লিখেছেন: আতিকুর রাহমান
শারীরিক রোগ মানুষকে জাহান্নামে পাঠায় না, কিন্তু রোগগ্রস্থ কলবের কারণে মানুষ জাহান্নামী হয়। অজ্ঞতার কারনে অধিকাংশ মানুষ কলবের রোগকে আমলে নেন না। অথচ যে কোন একটি কলবের রোগ একজনকে জাহান্নামে নেয়ার জন্য যথেষ্ঠ। কলব বা অন্তরের রোগ সমূহের চিকিত্সা করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ। কলবের সংজ্ঞা প্রসংগে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : নিশ্চয়ই মানুষের দেহে এক টুকরা গোশত আছে, যখন তা পবিত্র হয় তখন সমস্ত দেহই পবিত্র হয়ে.যায়, আর যখন তা অপবিত্র হয়ে যায় তখন সমস্ত দেহই অপবিত্র হয়ে যায়, আর জেনে রাখ তা হল ক্বলব। (বুখারী ও মুসলিম)
আসুন এক নজরে কলব বা অন্তরের রোগ সমূহের মাঝে কয়েকটি জটিল রোগ সম্পর্কে জেনে নেই:
১) পরশ্রীকাতরতা বা হিংসা: অপরের সম্পদ, মান-মর্যদা ইত্যাদি দেখে হিংসা হওয়া এ রোগের লক্ষণ। এ রোগের কারণে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের বিরুদ্ধে নিজেকে উপস্থাপন করে । অর্থাৎ অমুকে আমার চেয়ে বেশি পেল, আমার নাই ইত্যাদি। অথচ এটাত আল্লাহ স্বয়ং তাকে এ নেয়ামতের অধিকারী করেছে ।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লাম সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কেননা, হিংসা মানুষের নেক আমল বা পুণ্যগুলো এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।’ (আবু দাউদ)
২) অহংকার: এটা অনেকটা এরূপ, আমি তার চেয়ে বড় আলেম, বড় কর্মকর্তা, আমার সামাজিক মর্যাদা বেশি, সম্পদ বেশি, আমার কোন ভুল নাই, ইত্যাদি। এ রোগকে অনেকে তাকাব্বরী বা আমিত্ব রোগ বলে থাকেন। অহংকার আল্লাহ রব্বুল ইজ্জতের চাদর। অহংকার করা আল্লাহর চাদর নিয়ে টানাটানি করার সামিল। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: “যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। একলোক বলল: যে কোন লোক পছন্দ করে তার জামাটা ভাল হোক, তার জুতাটা ভাল হোক? তিনি বললেন: নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর; তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। অহংকার হচ্ছে – সত্যকে উপেক্ষা করা এবং মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা।” [ সহিহ মুসলিম ]
৩) সম্পদের প্রতি মোহ: সবসময় সম্পদ বৃদ্ধির চিন্তা করা, সম্পদ গণনা করা, দীলের মাঝে সম্পদের চিন্তা এ রোগের প্রধান লক্ষণ। সম্পদশালী বেক্তির সাথে অধিক চলাফেরার বা মেলামেশার ফলে এ রোগ অপরের মাঝে সংক্রমিত হতে পারে। এ রোগের কারণে মানুষ চিরস্থায়ী আখেরাতকে ভুলে যায়, আল্লাহর শুকর আদায় থেকে বিমুখ হয়ে যায়,নিজেকে নানাবিধ গুনার কাজে (সুদ, ঘুষ, অপরের মাল ভক্ষণ বা কুক্ষিগত করা ইত্যাদি) জড়িয়ে ফেলে। এ রোগের আর এক ক্ষতিকর দিক, মানুষ মৃত্যুকে ভুলে যায়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লাম বলেছেন তোমরা দুনিয়ার স্বাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ কর। অর্থাৎ বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ না করলে, মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পরে।
৪) কু দৃষ্টি: আল্লাহ তালার প্রতি ভয় না থাকার কারণে, মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগের লক্ষণ হল বিপরীত লিঙ্গের প্রতি হারাম দৃষ্টি নিক্ষেপ। অর্থাৎ পুরুষ বেগানা নারীর প্রতি, আর নারীরা বেগানা পুরুষের প্রতি দৃষ্টিপাত করা। অন্তরের এ রোগের কারণে কাউকে কাউকে বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে নানা অজুহাতে স্পর্শ করার প্রবণতাও দেখা যায়।
কু দৃষ্টি অত্যন্ত ভয়াবহ একটি রোগ, ওলামাগণ কু দৃষ্টিকে শয়তান নিক্ষিপ্ত তীর বলে থাকেন। কু দৃষ্টির কারণে সমাজে নানা প্রকার অপরাধ ঘটে থাকে, তার মাঝে অন্যতম হল: অবৈধ প্রেম, দৈহিক সম্পর্ক, পরকিয়া, ধর্ষণ, নিকৃষ্ট হালাল – তালাক, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অবিশ্বাস, মানসিক অস্তিরতা এমনকি হত্যাকান্ডের মত বর অপরাধ। কু দৃষ্টির ফলে, মানুষের দীল থেকে ইবাদতের পরিতৃপ্তি উঠে যায় অর্থাৎ ইবাদতে কোন মজা বা শান্তি থাকে না।আর এভাবেই ধীরে ধীরে সে পথভ্রষ্ঠ হয়ে যেতে পারে। এ রোগের শুধু যুবক বা যুবতীদের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, অনেক বৃদ্ধ বেক্তিকেও এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
৫) রিয়া বা লোক দেখানো আমল : রিয়া বা লোক দেখানো আমল শিরক যা সর্ববৃহৎ গুনার কাজ। রিয়া রোগে আক্রান্ত বেক্তি সমাজে নিজের অবস্থান ও মান-মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যে বা নিজেকে ধার্মিক প্রমাণ করার জন্য রিয়া করে থাকে।
শয়তান সর্বাবস্থায় প্রত্যেক আমলকারীর পিছনে লেগে থাকে, তার আমল নষ্ট করার জন্য। যখন কেউ আমল করে ফেলে, শয়তান তখন শেষ চেষ্টা হিসাবে আমলকারীর দীলের মাঝে রিয়া প্রবেশ করিয়ে দেয়। যাতে তার আমল নষ্ট হয়ে যায়। এ রোগের আক্রান্ত হবার কারণগুলুর মধ্যে আমলকারীর অজ্ঞতা, শয়তানের আক্রমন অন্যতম। নিন্মে কয়েকটি প্রচলিত রিয়ার উদাহরণ দেয়া হলো:
ক) কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ দীর্ঘ করা
খ) পাব্লিছিটি করে আমল করা, যেমন যাকাতের নামে মাইকিং করে বা অভাবী লোকদের লাইনে দার করিয়ে লুঙ্গি শাড়ি দেয়া যাতে মানুষ দেখে আমলকারী অনেক দানবীর
গ) কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্যে মসজিদ-মাদ্রাসায় বা অভাবী লোকদেরকে দান করা
ঘ) দান করে ফটোসপ করে অপরকে আমলে আগ্রহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নয়, বরং নিজেকে জাহির করার উদ্দেশ্যে অপরকে দেখানো
আল্লাহ তাআলা মানুষের অন্তরের খবর রাখেন বিধায় একমাত্র সহিহ নিয়তের আমলকেই শুধু তিনি গ্রহণ করেন। আর যারা লোক দেখানো এবাদত করে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রিয়াকারীদের জন্যে অপেক্ষা করছে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি।
রিয়াকারীর পরিণতি সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদিস রয়েছে, যা অনেকেরই জানা । হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির বিচার করা হবে, সে হবে একজন (ধর্মযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী) শহীদ। তাকে আল্লাহর নিকট উপস্থিত করা হবে। অতঃপর আল্লাহ্ পাক তাকে (দুনিয়াতে প্রদত্ত) নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। আর সেও তা স্মরণ করবে। এরপর আল্লাহ্ তাআলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, দুনিয়াতে তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে সে বলবে, আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য (কাফেরদের