মুহাম্মাদ মুহিউ্দ্দীন কাসেমী:
[আমরা কেমন জানি দিবসনির্ভর হয়ে যাচ্ছি। প্রথা ও রেওয়াজে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি। এমনটি কাম্য নয়। এ লেখাটি গত মে মাসের লেখা। তখন অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ আমরা পড়েছি; এখন ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়গুলো চিন্তা করা দরকার। কিছু না করতে পারলেও চেতনাগুলো তো ধারণ করা যাবে। ভিন্ন মত ও বক্তব্য সশ্রদ্ধ গৃহীত হবে।]
—
মানুষের কাজ হচ্ছে চেষ্টা করে যাওয়া। সফলতা আল্লাহর দান। কখনো দিবেন আবার কখনো বঞ্চিতও করতে পারেন। তাছাড়া সফলতার সংজ্ঞাও স্থান-কালভেদে একেক রকম। বাহ্যিক দৃষ্টির ব্যর্থতাই একসময় বাস্তব সফলতার রূপ পরিগ্রহ করে। হুদায়বিয়ার সন্ধিই জ্বলন্ত প্রমাণ।
হেফাজতে ইসলামের ট্রাজেডি নিয়ে লেখালেখি একেবারে কম হয়নি। ৫ তারিখের ঐতিহাসিক রাতে আমিও শাপলাচত্বরে ছিলাম। আন্দোলনের শুরু থেকে পুরোপুরি সক্রিয় না হলেও অসক্রিয় ছিলাম না। প্রত্যেকটি মিছিল-মিটিং-অবরোধ ও সমাবেশে যোগ দিয়েছি। অবেশেষে কালো রাতের বিভীষিকাও দেখলাম কাছে থেকে। মর্মান্তিক এ ট্রাজেডি সম্পর্কে একান্তই ব্যক্তিগত কিছু ভাবনা পেশ করছি :
কী করা দরকার ছিল?
০১. ৫ তারিখের অবরোধের পর শাপলাচত্বরে সমাবেশ ও রাত্রিযাপন সঠিক ছিল, নাকি ভুল? অনেকে অনেক কথা বলেন। যদি পরামর্শভিত্তিক রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্তই হয়ে থাকে তাহলে তা-ই সঠিক ছিল। সকল কর্মসূচিই যে সফলতা বয়ে আনবে- এমন কিছু না। আমীরের আনুগত্যই মূল বিষয়।
কিন্তু এ সিদ্ধান্ত কি আসলেই পরামর্শক্রমে হয়েছে কি-না তা নিয়েই ধুম্রজালের শেষ নেই। এমনটি হওয়া কোনোক্রমেই কাম্য নয়।
০২. ধরে নিলাম পরামর্শক্রমেই রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু রাতযাপনের পুরোপুরি প্রস্তুতি ছিল না। মানুষজন রাতযাপনের প্রস্তুতি না নিয়েই বেরিয়েছে। খাবার-পানি পর্যন্ত ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা হল, নামায ও অজুর প্রস্তুতি ছিল না। দুয়েকদিন না খেলেও তেমন সমস্যা হবে না। কিন্তু একটি ঈমানী আন্দোলন করতে গিয়ে ফরজ নামায পরিত্যাগ করা কোনোভাবেই সঠিক হতে পারে না। আমি নিজে দেখেছি, পানির অভাবে অনেক মানুষ অজু করতে পারে নি। নামাযের পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল না।
০৩. সরকার এ আন্দোলনের বিপক্ষে- এটা সবারই জানা কথা। সরকারের বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলে কিংবা রাস্তাঘাটে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আহতদের সেবা দেওয়ার প্রস্তুতি রাখা দরকার ছিল। কয়টি এ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত ছিল? কয়টি হাসপাতালে আগে থেকে কথা বলা ছিল?
০৪. টয়লেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দীর্ঘ অবরোধ ও সমাবেশ, রাত্রিযাপন হবে; তাই কয়টি টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল? রাতযাপনের সিদ্ধান্ত কৌশলের কারণে আগে জানানো হয়নি সত্য; তাই বলে নেতৃবৃন্দও আগে থেকে জানবেন না?
০৫. হেফাজতের এ গণজোয়ার ও গণবিস্ফোরণকে সাংগঠিকভাবে সুসংহত করা দরকার ছিল। হঠাৎ এমন ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসূচি দেওয়ার আগে প্রয়োজন ছিল ব্যাপক চিন্তার। হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে প্রতিটি অঞ্চলে কমিটি গঠন করে সদস্য সংগ্রহ করতে পারত। ১ কোটি সদস্য ফরম বিক্রি করা হল। প্রতিটি ফরমের দাম ৫০ টাকা। টাকা হয়ে গেল ৫০ কোটি। আন্দোলনে টাকাও মুখ্য ভূমিকা রাখে। কর্মীরা সংঘবদ্ধ থাকলে যে-কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সহজ।
০৬. অনেক এলাকায় হেফাজতের কমিটি হয়েছে। আমরা দেখেছিও। কিন্তু কমিটিতে স্থান পেয়েছে কেবল মাদরাসার মুহতামিম ও বক্তারা। এদের অনেকের যোগ্যতা ও সততা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। একজন ভালো মুহাদ্দিস, মুহতামিম ও বক্তা স্বীয় কর্মস্থলে ঠিক আছেন; তাই বলে কি তার ভেতর সাংগঠনিক যোগ্যতা রয়েছে পূর্ণমাত্রায়? তাকওয়ার অধিকারী তরুণ সমাজকে নেতৃত্বে আনা দরকার ছিল, যারা বহুমুখী যোগ্যতার অধিকারী। যারা মিডিয়ায় সাবলীল, পত্রিকায় সাক্ষাৎকার এবং টেলিভিশনে শক্তিমান আলোচক হতে পারেন।
হযরত উসামা রা. এবং ইয়াজিদকে সেনাপতি বানানোর পর কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। প্রবীণ অনেক সাহাবি তাদের নেতৃত্বে জিহাদ করেছেন। বিষয়টি সবসময় মনে রাখা উচিত। রাজনৈতিক ও শিক্ষাঙ্গনেও কওমির তরুণরাও অগ্রণী ভূমিকা রাখার যোগ্যতা রাখে।
০৭. সমাবেশের বিশাল উপস্থিতি দেখে অনেকেই বক্তৃতায় অতিরঞ্জন করে ফেলেন। বলতে বলতে হাসিনার গালে জুতাও মারা হয়। পরক্ষণে ক্ষমাও চাইতে হয়। অনেক বক্তা সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলে বসেন, আমাগীকাল সকালে পালানোর পথ পাবেন না। আরো কতো কী। সকালে পালাল কারা? যাই হোক, এ কাজটি মোটেও ঠিক হয়নি। এসব হুমকিই তাদেরকে ক্র্যাকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে সংশয়মুক্ত করেছে।
০৮. হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অনেকেই বর্ণচোরা ও বিতর্কিত ছিলেন, তাদেরকে কমিটিতে না রাখলেই ভালো হতো। বিশেষত যারা বিশদলীয় জোটের শরিক। রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে অরাজনৈতিক সংগঠন চালালে কেউ কি অরাজনৈতিক ভাববে? সবাই মনে করবে, উপরে অরাজনৈতিক; আর ভেতরে ভেতরে রাজনীতি! বিশেষত নামধারী কিছু বক্তামার্কা নেতা। যাদের যোগ্যতা নিয়ে চিরকালই প্রশ্ন থেকে গেছে; এদেরকে কমিটিতে রাখা মোটেও ঠিক হয়নি। এরাই পরে লন্ডন ও বিভিন্ন দেশে চলে যায় বা আত্মগোপন করে।
০৯. সব কর্মসূচিই সফল হয় না। সফলতারও বিভিন্ন স্তর থাকে। কিন্তু ৫ তারিখের পরের দিন সকালে ত্বরিৎ একটি সাংবাদিক সম্মেলন করার দরকার ছিল। বিশ্ববাসীকে অবগত করানো প্রয়োজন ছিল- সেখানে কী হয়েছে। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্বিত হয়।
১০. অনেকেই বলে বেড়ান, হেফাজতের পতনের পেছনে বিএনপি-জামাতের হাত রয়েছে। এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা। সত্য হলেও বলা যাবে না। বাপ-মায়ের ঝগড়ার খবর বাহিরে এসে এলাকাবাসীকে জানোনো কি বুদ্ধিমানের কাজ? ধরে নিলাম যে, হেফাজতে বিএনপি-জামাতের লোকজন বা দালাল ছিল, তাহলে তো নিজেদের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। তখন প্রশ্ন উঠবে, এমন দালালদের সম্পর্কে অগ্রিম কিছু জানতে পারলেন না? আর এখন ওইসব দালালদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে? কিছুই হয়নি। সুতরাং অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, বিএনপি-জামাতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এ আন্দোলনের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। কারো নিয়তে আঘাত করা ইসলাম সমর্থন করে না।
১১. ১৩ দফা কর্মসূচির একটিও আজো বাস্তবায়ন হয়নি। দফাগুলো বাস্তবায়ন হয়ে গেলে বাংলাদেশ হযরত উমর রা. এর যুগে ফিরে যাবে। একজন মুসলমান হিসেবে এগুলোই আমাদের মনের কামনা। কিন্তু ভেবে দেখা দরকার, এমন কঠিন দাবিগুলো কি সরকার দিবে? এর পরিবর্তে সামগ্রিক জনগণ ও ইসলামের উপকার হয় এবং সরকারও সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে– এমন দাবি জানানো দরকার ছিল। যেমন :
* শিক্ষানীতিতে ইসলামবিরোধী ধারাগুলো বন্ধ হওয়া।
* নাস্তিকদের লেখাগুলো পাঠ্যপুস্তক হতে উঠিয়ে দেওয়া।
* বায়তুল মুকাররমে বিদআতির পরিবর্তে হকপন্থী খতিব নিয়োগ দেওয়া।
* ৬৪ জেলার প্রত্যেকটিতে একটি কওমি মাদরাসার জন্যে বিশাল জায়গা দেওয়া। এবং একটি কেন্দ্রীয় বোর্ড করার জন্যে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র জায়গা দাবি করা। মনে রাখতে হবে, কওমিওয়ালারা এদেশের সন্তান। তারাও সরকারকে ট্যাক্স দেয়। তাদেরও নাগরিক অধিকার রয়েছে।
* প্রত্যেকটি প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একজন নূরানি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করা।
* ঘোষিত নাস্তিক এবং আল্লাহ ও রাসুলকে নিয়ে কটাক্ষকারীদের কঠিন শাস্তি দেওয়া।
* আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলা উঠিয়ে নেওয়া।
* ইসলামবিরোধী আইন পাশ না করা।
* নারী-পুরুষের শিক্ষার ক্ষেত্র পৃথক করা। গার্লস স্কুল ও মহিলা কলেজ, মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা। বিশেষত বাংলাদেশে একটিও মহিলা মেডিকেল কলেজ নেই; সেদিকে সরকারের দৃষ্টিপাত করা।
* সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য না দেওয়া। হিন্দুদের হার হিসেবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া; যেমনটি ভারতের মুসলমানদেরকে দেওয়া হয়।
* বিটিসিএল ও টেলিটককে বেসরকারি অপারেটদের চেয়ে এগিয়ে নেওয়া। দুর্নীতির কারণে দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এগুতে পারে না।
* সুদ-ঘুষ ও নিয়োগবাণিজ্য বন্ধ করা। যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া।
* রেলযোগাযোগ উন্নত ও আধুনিক করা।
* বিশ্ববাজারে তেলের দামের সঙ্গে মিল রেখে ভাড়া বাড়ানো ও কমানো।
* গ্যাস ও বিদ্যুৎ জনগণের দোড়গোড়ায় পৌছে দেওয়া। এবং অযথা মূল্য বৃদ্ধি না করা।
এরকম জনমুখী ও গণমুখী দাবি উত্থাপন করা। এসব দাবি ইসলামেরই দাবি। এবং সকল অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। তাহলে জনগণ সত্যিই হেফাজতকে ভালোবাসবে। সরকারও নড়েচড়ে বসবে বলে আমার বিশ্বাস।
—
এখন কী করা দরকার?
হতাশা মুমিনের মর্যাদার পরিপন্থী। নতুনভাবে জেগে উঠতে হবে। শাপলার অবিচারের বিচার চাইতে হবে। কার কাছে চাইব বিচার? হুুকমের আসামির কাছে? শাপলার চেতনা মরতে পারে না, মরতে দিতে পারি না। এক শাপলা গাছ যেমন চিরদিন থাকে না। মাটি থেকে নতুন শাপলার চারা গজায়। আমরাও জেগে উঠতে চাই। যুগযুগান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শাপলার চেতনা জাগরূক থাকুক। শামেলীর চেতনা এসেছে শাপলায়। শাপলার চেতনা যাবে নতুন দিগন্তে, নতুন প্রান্তরে, নতুন রণক্ষেত্রে। শাপলার চেতনা বাস্তবায়নে যা করা দরকার :
০১. একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কমিটি। কমিটিতে প্রবীণদের পাশপাশি যোগ্য তরুণদের স্থান দিতে হবে। যারা কাক্সিক্ষত তাকওয়াবান হওয়ার পাশাপাশি আরবি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ, মিডিয়া সামাল দিতে উপযুক্ত এবং বহুমুখী যোগ্যতার অধিকারী হবে। হেফাজতের চেতনা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের ওপর নির্যাতনের কথা আরববিশ্বে প্রচার করতে পারে। আরবের সরকারগুলো ইসলামের সহযোগী না হলেও জনগণ ইসলামের সমর্থক। হাজার হাজার কোটি টাকা আফগান যুদ্ধে দিয়েছে আরব ভাই-বোনেরা। এখনও দিচ্ছে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। তাদের সহযোগিতা হেফাজতের প্রয়োজন। টাকা না পেলেও দোআ তো পাওয়া যাবে।
কেন্দ্রের পাশাপাশি প্রত্যেক জেলা, থানা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড- সম্ভব হলে পাড়া-মহল্লায়ও হেফাজতের কমিটি গঠন করা। প্রত্যেক কমিটিতে আলেম-ওলামাসহ সাধারণ শিক্ষিত ধর্মপ্রাণ মানুষও থাকবে।
০২. বলা হয়, মিডিয়া বর্তমানে দ্বিতীয় খোদা। মিডিয়ার কথা মানুষ গোগ্রাসে খাচ্ছে। ইসলামবিদ্বেষীদের প্রতিরোধ ও গতিরোধ করতে হলে মিডিয়া দখলের কোনো বিকল্প নেই। পত্রপত্রিকা থেকে টেলিভিশন সবই থাকতে হবে। নিজেদের মিডিয়াই কাম্য। এর আগপর্যন্ত সমমনা অন্যান্য মিডিয়া দিয়েই কাজ চালাতে হবে। বর্তমানে ইনকিলাব ও নয়া দিগন্ত ছাড়া আর কোনো পত্রিকা ইসলামপন্থীদের হাতে নেই। হেফাজতের নেপথ্য নায়ক দৈনিক আমার দেশের সংগ্রামী ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে জেল হতে মুক্তির ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে এ উদ্দেশ্যেই বৃহৎ আন্দোলনের ডাক দেওয়া।
০৩. হেফাজতের নামে বায়তুল মাল করা প্রয়োজন। দুনিয়া দারুল ওয়াসায়েল। আল্লাহর নুসরতের সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়াবি উপায়-উপকরণ যোগাড় করাও ইসলামের নির্দেশ। হেফাজতের কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাসিক ইয়ানতের টাকা কেন্দ্রে জমা হবে। হেফাজতের আন্দোলন, কর্মসূচি বাস্তবায়ন, আহত-নিহতদের পেছনে খরচ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন- ইত্যাদি খাতে এসব অর্থ ব্যয় হবে। হিসাব হবে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। শুধু দেশে না, বিদেশেও কমিটি গঠন করে ইয়ানত আদায়ের ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিগত উদ্যোগের চেয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ স্থায়ী ও কার্যকর হয় বেশি।
০৪. জনগণের উপকারে আসে- এমন সকল কর্মসূচি দিতে হবে। এমনকি রাস্তাঘাট উন্নয়নের দাবি নিয়েও মাঠে নামতে পারে। ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি, সেটাই করতে হবে।
০৫. হেফাজত চেষ্টা করবে বাংলাদেশের মুসলমানদের মাঝে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার। প্রত্যেক পথ ও মতের আলেম-উলামার সঙ্গে মতবিনিময় করবে। আন্দোলনে তাদের সহযোগিতা কামনা করবে। দোয়া চাইবে। ঐক্য বিনষ্ট হয় এমন কোনো কাজ হেফাজত করবে না। এমনকি আমি তো বিদআতিদের সঙ্গেও ঐক্য গড়ার পক্ষে। ভারতে মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ডের প্রতি খেয়াল করলে এ মতই দিতে হয়। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা সংখ্যালঘু, সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।
