মোহাম্মাদ তাসনিম : কওমি মাদরাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতির দাবী প্রায় দুই যুগের। নব্বইর দশকের দিকে আলোচনার সূচনা হয়। ২০০১ সালে চারদলীয় ঐক্যজোট সরকার গঠন করলে ইসলামী ঐক্যজোট চার দলের অন্যতম শরিক দল হওয়ায়; শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) জোটের শীর্ষ নেতা এবং বিখ্যাত জাদরেল তিন মুফতি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় স্বীকৃতির ব্যাপারে কওমি নেতৃবৃন্দ আশাবদী হয়ে উঠেন। নেতৃবৃন্দ জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে কওমি সনদের দাবী জানান। কিন্তু বেগম জিয়া প্রতিবার আলেম-উলামাদের হতাশ করেন। এক পর্যায়ে ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করে রাহবারে মিল্লাত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) স্বীকৃতির দাবীতে মুক্তাঙ্গনে অবস্থান করেন। দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম লাগাতার পাঁচ দিন রাস্তায় অবস্থান করলেও জোট নেত্রী বেগম জিয়ার মন গলেনি। এমনকি মুফতি শহিদুল ইসলাম ব্যতিত অন্য এমপিরা বেগম সাহবে রাগান্বিত হতে পারেন, ভবিষ্যতে আর নমিনেশন পাবেন না- এই শঙ্কায় শাইখুল হাদিস (রহ.)-এর সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ তো করলেনই না বরং নানা মহলে হুজুরের সমালোচনা করতে দ্বিধা করলেন না। অবশ্য ক্ষমতার শেষ দিকে জোট এবং ভোটের কথা মাথায় রেখে বেগম জিয়া তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুককে চেয়ারম্যান এবং শিক্ষা সচিব মোমতাজুল করিমকে সদস্য সচিব করে সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি টাস্কফোর্স গঠন করে সনদের সরকারি স্বীকৃতির ঘোষণা দিলেও কোনো গেজেট প্রকাশ বা অফিস দেওয়া হয়নি। বলা হয়নি স্বীকৃতির কোনো রূপরেখাও বলা হলো না। সাদা মুখে বলে দেওয়া হলো- স্বীকৃতি দিলাম।
পরে অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে একটি অসম্পূর্ণ গেজেট করানো হয়, কিন্তু কাজ আর হয় না। পরে সরকারের পরিবর্তন হলো, টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান এবং সদস্য সচিবরা অন্যকাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কেউ হলেন ক্ষমতাহীন। এভাবেই টাস্কফোর্সের কবর রচনা হয়। ওই টাস্কফোর্সের অন্য সদস্যরা হলেন- সর্বজন শ্রদ্ধেয় মরহুম খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক, শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, আল্লামা শাহ আহমাদ শফি, মুফতি আবদুর রহমান রহ., মাওলানা আব্দুল হালিম বোখারী, মাওলানা আযহার মোহাম্মদ আনোয়ার শাহ, মাওলানা আব্দুল জব্বার, মাওলানা আব্দুল বাসিত বরকতপুরী, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফি, মুফতি রুহুল আমীন এবং সরকারের একজন যগ্মসচিব ও মুফতি এমপিত্রয়।
সময়য়ের পরিবর্তনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন মহাজোট সরকার গঠন করে। সময় অতিবাহিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে দেশের শীর্ষ ৬২জন আলেম সরকার প্রধান শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত করেন। বিভিন্ন আলোচনার ফাঁকে স্বীকৃতির বিষয়টিও উঠে আসে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সনদের স্বীকৃতির জন্য একটা কমিশন গঠনের কথা বলেন এবং তা শুধু কওমি আলেমদেরই দিয়ে করা হবে এটা বলে দেন। বৈঠক শেষে সম্মিলিত কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মুফতি রুহুল আমিন সাহেব তাদের বোর্ড নেতাদের নামের তালিকা পেশ করে বেফাক নেতৃবৃন্দদের তাদের তালিকা দিতে বলেন। তারা মিটিং করে তালিকা দিবেন বলে বেরিয়ে আসেন এবং দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরেও তাদের থেকে কোনো তালিকা পাওয়া যায় না।
