বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১০:০৩
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / চার্চিল মুসলমান হতে চেয়েছিলেন

চার্চিল মুসলমান হতে চেয়েছিলেন

charchilমীযানুল করীম : চার্চিল আজো বিশ্বে একটি বহুল পরিচিত নাম। আধুনিক যুগের ব্রিটিশ রাজনীতি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রসঙ্গে তার নামটি গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয় এত বছর পরও। জাতীয়পর্যায়ে চার্চিলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, তার নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ তাকে ভয় করার কারণ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ স্বজন এক সময়ে একটা অস্বাভাবিক ভীতি বোধ করেছিল তাকে নিয়ে। তাদের ভয় জেগেছিল, চার্চিল ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যেতে পারেন। যদিও ধর্ম পালন করা-না-করা কিংবা ধর্মান্তরিত হওয়া-না-হওয়া পাশ্চাত্যের ‘উদার গণতন্ত্রী’ সমাজে মানুষের মৌলিক অধিকার, তবুও বিশেষ করে ‘ইসলাম-আতঙ্ক’ সেখানকার অমুসলিম সমাজের একটা মজ্জাগত ব্যাধি। চার্চিলের কোনো কোনো আত্মীয়ও অকারণে এই মানসিক রোগের শিকার হয়েছিলেন।

সম্প্রতি উদ্ধার হয়েছে এমন একটি চিঠি, যা চার্চিলকে পাঠিয়েছিলেন তার এক আত্মীয়। এতে ইসলামের প্রতি তার সুগভীর শ্রদ্ধার বিষয় প্রকাশ পেয়েছে। এটা ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যে কেবল বিস্ময় সৃষ্টি করেনি, সঙ্কীর্ণমনা অনেককে বিক্ষুব্ধও করে তুলেছে।

চার্চিলের রাজনৈতিক জীবনের প্রায় ৬০ বছর এবং মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পর জানা যাচ্ছে, তিনি ইসলাম ধর্ম এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মুসলিম ধর্মবিশ্বাসের প্রতি চার্চিলের শ্রদ্ধা এতই গভীর ছিল যে, আত্মীয়স্বজনের একাংশের আশঙ্কা ছিল চার্চিল আবার ‘মোহামেডান’ (মুসলমান) হয়ে যান কি না।

হবু ভাবীর সেই চিঠি 

লেডি গুয়েন্ডোলাইন বিয়ে করেছিলেন চার্চিলের ভাই জ্যাককে। বিয়ের আগে ১৯০৭ সালের আগস্ট মাসে এই ‘হবু ভাবী’ চার্চিলকে চিঠি দিয়েছিলেন। এটা কোনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয়ে নয়, চার্চিল যেন মুসলমান হয়ে না যান, তা নিশ্চিত করাই ছিল সে পত্রের উদ্দেশ্য। হবু দেবরকে ওই মহিলা বলেছিলেন ইসলাম আর মুসলমান সম্পর্কে তার ‘উৎসাহের লাগাম টেনে ধরতে।’
বিশ্বখ্যাত কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক ওয়ারেন ডকটার। সম্প্রতি তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিখানা আবিষ্কার করেছেন লেখার শতাধিক বছর পর। এতে দেখা যায়, গুয়েন্ডোলাইন লিখেছেন চার্চিলকে ‘প্লিজ, ইসলামে দীক্ষিত হয়ো না। তোমার হাবভাবে প্রাচ্যের প্রতি মুগ্ধতা লক্ষ করেছি। দেখেছি তোমার মধ্যে পাশাদের মতো প্রবণতা। সত্যিই এসব আমার নজরে পড়েছে।’

এখানে প্রাচ্য বা Orient বলতে মুসলিম দেশগুলোকে বোঝানো হয়েছে। আর ‘পাশা’ হচ্ছে, তুর্কিদের ওসমানিয়া (অটোম্যান) সাম্রাজ্যের রাজকীয় মর্যাদাপূর্ণ একটি পদবি।

লেডি গুয়েন্ডোলাইন উদ্বেগের সাথে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘যদি তুমি ইসলামের সংস্পর্শে আসো, তাহলে তুমি যতটা ভাবছ, এর চেয়ে অনেক সহজে তুমি মুসলমান হয়ে যাবে। দোহাই লাগে, তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি কী বলতে চাচ্ছি। এর (ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা) বিরুদ্ধে লড়ে যাও।’

অপর দিকে একই বছর চার্চিল লেডি লিটনকে লেখা এক চিঠিতে বললেন, ‘তোমরা আমাকে একজন পাশা বলে মনে করবে। আমার আশা, যদি পাশা হতে পারতাম।’ তখন চার্চিলের বয়স ৩৩ বছর।

‘পাশা’ হওয়া ছিল এক বিরাট মর্যাদা ও গৌরবের ব্যাপার। তুরস্কই শুধু নয়, তুর্কি শাসনের অধীনস্থ মিসরসহ বিভিন্ন অঞ্চলেও অনেক পাশার উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব ছিল। বর্তমান তুরস্কের ‘জাতির পিতা’ (আতাতুর্ক) মোস্তফা কামালের নামের সাথেও ছিল ‘পাশা’। তাকে নিয়ে নজরুলের কবিতা আর ইব্রাহিম খাঁর নাটকের নাম ‘কামাল পাশা’। তখনকার তুরস্কের আরেক বিখ্যাত সেনাপতি ও মুক্তিসংগ্রামী ছিলেন ‘আনোয়ার পাশা।’

চার্চিলের মতো তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু উইলফ্রেড এস ক্লান্টও আরব ঐতিহ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন। এই বন্ধু ছিলেন কবি এবং একই সাথে মুসলিম জাতির স্বার্থের একজন জোরালো সমর্থক। এটা খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এবং ইহুদিপ্রভাবিত পশ্চিমা দুনিয়ায় একটা ব্যতিক্রমী প্রবণতা বৈ কি।

চার্চিল আর ব্লান্ট দুই বন্ধু যখন একসাথে থাকতেন, দু’জনেই শার্টপ্যান্ট, সুট-টাই ছেড়ে আরবদের পোশাক জোব্বা-কাফিয়া পড়তেন। ইতিহাসবিদ ড. ডক্টার বলেছেন মুসলিম সংস্কৃতির বিষয়ে চার্চিলের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে ‘চার্চিল সুদানে এবং ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে (বর্তমানে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ) লড়াই করেছেন। অতএব ‘ইসলামি এলাকা’ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা প্রচুর।’

যখন চার্চিল মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছেন এবং এর মাত্রা দেখে ঘনিষ্ঠজন ‘আশঙ্কা’ করছেন, তিনি হয়তো ত্রিত্ববাদী খ্রিষ্টধর্ম বিসর্জন দিয়ে একত্ববাদী ইসলামের অনুসারীর পরিচিতি অর্জন করবেন, সে সময়টাতে চার্চিলের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা কেমন ছিল? এ ব্যাপারে জানা যায়, তত দিনে তিনি রক্ষণশীল ধারা ত্যাগ করে উদারপন্থী হয়ে উঠেছেন। ১৯০৪ সালে লিবারেল পার্টিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনে সূচিত হয় নতুন পর্বের। একজন গবেষকের ভাষায়, (তখন) উত্তর নাইজেরিয়াতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার, ফ্রেডারিক লুগার্ডের মতো কট্টর সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে চার্চিলের প্রচণ্ড বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল নীতিগত প্রশ্নে। নাইজেরিয়ার সে জনপদে ‘ইসলামি গোত্র’গুলোকে শাস্তি দেয়ার অভিযানে লুগার্ড নেমেছিলেন। চার্চিল এর বিরোধিতা করেন।

যে চিঠি চার্চিলের জীবনের অজানা দিক উন্মোচন করেছে এবং পাশ্চাত্যের ইসলামোফোবিয়া ইস্যুটিকে তুলে ধরেছে, এটি আবিষ্কৃত হলো গবেষণার সূত্রে। ইতিহাসবিশারদ ডকটার একটি বই লেখার জন্য গবেষণা করতে গিয়ে আলোচ্য পত্রটির সন্ধান পেয়েছেন। তার বইটির (যন্ত্র) নাম Winston Charchill and the Islamic World: Orientalism. Empire and Diplomacy in the Middle East (উইনস্টন চার্চিল ও ইসলামি বিশ্ব : প্রাচ্যবাদ, সাম্রাজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যে কূটনীতি)

ড. ডকটারের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘চার্চিল ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মকে সমান মর্যাদা দিতেন বলে প্রতীয়মান হয়। সমসাময়িককালের বিবেচনায় এতটা প্রগতিশীল মনোভাব থাকা বিস্ময়কর। তিনি অটোম্যান সাম্রাজ্যের সমরনৈপুণ্য আর সাম্রাজ্যবিস্তারের প্রশংসাও করেছেন।’
১৯৪০ সালের মে মাসে চার্চিল ব্রিটেনের মতো বৃহৎ শক্তির সরকার পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিশ্বযুদ্ধের প্রথম পর্বে তখন নাৎসি জার্মানির মোকাবেলায় ব্রিটেন তার ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময় অতিবাহিত করছিল। সে বছর অক্টোবরে রাজধানী লন্ডনের কেন্দ্রীয় এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাব চার্চিল অনুমোদন করেন। এ প্রকল্পের জন্য তিনি নির্ধারিত রেখেছিলেন এক লাখ পাউন্ড (এখনকার সোয়া কোটি টাকার মতো)। রিজেন্ট পার্কে লন্ডনের কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণকাজে তার সহযোগিতা ছিল অব্যাহত। সে দেশের জনগণের সমালোচনা সত্ত্বেও তার আশা ছিল, এ ভূমিকার ফলে মহাযুদ্ধের ক্রান্তিলগ্নে মুসলিম বিশ্বে ব্রিটেনের ভূমিকার প্রতি সমর্থন থাকবে। ১৯৪১-এর ডিসেম্বরে চার্চিল হাউজ অব কমন্সে বলেন, প্রাচ্য জগৎজুড়ে আমাদের অনেক মুসলিম বন্ধু এই মসজিদ নির্মাণের প্রশংসা করেছেন।’

চার্চিলের রাজনৈতিক ভূমিকায় স্ববিরোধিতাও ছিল। যেমন ভারত, মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক কোটি মুসলমানের ওপর শাসনের বেলায় তিনি সরাসরি সমর্থন করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে। লেখক হিসেবে চার্চিলের একটি বই The River War (১৮৯৯)। এতে বর্ণনা দিয়েছেন ভারত সীমান্ত এবং সুদানে যুদ্ধের অভিজ্ঞতার। বইটিতে তিনি উত্তর আফ্রিকার মাহদি আন্দোলনের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তাদের অভিহিত করা হয় মৌলবাদী ও চরম রক্ষণশীল হিসেবে। চার্চিলের ভাষায়, Mohammedanism তার অনুসারীদের ওপর কতই না ভয়াবহ অভিশাপ চাপিয়ে দিয়েছে।… ওদের লক্ষ্য নেই ভবিষ্যতের দিকে, কৃষিব্যবস্থা বাজে, ব্যবসায় বাণিজ্য মন্থর….. ধর্মের প্রভাব এর অনুসারীদের সামাজিক উন্নয়নকে অচল করে দিচ্ছে (How dreadful are the curses which Mohammedanism lays on its votaries….. Improvident habits, slovenly systems of agriculture, sluggish methods of Commerce…. The influnce of the religion paralyses the social development of those who follow it.)
চার্চিলের এই মন্তব্য সত্ত্বেও ড. ডকটার মনে করেন, বৃহত্তর মুসলিম জগত সম্পর্কে চার্চিলের মনোভাবের ঘনিষ্ঠ পর্যালোচনায় বলা যায়, এটা সমসাময়িক অনেকের স্রেফ সাম্রাজ্যবাদী ও ‘প্রাচ্যবিদ’ সুলভ মানসিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত।

চার্চিল উপরিউক্ত বইটি লিখেছেন তার কট্টর রাজনৈতিক ধ্যানধারণায় পরিবর্তন আসার কয়েক বছর আগে। এতে স্বাভাবিকভাবে একজন সাম্রাজ্যবাদীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। তবে তার অনন্য স্বাতন্ত্র্য হলো নিজের সামরিক জীবনের প্রথম দিকে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, এর আলোকে মুসলমান ও তাদের ধর্মীয় আদর্শের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও মহানুভবতাও ফুটে উঠেছে। এটাকে একজন লেখক বলেছেন, Uniquely Churchillian.

সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শত শত বছর ধরে খ্রিষ্টান, ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় বিরোধ কমবেশি থাকলেও সেটা যখন আরো তীব্র হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই চার্চিল খ্রিষ্টান হয়েও মুসলিম সংস্কৃতির অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন।

তবে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ব্রিটিশ পরাশক্তির প্রতিভূ হিসেরে চার্চিল আরব জগতের যে নয়া মানচিত্র গঠনে মদদ দিয়েছেন, সেটা ইসলামের সাথে পাশ্চাত্যের আজো বিদ্যমান সঙ্ঘাতের একটি বড় উৎস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধশেষে এবং ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের হাতে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যে পুরনো রাষ্ট্র ভেঙে নতুন নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয় পশ্চিমা স্বার্থে। এর জের ধরে মুসলিম জাহান বনাম পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব চলছে এখনো।

রাজনীতিক চার্চিল আর রহস্যময় ব্যক্তি টিই লরেন্স (যার পরিচিতি ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’) মধ্যস্থতা করে আরব দেশগুলোকে ‘বানরের পিঠাভাগ’ করেছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর প্রধানত ব্রিটিশ ও ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির আধিপত্যের সুবধার্থে এভাবে কথিত সুরাহা হয়েছিল। এরই পরিণাম আজকের সঙ্কটক্ষুব্ধ, যুদ্ধবিধ্বস্ত, রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত মধ্যপ্রাচ্য।
বর্ণাঢ্য জীবন : বিচিত্র অভিজ্ঞতা
চার্চিলের বাবা লর্ড র‌্যান্ডলফ চার্চিল রাজনীতিবিদ ছিলেন। মা জেনি জেরোমে ছিলেন মার্টিন মিলিয়নেয়ার লিওনার্ড জেরোমের কন্যা। জন্মের নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই চার্চিল ভূমিষ্ট হন। অর্থাৎ বাংলায় যাকে বলে ‘আটাশে’, তিনি ছিলেন সেটাই। চার্চিলের পিতামহ ছিলেন আয়ারল্যান্ডে ব্রিটেনের ভাইসরয়। তিনি পুত্রকেই (অর্থাৎ চার্চিলের বাবা) নিজের ব্যক্তিগত সচিব বানিয়েছিলেন। দুই থেকে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত চার্চিল ছিলেন আইরিশ রাজধানী ডাবলিনে। সেখানে তারা যে প্রাসাদে থাকতেন, সেটা এখন আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসবভন। এর সামনে দিয়ে সামরিক বাহিনী কুচকাওয়াজ করে যেত। শৈশবে এসব দেখেই সামরিক জীবনের প্রতি চার্চিলের আগ্রহ জন্মে বলে মনে করা হয়।

ডাবলিনে গৃহশিক্ষিকা চার্চিলকে লিখতে, পড়তে এবং পাটীগণিত শেখান। প্রথমে যে বইটি শিশু চার্চিল পড়েছিলেন, এর নাম Reading without Tears (কান্না ছাড়াই পড়া) তখন মা-বাবার সান্নিধ্যে তিনি তেমন আসতে পারেননি। এ সময়ে তাকে লালন-পালন করতেন মিসেস এলিজাবেথ অ্যান এভারেস্ট নামের ‘ন্যানি’। চার্চিল তার মাতৃতুল্যা এই মহিলাকে ‘Old Woom’  হিসেবে অভিহিত করেছেন।
স্বাধীনচেতা চার্চিল স্কুলজীবনে ভালো ছাত্র ছিলেন না। এ জন্য শাস্তিও পেয়েছেন। দু’টি স্কুলের পর্ব শেষ করে ১৮৮৮ সালে হ্যারো স্কুলে ভর্তি হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরই সৈনিক জীবনে পদার্পণ করেন।

ছাত্রজীবনে মায়ের সাথে সাক্ষাৎ ঘটত কমই। তাই মাকে চিঠি লিখতেন, যাতে তিনি এসে ছেলেকে দেখে যান, নতুবা ছেলেকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেন। বাবার সাথেও চার্চিলের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল না। তিনি বলেছিলেন, ‘বাবার সাথে কথা বলেছি কদাচিৎ।’ বাবা মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৮৯৫ সালে মারা যান। চার্চিল বিশ্বাস করতেন দৃঢ়ভাবে, তিনিও তরুণ বয়সে মারা যাবেন। এ জন্য তিনি পৃথিবীতে নিজের ছাপ রেখে যাওয়ার জন্য দ্রুত কাজ করা উচিত বলে মনে করতেন। ২০ বছর বয়সে এমন ধারণা হলেও চার্চিল এরপরও ৭১ বছর জীবিত ছিলেন।

উইনস্টন লিওনার্ড স্পেনসার চার্চিল তার পুরো নাম। সংক্ষেপে ‘চার্চিল’ নামে আজো বিশ্বে সুপরিচিত। নামের আগে ‘স্যার’ তো আছেই, নামের শেষে উপাধি ও পদবি অন্তত সাতটি। সংক্ষেপে সেগুলো হলো কেজি, ওএম, সিএইচ, টিডি, ডিএল, এফআরএস এবং আরএ। জন্ম ১৮৭৪ সালের ৩০ নভেম্বর। দীর্ঘায়ু এই ব্যক্তিত্ব পরলোকগমন করেন ১৯৬৫ সালের ২৪ জানুয়ারি।

চার্চিল দু’দফায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং বিশ্বযুদ্ধের পাঁচ বছরে নিজ জাতিকে দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কিন্তু তার বড় পরিচয় হলো এর আগে ব্রিটেনের কোনো সরকারপ্রধান নোবেল প্রাইজে ভূষিত হননি। তদুপরি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ‘অনারারি সিটিজেন’। তার রাজনৈতিক প্রতিভার চেয়ে লেখনী প্রতিভা যে কম ছিল না, এর প্রমাণ সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে গণ্য পুরস্কারটি অর্জন। তিনি ছিলেন সেনাকর্মকর্তা ও ইতিহাস গবেষক।

ডিউক অব মার্লবোরোর অভিজাত পরিবারে চার্চিলের জন্ম। পিতা লর্ড র‌্যান্ডলফ চার্চিল ছিলেন কারিশমাসম্পন্ন রাজনীতিক, যিনি একসময়ে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তরুণ সেনা অফিসার চার্চিল ভারত, সুদান ও দক্ষিণ আফ্রিকায় যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ সম্পর্কিত রিপোর্টিংয়েও তিনি খ্যাতি পেয়েছেন।

অর্ধশতাব্দী ধরে ব্রিটেনের রাজনীতিতে চার্চিল ছিলেন প্রথম সারিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই স্বরাষ্ট্র সচিব, বোর্ড অব ট্রেড সভাপতি এবং নৌবাহিনী-সংক্রান্ত উচ্চ পদে ছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধে বহুলালোচিত, গ্যালিপলির যুদ্ধে বিপর্যয় ঘটলে তিনি নৌবাহিনীর দায়িত্ব ত্যাগ করেন। এরপর সেনাবাহিনীর ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার ছিলেন পশ্চিম রণাঙ্গনে। তারপর যুদ্ধ ও সমরাস্ত্র বিষয়ে মন্ত্রিসভা ও সচিবালয়ে উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবার মতো তিনিও অর্থমন্ত্রী ছিলেন (১৯২৪-২৯)। এ পদে ছিলেন রক্ষণশীল দলের শাসনামলে।

বিশ ও ত্রিশের দশকে চার্চিল একাধিক কারণে বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি ১৯২৫ সালে পাউন্ড স্টার্লিংকে স্বর্ণমানের দিক দিয়ে বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তীপর্যায়ে ফিরিয়ে নেন। কিন্তু এ পদক্ষেপ জাতীয় অর্থনীতিকে চাপে ফেলছিল বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হতো। চার্চিল গণতন্ত্রের বিরাট প্রবক্তা হলেও তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ, ভারতবর্ষে স্বরাজ প্রদানের উদ্যোগের বিরোধিতা করেন। ১৯৩৬ সালে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড, প্রেমের বেলায় ঐতিহ্যভঙ্গের জের ধরে সিংহাসন ত্যাগ করেন। চার্চিল তা ঠেকানোর চেষ্টা করে আবার বিতর্কিত হয়েছিলেন।

ত্রিশের দশকে চার্চিল রাজনীতিতে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। তবে এ সময়ে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি এবং ব্রিটেনের আবার অস্ত্রসজ্জার পক্ষে প্রচারণার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটিশ জাতিসহ বিশ্বের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনলেও রাজনীতিক হিসেবে চার্চিলের যেন ‘বরাত খুলে দিয়েছিল।’ ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনার পর চার্চিল দ্বিতীয়বারের মতো হলেন ফার্স্ট লর্ড অব দ্য অ্যাডমিরালটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও এ পদে ছিলেন। ১৯৪০ সালের ১০ মে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বার লেইন পদত্যাগ করলে চার্চিল এ পদে অধিষ্ঠিত হন। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলার বাহিনী ব্রিটেনে বিমান হামলা চালিয়েছিল। খোদ লন্ডনও রেহাই পায়নি এর হাত থেকে। কিন্তু চার্চিলের অনমনীয়তা সে দুর্দিনে জাতিকে সাহস ও মনোবল জুগিয়েছে। তিনি নাৎসি প্রতিপক্ষের কাছে পরাজয় বা আত্মসমর্পণ তো দূরের কথা, ওদের সাথে কোনো ধরনের আপসেও রাজি ছিলেন না। তার এমন দৃঢ়তায় ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনী প্রেরণা লাভ করে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোরদার করে তুলেছিল। স্মরণ করা যেতে পারে, বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকের সে দিনগুলোতে হিটলারের জার্মানির মোকাবেলায় ব্রিটেনের সাথে তার অধীনস্থ উপনিবেশতুল্য দেশগুলোই শুধু ছিল। তখনো যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেয়নি এ যুদ্ধে। ১৯৪৫ সালে জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির চূড়ান্ত পরাজয় নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত চার্চিল ব্রিটিশ সরকারকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।

যে নেতার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ব্রিটিশ জাতি বিশ্বযুদ্ধের মহাবিপদ মোকাবেলা করেছে, সে চার্চিলকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল অচিরেই। তিনি ’৪৫ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। বিজয়ী শ্রমিক দলের অ্যাটলি হলেন নয়া প্রধানমন্ত্রী যিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পথকে সুগম করেছিলেন। অদম্য চার্চিল ৭৭ বছর বয়সে, পরবর্তী নির্বাচনে ঠিকই বিজয়ী হলেন। তার নেতৃত্বে রক্ষণশীল দল ’৫১ থেকে ’৫৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।’

উইনস্টন চার্চিল ১৯৬৫ সালে মারা যাওয়ার পর রানী এলিজাবেথ রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুমোদন দিয়ে তাকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছিলেন। এ উপলক্ষে যে সমাগম ঘটেছিল, তা ছিল ইতিহাসে বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের বৃহত্তম সমাবেশগুলোর একটি। মৃত্যুর তিন যুগ পর ২০০২ সালে এক জরিপে চার্চিলকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটন’ (ব্রিটিশ জাতির সদস্য)-এর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সে দেশের প্রধানমন্ত্রীদের ওপর পরিচালিত জরিপের ফলাফলে তো বটেই, তাকে ব্রিটিশ ইতিহাসের সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজনরূপে গণ্য করা হয়।
ব্রিটিশ জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসে এডমন্ড বার্ক, গ্লাডস্টোন, ডিজরেইলির মতো বিশ্ববিখ্যাত বাগ্মীরা হয়ে আছেন স্মরণীয়। এই ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হলেও চার্চিল কিন্তু বাগ্মী ছিলেন না। বরং তোতলাতেন অনেক সময়ে। ‘চার্চিল সেন্টার অ্যান্ড মিউজিয়াম’ বলেছে, বেশির ভাগ নথিপত্র থেকে জানা যায়, চার্চিলের বাকজড়তা ছিল, তবে তার তোতলানোর কথাটা কিংবদন্তি।’ তার এই ত্রুটি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। সমকালীন ও পরবর্তীকালের সাংবাদিকেরা এই দুর্বলতার উল্লেখ করেছেন। এমনকি বিশ ও ত্রিশের দশকের লেখকেরা মন্তব্য করেছেন, ‘চার্চিল এত বেশি তোতলাতেন যে, তা ছিল ‘উদ্বেগজনক।’ তিনি নিজে বাকজড়তার কথা স্বীকার করেছেন এবং তা কাটিয়ে ওঠার প্রয়াসও পেয়েছেন। বক্তৃতায় সহায়ক হয়, এমন কৃত্রিম দাঁত তিনি ব্যবহার করতেন। বহু বছর তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বক্তৃতা দিয়েছেন, যা সতর্কতার সাথে প্রস্তুত করা হতো। এভাবে তার যে সাফল্য আসে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, My impediment is no hindrance (প্রতিবন্ধকতা আমার জন্য বাধা হতে পারেনি)

চার্চিলের বাকপ্রতিবন্ধকতা থাকলেও তিনি ছিলেন সুরসিক ও বাকপটু ব্যক্তি। উপস্থিত বুদ্ধি বা রিঃ ছিল তার সহজাত। তার অনেক উক্তি স্মরণীয় হয়ে আছে এ জন্য।

 সৌজন্যে : অন্যদিগন্ত

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

আদালতের ওপর বিশ্বাস ভেঙে গেছে: সায়্যিদ মাহমুদ মাদানী

নাজমুল মনযূর: আদালতের ওপর বিশ্বাস ভেঙেছে ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা সেই মুসলমানদের। এমন কথাই ...