‘কওমি মাদরাসার প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এখন সময়ে দাবি । এ নিয়ে যুক্তি তর্ক থাকতে পারে । যারা এই আওয়াজ তুলেছেন, তাদের পদ্ধতিগত কিছু ভুল-ত্রুটিও হতে পারে । কিন্তু সংস্কার হতেই হবে ।’- সমকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ভাবনা শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এভাবেই তাদের মত ব্যক্ত করেছেন ।
কওমি মাদরাসার শিক্ষাকে আরও বিস্তৃত করার আহবান নিয়ে গতকাল (২৪ জুলাই) রবিবার ঢাকার আশকোনাস্থ হোটেল হলিডে এক্সপ্রেস (ঢাকা এয়ারপোর্ট সংলগ্ন হজ ক্যাম্পের সন্নিকটে)–এ বিকেল ৩.৩০টায় অনুষ্ঠিত হয় এক উন্মুক্ত সেমিনার । কমাশিসা [কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন] আয়োজিত এ অনুষ্ঠানটি পরিণত হয়েছিল তারকাদের মেলায়। সিলেট, ময়মনশাহী, চট্টগাম, যশোহর ও ঢাকার বরেণ্য আলেম-ওলামা, মুফতি-মুহাদ্দিস, লেখক-গবেষক, মিডিয়াকর্মী, মাদরাসা পরিচালকসহ নানা অঙ্গনের চিন্তক মানুষের প্রাণবন্ত উপস্থিতি অনুষ্ঠানকে করে তোলে উৎসবমুখর । যুক্তি-তর্ক আর প্রাপ্তি ও স্বপ্নের প্রাণখোলা আলাপনের মধ্য দিয়ে বক্তারা কওমি মাদরাসা নিয়ে তাদের গভীর ভাবনা ও হৃদয়ের আকুতির কথা তুলে ধরেন ।
প্রখ্যাত টিভি উপস্থাপক গাজী মুহম্মাদ সানাউল্লাহ ও প্রিয়.কমের ইসলাম বিভাগের এডিটর ইনচার্জ মাওলানা মিরাজ রহমানের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য জনাব ইয়াহইয়া চৌধুরী ইয়াহইয়া । তিনি বলেন, ‘কওমি মাদরাসাকে জঙ্গি প্রজননের কারখানা বলে এতোদিন বিভ্রান্ত করা হয়েছে । এখন সবাই বুঝতে পারছে যে, স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে দীনি ও নৈতিক শিক্ষা না দেয়ার কারণেই মূলত জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে ।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার কওমি মাদরাসার সংস্কার ও উন্নয়ন করতে আগ্রহী । আমারও একান্ত ইচ্ছা এর উন্নয়ন ও স্বীকৃতি আসুক । কিন্তু আলেমদের মধ্যে এ নিয়ে ঐকমত্য না থাকার কারণেই বারবার সেটা পিছিয়ে যাচ্ছে । তারপরও আমি আমার স্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো কওমি মাদরাসাকে মেইন স্টীমে নিয়ে আসার জন্যে ।’
প্রকৌশলী সাইয়েদ জুলফিকার জহুর বলেন, ‘আমি মাদরাসার মাওলানা । কিন্তু আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় প্রকৌশলী হিসেবে । কওমি মাদরাসা থেকে এভাবেই প্রকৌশলী, ডাক্তার, পাইলট, বিজ্ঞানী বেরিয়ে আসা দরকার । যেভাবেই হোক কওমি মাদরাসার সংস্কার হতেই হবে ।’
সৌদি আরবের পশ্চিম দাম্মাম ইসলামিক সেন্টারের দাঈ শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, ‘কমাশিসা যে উদ্যোগ নিয়েছে এটা প্রশংসনীয় । কিন্তু সংস্কার কাজে তাকে আরও বেশি সংযত হতে হবে । এবং একটি আদর্শ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি।’
মোহাম্মাদপুর কিশলয় বালিকা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ রহমতুল্লাহ বলেন, ‘যে যে-সেক্টরেই থাকুক, তাকে আগে মুসলিম হতে হবে । মাদরাসা হতে হবে কর্মুখী শিক্ষার আধার।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইতিহাসবিদ ও জাতীয় শিক্ষা প্রণয়ন কমিটির মেম্বার সিরাজ উদদীন আহমেদ বলেন, ‘আমরা দেশের একটি সার্বজনীন শিক্ষানীতি তৈরি করার জন্যে কয়েকবারই উদ্যোগ নিয়েছি । কিন্তু কওমি মাদরাসা ও আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের আন্তরিক সহযোগিতা না পাওয়ায় আমাদের শিক্ষানীতি অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে ।’ তিনি খুব শীঘ্রই কওমি মাদরাসার নেতৃস্থনীয় আলেমগণের কাছ থেকে একটি প্রস্তাবনা পাবেন বলেন আশাবাদ ব্যক্ত করেন ।
এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রেখেছেন বরেণ্য আলেম-উলামাসহ জাতীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ । উপস্থিত ছিলেন ড. মাওলানা শামসুল হক সিদ্দিক, শিক্ষক, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, গাজিপুর; একিউএম ছফিউল্লাহ আরিফ, সেক্রেটারি জেনারেল, সেন্ট্রাল শরীয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যংকস অব বাংলাদেশ; প্রফেসর ড. রফিক চৌধুরী, প্রিন্সিপাল অ্যান্ড চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল টেকনোলজি, উত্তরা, ঢাকা প্রমুখ ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বে করেন সভাপতিত্ব করবেন কমাশিসার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, আন নুর ইসলামিক স্কুল, সাউথ ইস্ট, লন্ডন–এর সম্মানিত চিফ এক্সিকিউটিভ খতিব তাজুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে একই সাথে ‘সার্বজনীন ও পূর্ণাঙ্গ ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা’ বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করা হয় এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় ১২ জন গুণীজনের হাতে ‘কমাশিসা সম্মাননা’ তুলে দেয়া হয় । এ ছাড়া দেশের তরুণ আলেম ওলামা, মুফতি-মুহাদ্দিস, লেখক-গবেষক, মিডিয়াকর্মী, মাদরাসা পরিচালকসহ নানা অঙ্গনের চিন্তবিদ মানুষকে ‘কমাশিসা শুভেচ্ছা’ শিরোনামের একটি করে নান্দনিক অভিনন্দনপত্র প্রদান করা হয় ।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে ইংল্যান্ড প্রবাসী খতিব তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কমাশিসা পোর্টালের মাধ্যমে আমরা কেবলে একটি সূচনা করতে চেয়েছি । আমরা চাই, দেশের মধ্যে চলমান এই দ্বিমুখী-ত্রিমুখী-চতুর্মুখী শিক্ষার অবসান ঘটুক । এখান থেকে যুগোপযোগী তরুণরা বের হয়ে আসুক ।’ তিনি অনুষ্ঠানের উপস্থিতিদের কাছে কমাশিসার ২১ দফা সম্বলিত বই হস্তান্তর করেন ।
অনুষ্ঠানে নবীন-প্রবীনদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন শায়খ মুফতি উছমান গণী, ধর্মীয় উপদেষ্টা, দৈনিক প্রথম আলো । উপস্থিত ছিলেন বেফাকের প্রশিক্ষণ সম্পাদক মুফতি এনামুল হক, বাংলা নিউজ২৪.কমের বিভাগীয় প্রধান মুফতি এনায়েতুল্লাহ, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহসম্পাদক মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব, মাদরাসা ইবনে খালদুনের প্রিন্সিপাল মাওলানা লাবীব আবদুল্লাহ, মাসিক পাথেয়’র সিনিয়ার সহকারী সম্পাদক মাওলানা মাসউদুল কাদির, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র আর্টিস্ট শাকির এহসানুল্লাহ, রাহবার মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান মুফতি সাইফুল ইসলাম, আমাদের সময়.ডমের বিভাগীয় প্রধান মুফতি হুমায়ুন আইয়ুব, আল-জান্নাত পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সাত্তার আল আইনী প্রমুখ ।
আরো উপস্থিত ছিলেন মুফতি জহীর ইবনে মুসলিম, সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ, মুফতি কাজী মুহাম্মাদ হানিফ, মাওলানা আশিকুর রহমান, প্রিন্সিপাল হাফিজ সাখাওয়াত হোসাইন, শাহ মুহাম্মাদ ফয়জুল্লাহ কাসেমী, মাওলানা তারিক আজিজ, মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর, ফয়সাল বিন আবুল কাসেম, মনযূরুল হক, মাওলানা রোকন রাইয়ান, মুফতি মহিউদ্দীন কাসেমি, শাকিল আদনান, ইফতেখার জামিলসহ আরও দেশ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ ।