শিক্ষার্থীদের জ্ঞান সাধনার এক বিশাল তীর্থস্থান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। প্রশ্ন আসতে পারে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কী? মরক্কোর ফেস নামক স্থানে ৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল মুসলিম বিশ্বে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম একটি আধ্যাত্মিক ও শিক্ষাবিষয়ক কেন্দ্র। এটি মূলত ইসলাম শিক্ষাবিষয়ক ধর্মভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়। মধ্যপ্রাচ্যে আল-কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়টি ইসলামিক বিশ্ব এবং ইউরোপের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ফাতিমা আল-ফিহরি আল-কারাউইন মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এটি বিশ্বের প্রাচীনতম সনদ বিতরণকারী বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখনও কাজ করছে। গ্রিনিস বুক অফ রেকর্ড অনুযায়ী এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বের প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ফাতিমা স্বয়ং নির্মাণকাজের তদারকি করেছিলেন এবং নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অনেক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
তিনি ২৪৫ হিজরি/৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের রমজান মাসে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকে শুরু করে প্রায় দুই বছর পর পুরো কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন রোজা রাখলেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে মসজিদ নির্মাণ শেষ করেছিলেন, অবশেষে সেই মসজিদে শুকরিয়া আদায় করে নামাজ পড়লেন।
মসজিদ আল-কারওয়াইন উত্তর আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ মসজিদ ছিল এবং এতে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল তা, মধ্যযুগে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হল। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুলসংখ্যক পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী পড়ালেখা করেছিলেন, যাঁরা মুসলিম ও ইহুদি বিশ্বকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ইবনে রাশেদ আল-সাবতি, আবুল-আব্বাস, আইনবিদ আল-ফাসি এবং বিখ্যাত লেখক ও পর্যটক লিও আফ্রিকানাস। এ ছাড়া আরও অনেক বিখ্যাত মনীষীর নাম এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত হয়ে রয়েছে- এরা হলেন মালিকি আইনবিদ ইবন আল-আরাবি (মৃ. ৫৪৩হি/১১৪৮খ্রি.), ঐতিহাসিক ইবন খালদুন (মৃ. ৮০৮ হি./১৪০৬খ্রি.) এবং জ্যোর্তিবিদ আল-বিতরুজি (মৃ. ১২০৪ খ্রি.)। মানচিত্রকার মোহাম্মদ আল ইদ্রিসী, যাঁর মানচিত্র রেনেসাঁর সময় ইউরোপিয়ানদের গবেষণা করতে সাহায্য করেছিল; তিনি এখানে পড়ালেখা করেছিলেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অমুসলিমদেরও ভর্তি করা হতো। প্রকৃতপক্ষে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ মানে আকৃষ্ট হয়ে অভারণের গারবার (Gerber of Auvergne) এখানে ভর্তি হয়েছিলেন। ইনি পরবর্তীকালে পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার হন এবং মধ্যযুগের ইউরোপে আরবি সংখ্যা ও শূন্যের ধারণার প্রচলন করেন। ইহুদি চিকিৎসাবিদ ও দার্শনিক মায়মোনাইডস এই বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম বিখ্যাত একজন ছাত্র ছিলেন, এখানকার ছাত্র ছিলেন বিখ্যাত পর্যটক ও লেখক রাবি্ব মুসিবিন মায়মন।
১৪ শতকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আল-কারাউইন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি গ্রন্থাগার হিসেবে এখনও বিরাজ করছে। এখানে ইসলামের বেশ কয়েকটি মূল্যবান পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে রয়েছে- হরিণের চামড়ার ওপর লেখা ইমাম মালিকের মুওয়াত্তা, ইবনে ইসহাকের সিরাহ, ইবন খালদুনের প্রধান রচনা আল-ইবার এবং ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আহমেদ আল-মনসুরের কাছ থেকে উপহার পাওয়া একটি কোরআন। ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে আল-কারাউইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রায় ১২০০ বছর পার হয়ে গেছে এবং এখনও এখানে ধর্মীয় এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্ররা স্নাতক অধ্যয়ন করছে এবং তাদের যথাযথ ডিগ্রিও প্রদান করা হচ্ছে। ১৪ শতকে এই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০০০ ছাত্র ছিল। কোরআন ও ফিকহ্ ছাড়াও এখানে অন্যান্য বিষয়, যেমন- ব্যাকরণ, চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, জ্যোর্তিবিদ্যা, ভূগোল এবং সঙ্গীত শিক্ষা দেয়া হতো। ক্রমশ আরও অন্যান্য বিষয়ও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, বিশেষত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা ও বিদেশী ভাষা।
অন্যদিকে পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অভিহিত করা হয় ভারতের বিহারে ৫০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘নালান্দা বিশ্ববিদ্যায়’-এর নাম। ইতিহাসের প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নালান্দা অন্যতম। ৫০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৮০০ বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলেছিল। আবার ৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মিসরের কায়রোতে স্থাপিত ‘আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়’কেও বিশ্বের প্রথম ও প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
সুত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ ও দৈনিক যুগান্তর