দুশমওকেও স্বীকার করতে হয়?(অবশ্য দুশমন যদি বিবেকবান হন, তো।
প্রিন্সিপাল হাবীবুর রাহমানের দুশমনদের জন্য সবচেয়ে বড় অন্ত্বঃজ্বালার কারণ হলো, তিনি যুগের চেয়ে কিছুটা এডভান্স চিন্তা ফিকির লালন করেন। আজ তিনি যা বলেন, সেটা বোঝার যোগ্যতা যাদের নেই, তারাই মূলত বেহুদা গালাগালি আর ফতোয়াবাজি করে। যখন বুঝে তখন অনেক জল ঘোলা করে। তাহলে আগের সেই রহমত বরকত দ্বীনদারীর ফতোয়া এখন গেল কই?
দারুল উলুম দেওবন্দের সিলেবাস ভারত সরকার স্বীকৃত। তাঁরা ১০ম পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় শিক্ষার অংশীদার। দেওবন্দের আধ্যাত্মিকতা তাহলে বিলীন হয়ে গেল? জামেয়াতুর রাশিদ দারুল উলুম করাচি এবং বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়্যা পাকিস্তান’র সনদগুলো সরকার স্বীকৃত। তারাও দ্বীন মুক্ত হতে চলেছেন? তুমি যে সমাজের বোজা হয়ে আছো একথা অনুধাবনের শক্তি যে তুমি হারিয়ে ফেলেছো। তোমার ধীশক্তি অগ্রগামী হওয়া দূরে থাক সময়ের চাহিদাটুকু ধারন করার ক্ষমতা আল্লাহ তোমাকে দেননি। তাই এই আহাজারি?
মায়ের থেকে মাসীর মহব্বত যেমন বেশি হয় না, তেমনি জামেয়া মাদানিয়ার জন্য সেই সমস্ত মাসীদের দরদ আর কত হবে? যে সন্তান ধারণ করে লালন করে, সন্তানের প্রতি তাঁর ভালবাসা বেশি হবে, নাকি পালক অভিভাবকের? রিকশাওয়ালাও চায় তাঁর সন্তানটার জীবন তাঁর চেয়ে আরো উন্নত হউক। একজনের রক্ত ও ঘামে গড়া স্বপ্নের আঙিনার প্রতি বসন্তের কুকিলদের কী আর দরদ থাকতে পারে? যারা ভাবছে কাকের বাসায় ডিম পেড়ে কাককে ধোঁকা দিয়ে আণ্ডা-বাচ্চা লেলিয়ে দিয়ে সারাজনম চালিয়ে দেয়া যাবে, তারাই হচ্ছে ওরা, যারা কওমির টুঁটি চেপে ধরে রাখতে চায়। নিজের অযোগ্যতা মুর্খতার উপর ভর করে অন্যের উন্নতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু অনিবার্য পরাজয়ের পদ ধ্বনি শুনতে পায় না।
আজ দিকে দিকে কওমিতে কেজির আলোড়ন শুরু হয়েছে। যুগের সাথে সময়ের চাহিদাকে পুরণ করার ক্ষমতা শিক্ষার্থীদের মাঝে তৈরি করে দিতে হবে। দেড় যুগ আগে জামেয়া মাদানিয়ায় এসছিলো কম্পিউটার, সেলাই মেশিন বৈদ্যুতিক শিক্ষার ট্রেনিং। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণও চলছে সমান্তরাল। কই! গেল গেল গলাবাজরা আজ কই?
যে জাতি নিজের কামাই করাকে ভাবে লজ্জা, ধর্মের ব্যবসাকে ভাবে একমাত্র ভরসা, কর্মশিক্ষাকে ভাবে অনর্থকতা, যাচনাকে ভাবে পাওনা, তারা পদে পদে লাঞ্চিত অপমানিত হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
অবুঝ বন্ধু একবার চোখ তুলে তোমার আশপাশের দিকে তাকাও। ভাবো তোমার অবস্থান কোথায়? তোমার আওয়াজ কতদূর পর্যন্ত যায়? সমাজে তোমার কর্তৃত্ব কত গভীরে? সমাজ রাষ্ট্র মিডিয়ায় তোমার অবস্থান কত সুদৃঢ় তাকি একবার মেপে দেখেছো? না, সেটা দেখার যোগ্যতাটুকু তুমি অর্জন করতে পারনি। পরগাছি জীবনের কাছে আত্মনির্ভরশীলতার কি মূল্য আছে? অথচ, তুমি দায়ী ছিলে না।
তুমি আকাবির আকাবির বলে মুখে ফেনা তুলছো। তোমার আমার আকাবির কী বলছেন সেটা কি জানো?
– “আমরা এখন একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের জন্য দারুল উলুম দেওবন্দ আলীগড় কিংবা লকনৌর মত প্রতিষ্ঠানের আবেদন আর বাকি থাকেনি। এখন প্রয়োজন সার্বজনীন এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা, যাতে করে খোলাফায়ে রাশেদার আদর্শে সুদক্ষ ও পুর্ণাংগ একটি জাতি গড়ে উঠবে। যারা ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিটি জরুরত পুরা করতে সক্ষম হবে।” (মুফতিয়ে আজম মুহাম্মাদ শফী রাহিমাহুল্লাহ)
কেউ কথা রাখেনি। জিন্না যেমন ফিরিংগিদের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, তেমনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎও হয়ে উঠলো তাদের দয়া ও অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। আর দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলো পরাধীন রাষ্ট্রের হাংগামী অবস্থার মতো অসহায় ভাবে পড়ে থাকলো। আর আমরা সেই অসহায়তাকে নসীব হিসাবে খুশি মনে গ্রহন করে বসে থাকলাম। কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের এহসাস!
কেউ সংস্কারের কথা বললে আজিব কিসিমের আকাবির আকাবির বলে চিৎকার দেই। শাইখুল ইসলাম তাকি উসমানি লিখতে লিখতে হয়রান! বলতে বলতে লিখতে লিখতে চলেগেলেন বিংশ শতাব্দির মুজাদ্দিদ আবুল হাসান আলী নদবি। কিন্তু উনারা যেন কেউ আমাদের আকাবির নন। নতুন ইতিহাসের ডিক্সনারি তাহলে আবিষ্কার করতে হবে নব্য আকাবিরদের জন্য।
মনে রেখো তুমি যাকে দ্বীন ভাবছো, রহমত বরকত ভাবছো আধ্যাত্মিকতা ভাবছো, ফজিলতের জিনিস ভাবছো, আমাদের সলফে সালেহিন কিন্তু তার ধারে কাছে নেই। লাঞ্চিতের বরকত অপমানের রহমত পরগাছির আধ্যাত্মিকতা নিয়ে তুমি বসে থাকো। তবে অনুরোধ, অন্যের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়ে যেও না। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি আমার আধ্যাত্মিক রাহবর চেতনার বাতিঘর কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা প্রিন্সিপাল হাবীবুর রাহমানের শুরু করা কর্মসুচির ধারাবাহিকতা জীবনের বিনীময়ে হলেও বয়ে নিয়ে যাবো। এই সংকল্প আল্লাহর দরবারে।
কওমির প্রতি ভালবাসা কাউকে খুশি করতে, চাকরি নিতে বা বাঁচাতে নয়। এটা আমাদের হুজুগে চিৎকারও নয়। আমার জীবনের ভীষণ ও মিশন সেটা । তোমার বুঝে আসুক কিংবা না, আমার কিছু যায় আসে না।