সময় অতিবাহিত হতে থাকে মুফতি রুহুল আমীন আলোচনা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। এ কাজে তাকে কখনও শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ কখনও মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ সহায়তা করেন। অবশেষে ৮ এপ্রিল ২০১২ সালে বেফাক তাদের নামের তালিকা প্রদান করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারী কোনো কর্মকর্তা ছাড়াই হাটহাজারী মাদরাসার মোহতামিম শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমাদ শফী (দা. বা.) কে চেয়ারম্যান এবং মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে কো-চেয়ারম্যান এবং গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মোহতামিম মুফতি রুহুল আমীনকে সদস্য সচিব করে শীর্ষ ১৭ জন কওমি আলেমদের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ সরকারী নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি কমিশন গঠন করে সরকারী গেজেট প্রকাশ করেন।
২৬ এপ্রিল ২০১২ হাটহাজারীর হুজুর লিখিত ভাবে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন। পরে ৪ জুন হাটহাজারীর হুজুরের সভাপতিত্বে কমিশনের প্রথম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মুফতি রুহুল আমীনকে আহ্বায়ক করে নেসাব এবং নেজামে তালীম সাব-কমিটি গঠন করা হয়।
কমিশন দীর্ঘদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে কওমি মাদরাসার স্বীকৃতির জন্য একটি নীতিমালা গঠন করে ১ ফেব্রুয়ারি সবার মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এবং বড় বড় মাদরাসায় পাঠানো হয়। খসড়া নীতিমালা দেখে প্রচুর মতামত আসে। সে সব মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে কমিশন একটি চূড়ান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করে। যাতে বলা হয় কওমি মাদরসার শিক্ষার স্তর হবে ছয়টি। যথা : ইবতিদাইয়্যাহ (প্রাথমিক), মুতাওয়াসসিতাহ ( নিম্ন মাধ্যমিক), সানাবিয়্যাহ আম্মাহ (এস, এস, সি), সানাবিয়্যাহ খাসসাহ (এইচ, এস, সি), মারহালাতুল ফযীলত (স্নাতক স্মান) ও মারহাতুত তাকমিল (দাওরা-ই-হাদিস-স্নাতকোত্তর)। প্রতেকটি স্তরে পরিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন সাটিফিকেট লাভ করবে।
কমিশন কওমি মাদরাসার শিক্ষাবর্ষ হিসেবে শাওয়াল মাসকে নির্ধারণ করে।
হিফজ, কেরাত, নারী ও বয়স্কদেও জন্য এবং তাখাস্সুসের জন্য আলাদা সুপারিশ পেশ করা হয়।
সুপারিশে মারহালাতুত তাকমিলকে (দাওরা-ই-হাদিস-স্নাতকোত্তর) মাস্টার্সের সমমান প্রদানের সুপারিশ করা হয়।
সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কমিশন বলে, বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ৫টি কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড এবং কওমি শীর্ষ উলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে একটি কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন করে দাওরা-ই-হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়ার এবং স্বতন্ত্র কওমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এ কর্তৃপক্ষ বহাল রাখা। এবং অন্যান্য স্তরের পরিক্ষা সার্টিফিকেটসহ যাবতীয় কাজ স্ব স্ব বোর্ড আঞ্জাম দিবে। তবে সকল বোর্ড সমন্বয় রক্ষা করে চলবে।
রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পট পরিবর্তনের কারনে কওমি মাদরাসা সরকারী স্বীকৃতির কারণে যেন তাদের স্বকীয়তা এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য না হারায় তার জন্য কমিশন কতিপয় শর্তারোপ করে। শর্ত সমূহ হলো-
১. কওমি মাদরাসার নেসাব এবং নেজামে তালীমে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
২. আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকীদা সম্পূর্ণভাবে অক্ষুন্ন রাখতে হবে।
৩. মাদরাসা পরিচালনা পদ্ধতিতে হস্তক্ষেপ করা চলবে না।
৪. কওমি মাদরসা কখনো এমপিওভূক্ত হবে না।
৫. কোন মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পাবে না।
৬. প্রচলিত কওমি মাদরাসা বোর্ডসমূহ তাদের স্ব স্ব বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
এভাবে একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করে ১৩ এপ্রিল ২০১৩ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
প্রিয় বন্ধুগণ! এই হলো আমাদের স্বীকৃতি যা আমরা নিতে চাচ্ছি। যদি এসব নীতিমালার ওপর স্বীকৃতি হয় তবে সমস্যা কোথায়? বিবেচনার ভার আপনার উপর রইল। আল্লাহ আমাদের সকল ভালো কাজে সহায় হোন। আমিন।
২২-০৮-২০১৬ তারিখে প্রদত্ত লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে ।