ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমার শামাইল গ্রামে হাজী শরিয়তুল্লা জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ও ইনতিকালের সঠিক তারিখ নির্ণয় করা যায় না। তবে, অনুমান করা যায় যে, আন্দাজ ১৭৭১ খৃস্টাব্দে (কারো কারো মতে ১৭৮০ বা ১৭৮১ সালে) তাঁর জন্ম হয়েছিল এবং ১৮৪০ সালে তাঁর ইনতিকাল হয়।
জনৈক আধুনিক লেখকের মতে আঠারো বছর বয়সে তিনি হজ্জ ব্রত সম্পাদনের জন্য মক্কা গিয়াছিলেন এবং প্রায় কুড়ি বৎসরকাল মক্কার শাফেয়ি মজহাবের তদানীন্তন প্রধান শেখ তাহের আস-সম্বল আল মক্কির শিষ্যরূপে ধর্মীয় শাস্ত্র পাঠ করেছিলেন। ১৮০২ খৃস্টাব্দের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কোন কোন লেখকের মতে তিনি ১৮২০ খৃস্টাব্দে দেশে ফিরেছিলেন। শেষোক্ত মত ভ্রান্ত বলে মনে হয়। এই পর্যন্ত বলা যায় যে ১৮০২ খৃস্টাব্দের পর তিনি বোধ হয় দ্বিতীয়বার হজ্জ করেছিলেন।
কথিত হয় যে, দেশে ফেরার পথে তিনি দস্যুদের কবলে পড়েছিলেন। ডাকাতেরা তাঁর সমস্ত বই-পুস্তক ও সঙ্গের অন্যান্য দ্রব্যাদি লুট করে ও তাঁকে দলে যোগ দিতে বাধ্য করে। অসহায় ও নিরুপায় অবস্থায় তিনি বাধ্য হয়ে ডাকাতদের দলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সরল জীবনযাত্রা ও গভীর ইমান দেখে দস্যুরা ডাকাতি ছেড়ে তাঁর অত্যন্ত অনুরক্ত শিষ্য হয়েছিল।
এরপর হাজী শরিয়তুল্লা বন্দরখোলা গ্রামে এসে ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। অল্পকালের মধ্যেই ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, ঢাকা, ময়মনসিং, নদীয়া জেলার পশ্চিমাঞ্চল এবং মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা অঞ্চলে তাঁর প্রভাব বিস্তার হয়। এই সকল অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক অধিবাসী তাঁর অনুসারী হয়। পরে প্রচার কার্যের সুবিধার জন্য তিনি বন্দরখোলা থেকে ঢাকা জেলার নয়াবাড়ীতে প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।
সম্ভবতঃ হাজী শিরিয়তুল্লা ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বন্দরখোলায় প্রচার কার্য আরম্ভ করেছিলেন। বাঙলার বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজের ভেতর থেকে সর্বপ্রকার ইসলাম বিরোধী প্রথা, আচার, আচরণ ইত্যাদি দূর করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। এ সময় হিন্দুদের মতো মুসলমান সমাজেও গুরুগীরি-চেলাগীরি, অর্থাৎ পীর-মুরিদি, খোনকারি, কবরপূজা, হোলি ও দুর্গাপূজায় যোগদান, বিবাহে পণপ্রথা, মহরম উৎসব পালন ইত্যাদি নানা প্রকার প্রথা দেখা দিয়েছিল। বহু তথাকথিত পীর এবং বাউল, ন্যাড়ার ফকির ইত্যাদির কবলে পড়ে মুসলমানেরা বহু ফেরকায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
এই সকল কুপ্রথার বিরুদ্ধে শরিয়তুল্লা তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি পীর ও মুরিদ শব্দের পরিবর্তে ওস্তাদ ও শাগরেদ শব্দ ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। তিনি কোন পীরের অন্ধ অনুকরণ ও অনুসরণের বিরোধী ছিলেন। প্রত্যেক শাগরেদকে অতীত পাপকার্যের জন্য তওবা করতে ও ভবিষ্যতে আল্লার অনুমোদিত পথে ধার্মিক জীবন যাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন; পীর ও কবর পূজা নিষিদ্ধ করেছিলেন; পৌত্তলিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার কার্য ও উৎসবে অংশগ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। উল্লেখ থাকে যে, তৎকালে হিন্দু জমিদারগণ দূর্গাপূজা ও অন্যান্য পূজা উপলক্ষে মুসলমান প্রজাদের নিকট অর্থ আদায় করতেন।
তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তাঁর অনুসারীরা সকলে সমান ও এক ঐক্যবদ্ধ জমা-আতভুক্ত। সেই হেতু, তাদের মধ্যে কেউ বিপন্ন হলে অন্য সকলে তাকে সাহায্য করতে বাধ্য।
হাজী শরিয়তুল্লা আরো ঘোষণা করেছিলেন যে, যেহেতু একমাত্র মুসলিম শাসিত রাষ্ট্রে ঈদ ও জুম-আর নামাজ সিদ্ধ, এবং যেহেতু সুবে বাঙলা মুসলিম রাষ্ট্র নয় সেই হেতু এখানে উক্ত নামাজ পড়া সিদ্ধ নয়।
হাজী শরিয়তুল্লার এই আন্দোলনকে ফারাজী আন্দোলন রূপে অভিহিত করা হয়। হাজী সাহেবের কোন কোন মতের সঙ্গে অন্য আলেমদের মতবিরোধ আছে। কিন্তু তাঁর এই সংস্কার আন্দোলনের ফলে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে যে এক নবজীবনের উন্মেষ হয়েছিল এবং সম্পূর্ণ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বাঙালী মুসলমানেরা যে দীর্ঘকাল সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিল, একথা অস্বীকার করার উপায় নাই।
সৌজন্যে : সঞ্চারণ