ইব্রাহিম খলিল : এই যে মৌলবি সাহেব, শোনো। প্রতিদিন এ পথে তুমি কোথায় যাও? হতভম্ব ছেলেটি থমকে দাঁড়ালো। মনে মনে ভাবলো—এ আবার কে? কেমন পাগলা মতন দেখা যায়। কিছুটা ভীতবিহ্বল কণ্ঠে সে বললো— কেনো খাবার আনতে যাই!
—প্রতিদিন একই পথে যাও কেনো, অন্যপথে যেতে পারো না? মাজযুব ধরনের লোকটি শুধালো।
—এপথে গেলে সামনে বাজার পড়ে না। আর বাজারের হরেক রকম জিনিস দেখলে মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, তাই এ পথে যাই। ছেলেটির সংক্ষিপ্ত উত্তর।
—আচ্ছা, মৌলবি সাহেব, তোমার মনে হয় টাকা-পয়সার অভাব, তাই না? ময়লা জামাকাপড় পরে আছো? এক কাজ করো, চলো একদিন তোমাকে স্বর্ণ বানানো শিখিয়ে দিই। তাহলে তোমার আর অভাব-অনটন থাকবে না। তুমি একসময় এসো আমার কাছে, আমি শিখিয়ে দেবো। দরবেশমতো লোকটি বললো।
—আচ্ছা, আসবো একদিন। বলে ছেলেটি তখনকার মতো চলে গেলো।
দরবেশের কথা অনুযায়ী অন্যসময় দেখা করার কথা বলে ছেলেটি চলে এলো। এসেই লেখাপড়ায় ডুবে গেলো। ভুলে গেলো দরবেশের সঙ্গে দেখা করার কথা। এভাবে কিছুদিন কেটে গেলো। আসা-যাওয়ার পথে আরেকদিন দরবেশের সঙ্গে দেখা।
—কী মিয়া মৌলবি সাহেব, তুমি তো এলে না? দরবেশের কণ্ঠে অনুযোগ ঝরে পড়লো।
—একদম ভুলে গেছি হযরত, আমাকে মাফ করবেন। ছেলেটি ওজরখাহি করলো। পরে অনুনয় করে বললো— এখন তো সময় নেই, আচ্ছা, শুক্রবারে আসবোখন। ছেলেটি তখনকার মতো বিদায় নিলো।
কিন্তু শুক্রবারেও দরবেশের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ভুলে গেলো। লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুতে মন নেই ছেলেটির। স্বর্ণ বানানোর রসায়নও তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। এবার দরবেশ যেচে তার সঙ্গে দেখা করলো। তিরস্কার করে বললো— মৌলবি সাহেব, তুমি তো কথা রাখলে না। আমি তোমাকে একটা জিনিস শিখিয়ে দিতে চাইলাম আর তুমি কিনা কোনো গুরুত্বই দিলে না।
—দেখুন, আসলেই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। ইনশাআল্লাহ, আগামী শুক্রবার যাবো। এই বলে ছেলেটি দরবেশকে বিদায় করলো। এভাবে আরো কয়েক শুক্রবার অতিবাহিত হলো। স্বর্ণ বানানোর রসায়ন শিখার জন্য তার যাওয়া আর হলো না।
অবশেষে এক শুক্রবার দরবেশ নিজেই তাকে নিতে এলেন। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন হযরত খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়ার দরবারে। সেখানে গিয়ে তাকে একটা গাছ দেখিয়ে বললেন, গাছটি ভালোভাবে চিনে নাও। আরো কোথায় কোথায় আছে তাও বলে দিলেন। এরপর গাছের কয়েকটি পাতা ছিঁড়ে নিয়ে এলেন এবং তাকে সামনে বসিয়ে সোনা বানানোর পদ্ধতি শিখিয়ে দিলেন। সেও পদ্ধতিটি ভালোভাবে রপ্ত করে নিলো।
সোনার টুকরোটি তিনি তকে দিয়ে বলে গেলেন, এটি দিয়ে তোমার প্রয়োজন পূরণ করবে। কিন্তু পড়ালেখার অত্যধিক ব্যস্ততায় তার সময় হয়নি টুকরোটি বাজারে নিয়ে বিক্রি করার। দ্বিতীয় দিন তিনি এসে জিজ্ঞাসা করলেন— মৌলবি সাহেব, সোনার টুকরোটি বিক্রি করেছো? সে ইতস্তত করছে দেখে তিনি বললেন— ঠিক আছে, দাও, আমিই বিক্রি করে দিই। তিনি টুকরোটি বিক্রি করে টাকাটা তার হাতে দিয়ে গেলেন। আর পইপই করে বলে গেলেন— মৌলবি সাহেব, আমি কিন্তু এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তুমি ওই গাছটা ভালো করে চিনে নাও। তিনি আবারো তাকে খাজা নিযামুদ্দীন আউলিয়ার মাজারে নিয়ে গেলেন এবং গাছটি চিনিয়ে দিলেন। পরে তিনি কোথায় যেনো চলে গেলেন।
এই ছেলেটি ছিলেন আল্লামা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ.।
(আপবীতী)