ইউসুফ আল কারজাবি : মুসলিম তরুণদেরকে গোঁড়ামি ও বাড়াবাড়ি পরিহার করতে হবে। একজন মুসলিম ঈমানে-আমলে সতর্ক হবে; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ধর্মীয় সহজ বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে ধর্মকে স্রেফ একটি কঠোর সতর্কবাণীতে পরিণত করবে। কুরআন, সুন্নাহ, রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীরা বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন: কেননা বাড়াবাড়ি আমলের বিষয়গুলোকে ঈমানদারদের জন্যে কষ্টকর করতে পারে। এ প্রসঙ্গে সিয়াম, পাকসাফ, বিবাহ ও কিয়াস সংক্রান্ত কুরআনের আয়াতগুলো লক্ষণীয়:
“আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কঠিন তা চান না।” (২:১৮৫)
“আল্লাহ তোমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না।” (৫ : ৬)
“আল্লাহ তোমাদের ভয়ের লঘু করতে চান, মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই দুর্বল।” (৪ : ২৮)
“হে ঈমানদারগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান দেয়া হয়েছে। মুক্ত ব্যক্তির বদলে মুক্ত ব্যক্তি, ক্রীতদাসের পরিবর্তে ক্রীতদাস ও নারীর পরিবর্তে নারী। কিন্তু তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কিছুটা ক্ষমা করা হলে যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও সততার সাথে তার প্রাপ্য আদায় বিধেয়। এটা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ভার লাঘব ও অনুগ্রহ।” (২ : ১৭৮)
রাসূলের সুন্নায়ও নমনীয়তা ও ভারসাম্যের পক্ষে ও বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে : “ধর্মে বাড়াবাড়ি থেকে সাবধান। তোমাদের পূর্বের (জনগোষ্ঠী) বাড়াবাড়ির জন্যে ধ্বংস হয়ে গেছে।” (আহমদ, নাসাঈ, ইবনে মাজা) তারা ধ্বংস হয়েছে যারা চুল ছেঁড়াছেঁড়িতে লিপ্ত এবং রাসুলুল্লাহ (সা) এ হাদীসটি তিনবার উচ্চারণ করেন। (মুসলিম)
এছাড়া আবু হুরায়রাহ (রা) বর্ণনা করেন, “একবার এক বেদুঈন মসজিদে প্রসাব করেছিল। লোকজন তাকে মারতে গেল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে আদেশ দিলেন, “তাকে ছেড়ে দাও (প্রসাবের জায়গায়) এক বালতি অতবা এক গালমা পানি ঢেলে দাও। তোমাদেরকে সব কিছু সহজ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, কঠিন করার জন্য নয়।” (বুখারী)
এটা সত্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা) সব সময় দু’টির মধ্যে সহজটিকে বেছে নিতেন যদি তা পাপ না হয়। যখন জানতে পারেন যে, মুয়াজ (রা) নামায দীর্ঘায়িত করেন, তখন তিনি মুয়াজ (রা)-কে বলেন, “হে মুয়াজ! তুমি কি মানুষকে পরীক্ষা করছ?” (বুখারী)
রাসূলুল্লাহ (সা) একথা তিনবার বললেন, “কেউ যদি কঠোরতর মাধ্যমে উৎকর্ষ অর্জনে আগ্রহী হয় তবে সে করতে পারে, কিন্তু অন্যকে বাধ্য করতে পারে না। এটা করতে গিয়ে সে অবচেতনভাবে অন্যকে ধর্ম থেকে সরিয়েও দিতে পারে।” রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওপরেই জোর দিয়েছেন। এজন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) একাকী নামায দীর্ঘায়িত করতেন, কিন্তু ইমামতির সময় সংক্ষিপ্ত করতেন। এ সংক্রান্ত একটি হাদীস ইতিপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে।
মুসলিম (র) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইমামতির সময় কুরআনের ছোট ছোট আয়াত পড়তেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) সহিষ্ণুতার নিদর্শন হিসেবে একাদিক্রমে রোযা রাখার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু লোকেরা তাঁকে বলল, “আপনি এরূপ করেন।” তিনি বলেন, “আমি তোমাদের মতো নই, আমার ঘুমের মধ্যে আমার প্রভু আমাকে খাদ্য ও পানীয় দান করেন।” ধর্মীয় বিষয়গুলো সহজরূপে তুলে ধরা এখন আগের চেয়েও বেশি প্রয়োজন। আমরা যে যুগে বাস করছি, সে যুগটি পাপপূর্ণ বস্তুবাদে নিমজ্জিত। এর মধ্যে ধর্মপালন দুঃসাধ্য বটে। এজন্যেই ফুকাহা কঠোরতার পরিবর্তে নমনীয়তার সুপারিশ করেছেন। দাওয়াতী কাজে কি পদ্ধতি অবলম্বন করা দরকার তা আগেই উল্লেখ করেছি। কুরআন বলছে : “তুমি মানুষকে তোমার প্রভুর পথে আহবান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে আলোচনা কর সদ্ভাবে।” (১৬ : ১২৫)। স্পষ্টত উক্ত আয়াতে শুধু মধুর কথা নয় সদয় অভিব্যক্তির কথাও বলা হয়েছে। এই লক্ষ্যে প্রথমে মতানৈক্যে নয়, মতৈক্যের সূত্র ধরে আলোচনা শুরু করতে হবে। আল কুরআন বলছে : “তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়ো না, তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে সীমালংঘনকারী এবং বলো, আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো একই এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী। (২৯ : ৪৬)
কোনো মতানৈক্যের বিষয় থেকে গেলে তা আল্লাহ স্বয়ং বিচার করবেন, “যদি তারা তোমার সাথে বিতণ্ডায় লিপ্ত হয় তবে বলো: “তোমরা যা কর সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক অবহিত। তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছ কিয়ামতের দিনে আল্লাহ পাক সে বিষয়ে তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন।: (২২ : ৬৮-৬৯)
এই যদি অমুসলমানদের সাথে আচরণের পদ্ধতি হয় তাহলে মুসলমানের সাথে মুসলমানের কথাবার্তা কি রকম হওয়া উচিত। আমরা তো অনেক সময় আচার-আচরণে ‘আন্তরিক’ ও ‘কর্কশে’র তফাতও ভুলে যাই। প্রকৃত দাইয়াকে মধুর ভাষণ ও সদয় অভিব্যক্তি দিয়ে দাওয়াতী কাজ চালাতে হবে। এমন প্রমাণ আছে যে, কর্কশ আচরণের ফলে আসল বিষয় বিকৃত বা বিলীন হয়ে গেছে। এগুলো থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। এজন্যেই বলা হয়েছে : ‘যে ভাল পথের আদেশ করে সে যেন তা ঠিক পথে করে।’
ইমাম গাজ্জালী (র) তাঁর ‘আমরু বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার বইয়ে লিখেছেন, ‘যে ব্যক্তি ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং নিষেধ করে খারপ কাজ থেকে তার ধৈর্য, সহানুভূতি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকতে হবে।’ প্রসঙ্গত তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। একবার এক ব্যক্তি খলীফা আল-মামুনের দরবারে এসে কর্কশ ভাষায় পাপ পুণ্য বিষয়ক পরামর্শ দান শুরু করল। ফিকাহ সম্পর্কে আল-মামুনের ভাল জ্ঞান ছিল। তিনি লোকটিকে বললেন, ‘ভদ্রভাবে কথা বলো। স্মরণ করো আল্লাহ তোমার চেয়েও ভাল লোককে আমার চেয়েও একজন খারাপ শাসকের কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং তাকে নম্রভাবে কথা বলার আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি মূসা (আ) ও হারুন (আ)-কে যারা তোমার চেয়ে ভাল ফিরাউনের-যে আমার চেয়েও খারাপ ছিল-কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন : ‘তোমরা দু’জন ফিরাউনের কাছে যাও, সে সকল সীমালংঘন করেছে, কিন্তু তার সাথে নম্রভাবে কথা বলো। হয়তোবা সে হুঁশিয়ারির প্রতি কর্ণপাত করবে অথবা (আল্লাহ্কে) ভয় করবে।” (২০ : ৪৩-৪৪)
এভাবে মামুন তর্কে জয়ী হলেন। আল্লাহ পাক মূসা (আ)-কে ভদ্র ভাষায় ফিরাউনের কাছে দাওয়াত পেশ করার শিক্ষা দিয়েছেন।
মূসা (আ) ও ফিরাউনের মধ্যেকার সংলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ফিরাউনের ঔদ্ধত্য, নিষ্ঠুরতা ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সত্ত্বেও মূসা (আ) অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দাওয়াত পেশ করেছেন। সূরা আশশূরায় এ বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবন ও সুন্নাহ অধ্যয়ন করলেও আমরা দেখি দয়া, মায়া, নম্রতা-সেখানে কর্কশতা ও কঠোরতার কোনো অবকাশ নেই। তাই কুরআন বলছে : “এখন তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল এসেছেন। তোমরা ধ্বংস হয়ে যাও এটা তাঁর জন্যে বেদনাদায়ক এবং তিনি তোমাদের ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। তিনি ঈমানদারদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ও করুণাশীল।” (৯ : ১২৮)
সাহাবীদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে কুরআন বলছে : “আল্লাহ দয়ায় তুমি তাদের প্রতিকোমল হৃদয় হয়েছ, তুমি যদি দৃঢ় ও কঠোর হৃদয় হতে তাহলে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে যেতো।” (৩ : ১৫৯) একদিন একদল ইহুদী এসে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সম্ভাষণ জানাল, “আস সামু আলাইকুম’ যার আক্ষরিক অর্থ ‘আপনার মৃত্যু হোক।’ হযরত আয়েশা (রা) ক্রুদ্ধ হয়ে জবাব দিলেন, ‘আলাইকুমুস সামু ওয়া আলানাহ” অর্থাৎ “তোমাদেরও মৃত্যু হোক, অভিশপ্ত হও তোমরা।” কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) কেবল বললেন, ওয়া আলাইকুম (তোমাদের ওপরেও)” তারপর আয়েশা (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেন, “যে সকল বিষয়ে দয়া করুণা করে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন।” (সকল প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত) তিনি আরো বললেন, ‘দয়া সব কিছু সুন্দর করে। হিংসা সেগুলোকে ত্রুটিপূর্ণ করে।” (মুসলিম)
জুবায়ের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছেন: “যে কোমলতা থেকে বঞ্চিত সে সকল ভাল থেকে বঞ্চিত।” (মুসলিম) সকল ভাল থেক বঞ্চিত হওয়ার চেয়ে বড় শাস্তি আর কী থাকতে পারে!
আশা করা যায়, উপরের উদ্ধৃতিগুলো আমাদের বাড়াবাড়ি পরিহার করে প্রজ্ঞার পথে চালিত হওয়ার জন্যে যথেষ্ট।