০৬. হেফাজতের ক্র্যাকডাউনের পর আমাদের চোখ খুলেছে। শত্রু-মিত্র চিনেছি। কারা কওমি মাদরাসাগুলো বন্ধ করতে চেয়েছিল? বিনা উস্কানীতেই মাদানীনগর এলাকায় তা-ব চালিয়েছিল কারা? ৫ তারিখের ট্রাজেডির পর অনেক ইমাম-খতিব ও মাদরাসার শিক্ষকের চাকরি হরণ করেছিল কারা? সরকারের স্পষ্ট ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের সমালোচনাও কারা সহ্য করতে পারে না? সমাজে এসব লোকই কওমি মাদরাসা ও মসজিদের কমিটি দখল করে আছে। তাদের বলয় থেকে মসজিদ-মাদরাসগুলোকে বের করে আনতে হবে। হ্যাঁ, তারাও যেহেতু মুসলিম, তাদেরকে সৎপথে আনার চেষ্টা করতে হবে; কিন্তু মাতব্বরি তাদের হাতে দেওয়া যাবে না।
আমার বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকায়। হেফাজতের পর বাড়ি গিয়ে শুনলাম, এলাকার আওয়ামীলীগের লোকজন ৬ তারিখ সকালে মিষ্টি বিতরণ করেছে! গফরগাঁওয়ের মাটিও আওয়ামীলীগ করে। নৌকা প্রতীকে কুত্তাকে দাঁড় করে দিলেও বিশাল ব্যবধানে পাশ করবে! আলেম-ওলামাবিদ্বেষীরাই আমাদের অভিভাবক!
০৭. সরকারের মূল লক্ষ্য ক্ষমতায় টিকে থাকা। তারা গণবিস্ফোরণকে ভয় পায়। তাই গণবিস্ফোরণ কাজে লাগিয়ে দাবি-দাওয়া আদায় করা মোক্ষম সুযোগ। সরকার, বিরোধী দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যথাসম্ভব সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। বাছাইকৃত কিছু নেতা তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে। সরকারের ভেতর নিজেদের লোক রাখার চেষ্টা করতে হবে। যেন প্রয়োজনে গোপন কোনো সংবাদ জানা যায়। সরকারের প্রত্যেকটি বিভাগেই লোক রাখার ব্যবস্থা থাকা দরকার।
০৮. কওমি মাদরাসাগুলোই দীনি ইলম প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। সুতরাং মাদরাসাগুলো সংরক্ষণে, মাদরাসার উন্নয়নে, পড়ালেখার উন্নয়নে হেফাজতের সার্বিক ভূমিকা রাখা দরকার। দক্ষ জনশক্তি না হলে আন্দোলনকে যুগের পর যুগ টেনে নেওয়া যাবে না। কওমি মাদরাসার সবগুলো বোর্ডের মাঝে সমন্বয় করে সিলেবাস ও শিক্ষাপদ্ধতি প্রণয়ন করাও হেফাজতের দায়িত্ব হওয়া উচিত।
০৯. মাদরাসার বাছাইকৃত মেধাবী কিছু ছাত্রকে স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশে- বিশেষত আরববিশ্বে পাঠানো দরকার। দীর্ঘদিন পড়াশোনা করার পর সেখানে থেকেই হেফাজতের কর্মসূচি বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করবে। সেখানের জনগণের কাছে হেফাজতের পরিচয়, কর্মসূচি ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবে। এছাড়া দেশেও উচ্চশিক্ষাবৃত্তি দিতে পারে। গরিবঘরের সন্তানরাই বড় হয়ে বিশেষকিছু হয়ে থাকে সাধারণত। ব্যতিক্রম সবসময়ই ব্যতিক্রম। বিশেষত দীনি শিক্ষায় গরিবদের অবদান অনেক বেশি।
১০. জনসেবায় হেফাজতের মনোযোগ দেওয়া দরকার। আঞ্জুমানে মুফীদুল ইসলামের মতো জনসেবায় নিয়োজিত হতে হবে। দরিদ্র জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। হাসপাতাল, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা উচিত।
১১. ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানও গড়া দরকার। অন্যথায় সরকারে কেবল ইসলামবিরোধীরাই জায়গা করে নিবে। ভারতে মাদানী পরিবারের তত্ত্বাবধানে অনেকগুলো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে স্কলাস্টিকা-অক্সফোর্টগুলো কাদের? সেখানে কী শিক্ষা দেওয়া হয়? ওইসব শিক্ষা গ্রহণ করার পর ইসলামবিদ্বেষী হবে না সুফি-দরবেশ হবে?
১২. আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং আর্থিক সহযোগিতা করা। শহীদদের খোঁজখবর নেওয়া। তাদের পরিবারে আর্থিক সহযোগিতা করা এবং তাদের পরিবারের ভরণপোষণ ও সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা। সার্বিক দায়িত্ব নেওয়া।
১৩. শহীদদের পরিচিতিযুক্ত স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা। ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণের দিক-নির্দেশনা, ভুলত্রুটিগুলো চিহ্নিতকরণ, মর্মান্তিক শাহাদাতগুলোর হৃদয়ছোয়া উপস্থাপনা এবং সমকালীন বিজ্ঞ আলেমদের অভিব্যক্তিসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়-সংবলিত একটি স্মারক প্রকাশ করা। যেন চেতনাগুলো সংরক্ষিত হয় ও ছড়িয়ে পড়ে।
—
শাপলার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে হেফাজতকে আরো শক্তিশালী করা সময়ের অনিবার্য দাবি। নিহতদের বিচার দাবি করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্যে ইসালে সওয়াব করা প্রয়োজন। আলহামদুল্লিাহ হচ্ছেও। শাপলা চত্বরের নাম বাদ দিয়ে শহীদি চত্বর রাখা যেতে পারে। এ দাবি উত্থাপন করাও অযৌক্তিক হবে না। স্বাধীনতার ৪৩-৪৪ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে শাপলার শহীদদের বিচারও ইনশাল্লাহ একদিন হবে।
বারবারই মনে রাখতে হবে, সরকারে কাছ থেকে কোনো দাবি আদায় করা সহজ ব্যাপার না। তুমুল জনপ্রিয় দল বিএনপি এবং বিপুল অর্থবিত্ত, দক্ষ জনশক্তি ও সর্বাধিক শৃঙ্খলিত দল জামায়াতকেও প্যাদানি দিতে ছাড়েনি বর্তমান ক্ষমতাসীন দল। তারা কি আমাদের মতো দুর্বলদের মূল্যায়ন করবে? আমাদের ন্যায্য অধিকার দিতে সম্মত হবে? হেফাজত কি এদেশে ভেসে এসেছে? পাকিস্তান কিংবা মায়ানমার থেকে সাগড়ে পাড়ি দিয়ে? এ দেশই আমাদের জন্মভূমি, এ দেশই আমাদের কবরস্থান। এদেশের সঙ্গেই আমাদের ভাগ্য জড়িত। সংখ্যালঘু হিন্দুদের সাথে দেবতার আচরণ করা হলেও আলেম-ওলামাদের সাথে দলিতদের মতো আচরণ করা হয় কেন? কেন এ বৈষম্য? নিজ দেশেও বনবাস? পরবাস?
রুখে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কথায় বলে, হুকুক দিয়ে নেহী যাতে, লিয়ে যাতে হ্যায় : অধিকার দেওয়া হয় না, আদায় করে নিতে হয়। সুতরাং অধিকার আদায়ের ভাষা অর্জন করুন। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।