হীদার শ’ : সবচেয়ে বিনয়ী মানুষটির জন্যও সমালোচনার মোকাবেলা করা কঠিন হতে পারে বিশেষ করে যদি এটা হয় অন্যায়ভাবে কিংবা ভুল পদ্ধতিতে। এ ধরনের সমালোচনা প্রায় সময়ে ছুরির মতো গভীর ও বিষাক্ত ক্ষত সৃষ্টি করে; আর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যেও তৈরি করে বিভেদ।
সমালোচনাকে সবিনয়ে গ্রহণ করাই শুধু নয়, বরং এটাকে ইতিবাচক ফল লাভের জন্য ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন দৃষ্টান্তস্বরূপ।
একদিন একজন ইহুদি ধর্মযাজক যায়েদ ইবনে সানাহ মহানবী সা:-এর কাছে এলেন তার থেকে নেয়া ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য। তিনি নবীজী সা:-এর কাঁধ বরাবর তাঁর জোব্বা ধরে খুব জোরে টান দিলেন এবং কর্কশভাবে বললেন ‘তুমি আবদুল মুত্তালিবের বংশধর আমার পাওনা পরিশোধে টালবাহানা করছো।’
রাসূল সা:-এর অন্যতম সাহাবী হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা: এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ওই যাজককে ভর্ৎসনা করলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর দুশমন, তুমি কি এভাবে আল্লাহর রাসূল সা:-এর সাথে কথা বলছ আর আচরণ করছ? যিনি তাঁকে সত্যসহকারে পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম খেয়ে বলছি, যদি বেহেশত হারানোর আশঙ্কা না থাকত, আমি তরবারি দিয়ে তোমার গর্দান থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতাম।’
রাসূলুল্লাহ সা: মুচকি হাসছিলেন। তিনি উমর রা:-কে বললেন, এই মানুষটি তোমার কাছ থেকে উত্তম আচরণ লাভের যোগ্য। তোমার উচিত ছিল অবিলম্বে ঋণ পরিশোধের জন্য আমাকে বলা এবং নম্রভাবে দাবি পেশ করার জন্য তাকে বলা।
এরপর (ঋণদাতা) যায়েদের দিকে ফিরে রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ঋণ শোধ করার নির্ধারিত সময়ের এখনো তিন দিন বাকি আছে। একই সাথে তিনি উমর রা:-কে বললেন ঋণের অর্থ শোধ করে দিতে। আরো বললেন যায়েদের যা প্রাপ্য, তাকে তার চেয়েও বেশি দিতে। এই অতিরিক্ত পরিমাণটা হলো যায়েদের প্রতি তাঁর হুমকির ক্ষতিপূরণ।
এ ঘটনায় মহানবী মুহাম্মদ সা: কোনো আত্মরক্ষামূলক মনোভাব দেখাননি। এটা জানা ছিল যে, তিনি কখনো নিজের স্বার্থে ক্রুদ্ধ হবেন না। বরং মহান আল্লাহ তালার নির্ধারিত সীমা কোনোভাবে লঙ্ঘন করা হলে কেবল আল্লাহর স্বার্থেই তিনি ক্রোধ প্রকাশ করতে পারেন।
উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা রা: বলেছেন, রাসূল সা: কখনো নিজের জন্য প্রতিশোধ নেননি; যে পর্যন্ত না আল্লাহতায়ালার মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। তখন তিনি আল্লাহর স্বার্থে প্রতিশোধ নিতেন (আল বুখারী)।
ইস্যুটিকে ব্যক্তিগত ব্যাপার হতে না দিয়ে নবীজী সা: সমালোচনার যুক্তিসম্মত মূল্যায়ন এবং যথাসময়ে ঋণ শোধের দায় নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও তিনি এটা পরিশোধে দেরি করেননি, তাঁর প্রতিক্রিয়া শুধু সমস্যাটা নিরসন করে দেয়নি। সেই সাথে, এতে এমন সুফল অর্জিত হয়েছে, যা কোনো দিন পাওয়া যেত না, যদি তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে বাঁচাতে চাইতেন।
হজরত উমর রা: ক্ষতিপূরণসমেত ঋণ শোধ করতে গেলেন যায়েদের কাছে। তখন যায়েদ বললেন, ‘এসব আবার কী?’ উমর রা: জবাব দিলেন, আল্লাহর রাসূল সা: আমাকে আদেশ দিয়েছেন, যাতে আমি এটা আপনাকে শোধ করে দিই; কারণ আমি আপনাকে ভীতি প্রদর্শন করেছি।’
উমর রা: যায়েদকে জিজ্ঞেস করলেন, রাসূল সা:-এর সাথে এভাবে আপনি কথা বলার কারণ কী? তিনি উত্তর দিলেন, আমি আল্লাহর রাসূলের মুখমণ্ডলে নবুওয়াতের সব চিহ্নই দেখেছি দু’টি ছাড়া। এই দু’টি চিহ্ন হলো, তাঁর অজ্ঞতার চেয়ে ধৈর্যই বেশি ফুটে উঠবে। দ্বিতীয়ত, আপনি তার প্রতি যত রূঢ় হয়ে উঠবেন, তিনি তত বেশি দয়ালু ও ধৈর্যশীল হবেন। আমি এখন সে দু’টি চিহ্নও দেখতে পেয়েছি। হে উমর, আমি আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি, কেবল আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রকৃত স্রষ্টা নেই যিনি উপাসনা করার যোগ্য এবং মুহাম্মদ তাঁর বার্তাবাহক। আমি আপনাকে সাক্ষী মেনে আরো বলছি, আমি মদিনার সবচেয়ে ধনাঢ্যদের অন্যতম এবং আমার সম্পদের অর্ধেক আল্লাহর ওয়াস্তে সমগ্র মুসলিম সমাজকে দিয়ে দিলাম (আল-হায়ছামি)।
আরেক ঘটনায়, একটা যুদ্ধের পরে রাসূল সা: জনগণের মধ্যে যুদ্ধলব্ধ মালামাল বণ্টন করতে শুরু করলেন। প্রথমেই যারা এটা পেলেন এবং পেলেন সর্বাধিক, তারা হলেন নওমুসলিম। এদের দেয়ার কাজ শেষ হলে রাসূলুল্লাহ সা: এ ধরনের আরো মালামাল সংগ্রহ করে লোকজনকে ডাকার জন্য যায়েদ বিন ছাবিতকে আদেশ দিলেন। দূরদর্শিতার সাথে এগুলোর বিতরণের কাজ সম্পন্ন হলো। তবে সবাই এটা উপলব্ধি কিংবা এর প্রশংসা করলেন না। মদিনার কিছু লোক তাদের হিস্যার ব্যাপারে আপত্তি জানালেন।
হজরত সা’দ ইবনে উবাদাহ রা: রাসূল সা:-এর কাছে না যাওয়া পর্যন্ত অসন্তোষ অভিযোগে রূপ নেয়। সা’দ তাকে বললেন, হে আল্লাহর নবী সা:, যুদ্ধের মালামাল বণ্টনের বিষয়ে (মদিনার অধিবাসী) এই আনসারদের গ্রুপটি মর্মাহত। আপনি নিজের আত্মীয়স্বজনকে এই মালামাল দিয়েছেন। আরব গোত্রগুলোকে দিয়েছেন বহু উপহার। অথচ আনসারদের জন্য রাখলেন না কিছুই।
রাসূল সা: জিজ্ঞেস করলেন, সা’দ, তুমি কী মনে করো? সা’দ রা:-এর জবাব : হে আল্লাহর রাসূল সা:, আপনি জানেন যে, আমি আনসারদের একজন সদস্য। রাসূল সা: তাঁকে নির্দেশ দিলেন, তোমার লোকজনকে নিয়ে আসো। এই পর্যায়ে যে কারো মনে হতে পারে যে, যুদ্ধেপ্রাপ্ত মালামাল বণ্টনের ক্ষেত্রে রাসূল সা:-এর ন্যায়বিচারকে সন্দেহ করায় তিনি তাদের ভর্ৎসনা করবেন অথবা তাঁর সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণের দরুন তিনি তাদের শাস্তি দেবেন। কিন্তু যখন লোকজন জড়ো হলো রাসূলুল্লাহ সা: তাদের মুখোমুখি হলেন, তাদের জানালেন ধন্যবাদ আর প্রশংসা করলেন আল্লাহতায়ালার।
এরপর মহানবী সা: সমাগত লোকজনকে বললেন, আমাকে জানানো হয়েছে যে, তোমরা আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছো। তোমরা যখন ছিলে পথভ্রষ্ট, তখন কি আমি তোমাদের কাছে আসিনি? আর আল্লাহ কি তোমাদের সুপথ দেখাননি? তোমরা তো গরিব ছিলে; আল্লাহ তোমাদের সম্পদ দিয়েছেন। তোমরা কি একে অন্যের শত্রু ছিলে না এবং এখন তোমাদের পরস্পরকে ভালোবাসার মতো অবস্থা কি তিনিই তৈরি করে দেননি?
তারা জবাব দিলো, হ্যাঁ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: উত্তম এবং বেশি দয়ালু। এরপর মহানবী সা: বললেন, হে আনসারগণ! আল্লাহর নবীর কাছে জবাব দেয়া থেকে তোমাদের কিসে বিরত রাখে?’ তারা বলল, আল্লাহর রাসূল সা:, জবাব আর কী হবে, যখন সব দয়া ও করুণা মহান প্রভু আর তাঁর রাসূল সা:-এর?