সাথে) লড়াই করেছি। এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ্ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, বরং তোমাকে যেন বীর-বাহাদুর বলা হয়, সেজন্য তুমি লড়াই করেছ। আর (তোমার অভিপ্রায় অনুযায়ী) তোমাকে দুনিয়াতে তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে আদেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর সে ব্যক্তিকে বিচারের জন্য উপস্থিত করা হবে, যে নিজে দ্বীনী ইলম শিক্ষা করেছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে। আর পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করেছে (এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে)। তাকে আল্লাহ্ পাকের দরবারে হাজির করা হবে। অতঃপর তিনি তাকে নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন এবং সেও তা স্মরণ করবে। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এই সমস্ত নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে সে বলবে, আমি স্বয়ং দ্বীনী ইলম শিক্ষা করেছি এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টির নিমিত্তে কুরআন তেলাওয়াত করেছি। তখন আল্লাহ্ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আমার সন্তুষ্টির জন্য নয়, বরং তুমি এজন্য ইলম্ শিক্ষা করেছ, যেন তোমাকে ‘বিদ্বান’ বলা হয় এবং এজন্য কুরআন অধ্যয়ন করেছ, যাতে তোমাকে ‘ক্বারি’ বলা হয়। আর (তোমার অভিপ্রায় অনুযায়ী) তোমাকে বিদ্বান ও ক্বারিও বলা হয়েছে। অতঃপর (ফেরেশতাদেরকে) তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হবে। সুতরাং তাকে উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর এমন এক ব্যক্তিকে বিচারের জন্য আল্লাহ্র দরবারে উপস্থিত করা হবে, যাকে আল্লাহ্ তাআলা বিপুল ধন-সম্পদ দান করে বিত্তবান করেছিলেন। তাকে আল্লাহ্ তাআলা প্রথমে প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। আর সে তখন সমস্ত নেয়ামতের কথা অকপটে স্বীকার করবে। অতঃপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এই সমস্ত নেয়ামতের শুকরিয়ায় তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে সে বলবে, যে সমস্ত ক্ষেত্রে ধন- সম্পদ ব্যয় করলে তুমি সন্তুষ্ট হবে, তোমার সন্তুষ্টির জন্য সেসব খাতের একটি পথেও ব্যয় করতে ছাড়িনি। আল্লাহ্ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আমার সন্তুষ্টির জন্য নয়; বরং তুমি এই উদ্দেশ্যে দান করেছিলে, যাতে তোমাকে বলা হয় যে, সে একজন ‘দানবীর’। সুতরাং (তোমার অভিপ্রায় অনুসারে দুনিয়াতে) তোমাকে ‘দানবীর’ বলা হয়েছে। অতঃপর (ফেরেশতাদেরকে) তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হবে। নির্দেশ মোতাবেক তাকে উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে । [মুসলিম হা/১৯০৫, মিশকাত-আলবানী হা/২০৫] দুয়া (নিজ অন্তরের দিকে ও আল্লাহর প্রতি খেয়াল রেখে):
– হে আল্লাহ আমাদের অন্তর থেকে অহংকার দূর করে দাও
– হে আল্লাহ আমাদের অন্তর থেকে হিংসা দূর করে দাও
– হে আল্লাহ আমাদের অন্তর থেকে সম্পদের প্রতি মোহ দূর করে দাও
– হে আল্লাহ আমাদের অন্তর থেকে কু দৃষ্টির প্রবণতা দূর করে দাও
– হে আল্লাহ আমাদের অন্তর থেকে রিয়া দূর করে দাও
– হে আল্লাহ আমাদের অন্তর থেকে যাবতীয় অন্তরের রোগসমূহ দূর করে দাও
আমীন