রাসূল সা: বললেন, আল্লাহর কসম, তোমাদের জবাবের সত্যতা পরীক্ষা করে দেখতাম, যদি তোমরা বলতে, আপনাকে ভুল বুঝে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। তখন আপনি আমাদের কাছে এলেন আর আমরা আপনাকে নিলাম গ্রহণ করে। আপনি এসেছিলেন অসহায় অবস্থায়; আর আমরা আপনাকে সাহায্য করলাম। আপনি ছিলেন পলাতক; আমরা আপনাকে আশ্রয় দিলাম। ছিলেন গরিব; আমরা আপনার দুর্ভোগ দূর করলাম।’
মহানবী সা: আরো বললেন, হে আনসারগণ! তোমরা যে ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে দিকে আকৃষ্ট করতে ওই লোকগুলোকে যা দিয়েছি, তোমরা কি দুনিয়ার সে ধনসম্পদের আকাক্সক্ষা করো? অন্যরা ভেড়া ও উট নিয়ে বাসগৃহে ফিরবে, আর তোমরা ফিরে যাবে আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে; এতে কি তোমরা সন্তুষ্ট নও? যাঁর হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম খেয়ে বলছি, যদি কোনো হিজরত না ঘটত, আমি হতাম আনসারদের একজন। যদি সবাই একটি উপত্যকার পথ ধরে চলত, আর আনসাররা চলত ভিন্ন একটি উপত্যকা ও পথে, আমি আনসারদের উপত্যকার মধ্য দিয়ে চলতাম এবং তাদের পথটাই গ্রহণ করতাম। হে আল্লাহ! আনসারদের প্রতি দয়া করো, তাদের সন্তানাদি এবং তাদের সন্তানদের সন্তানগণের ওপরও করুণা বর্ষণ করো।’
রাসূলে করীম সা:-এর এ কথাগুলো শুনতে শুনতে আনসাররা কাঁদতে থাকেন। তাঁদের চোখের পানি দাড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। তারা বললেন, হ্যাঁ, আমাদের সম্পদ ও সৌভাগ্য নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। হে আল্লাহর রাসূল সা:।
একজন নবী হিসেবে হজরত মুহাম্মদ সা: কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন না। উপরোক্ত পরিস্থিতি মোকাবেলায় তিনি চালিত হয়েছিলেন মানুষের জন্য দরদ ও দূরদৃষ্টি দ্বারা।
যুদ্ধে প্রাপ্ত মালামাল বণ্টনে রাসূল সা:-এর ইনসাফকে সন্দেহ করার ফলে তিনি ভর্ৎসনা করেননি। বরং তার পদক্ষেপের পেছনে যে কারণগুলো ছিল, সেগুলো বুঝিয়ে বলাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। আনসারদের ক্ষোভের প্রকৃত কারণটি তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।
রাসূল সা: তাঁর সাহাবিদের সম্পর্কে সর্বোত্তম ধারণা পোষণ করতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের জন্য তাঁর স্নেহ-ভালোবাসার বিষয় আবারো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তিনি বুঝেছিলেন, তারা আসলে এ কথা বিশ্বাস করেনি যে, তিনি অন্যায় করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সা: যেভাবে সমালোচনার মোকাবেলা করতেন, তার দৃষ্টান্ত থেকে আজকের মুসলমানরা লাভবান হতে পারে। তিনি শিখিয়েছেন, সব সময়ে অন্যের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা, সব পরিস্থিতিতে বিনয়ী থাকা এবং শুধু আল্লাহর স্বার্থে ক্রোধ প্রকাশ করা।
যারা সমালোচক, তাদের বুঝতে পারাও গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। সমালোচনার বক্তব্যকে এর বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম থেকে আলাদা করার জন্যই তা দরকার। এমন বিষয় মূল্যায়ন করতে হবে যুক্তির ভিত্তিতে। যদি সমালোচনা ন্যায্য হয়ে থাকে, সমালোচিত ব্যক্তি এর সুরাহা করতে যথাসাধ্য প্রয়াসী হওয়া কর্তব্য। অন্তত শান্তভাবে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। তখন নিজের উপলব্ধি প্রকাশ করার সাথে সমালোচকদের উদ্বেগের হেতুও অনুভব করা চাই।
সত্যিই, অনুসরণের জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর নজিরই সর্বোৎকৃষ্ট।
লেখিকা : আমেরিকান ধর্মান্তরিত মুসলিম। মিসরে ইসলাম ও আরবি ভাষার শিক্ষক। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। ইসলামের পারিবারিক আইন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, হাদিস, ইসলামি আইন প্রভৃতি বিষয়ে লেখার অনুবাদ করেছেন।
ভাষান্তর : মীযানুল করীম