দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে আজ থেকে দুই শতাব্দী আগে। কিন্তু ওই বর্বরতার ক্ষত এখনো দগদগে হয়ে আছে ক্যারিবীয় দেশগুলোর শরীরে। এখনো কান পাতলে বুঝি শোনা যায় শোষিত বঞ্চিত নির্যাতিত উন্মল কৃষ্ণ ক্রীতদাসদের আর্তস্বর।
আসলেই তাই। দুই শতাব্দী পর হলেও জাগ্রত বিবেকের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। ওই ঘৃণ্য ব্যবসার হোতা দেশগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ক্যারিবীয় দেশগুলো। তারা ওই বর্বরতার ক্ষতিপূরণ চায়। গত বছর ১৪টি ক্যারিবীয় দেশের সরকারপ্রধানরা এ লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করেন। এর নাম ক্যারিকম রিপারেইশনস কমিশন। এর প্রধান করা হয়েছে বার্বাডোসের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবেত্তা প্রফেসর স্যার বেকলেসকে।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে একটি কার্যপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে কমিশন। পরিকল্পনাটি প্রণয়ন করেছেন ব্রিটিশ আইনজীবী মার্টিন ডে, একাধিক চাঞ্চল্যকর মামলায় যার সাফল্য সুবিদিত। তাকে সহযোগিতা করেছেন প্রফেসর স্যার বেকলেস। ১০ দফা পরিকল্পনায় রয়েছে : দাস ব্যবসায় জড়িত দেশগুলোকে এ অপকর্মের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। দাসদের কোনো বংশধর যদি আফ্রিকায় প্রত্যাবাসিত হতে চায়, তাকে সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। দাসশ্রমিকদের বর্তমান বংশধরদের জন্য ভূমি উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন এবং তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও নিরক্ষরতা নির্মূলের লক্ষ্যে তহবিল গঠন করতে হবে ইত্যাদি।
নবগঠিত কমিশনের প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়, দাস ব্যবসার কারণে ক্যারিবীয় দেশগুলো বংশানুক্রমে দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও স্বাস্থ্যহীনতার শিকার হয়ে আসছে। কাজেই এই ক্ষতিপূরণের দায় অবশ্যই সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর। ব্রিটেনসহ সব ইউরোপীয় দেশকে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
কমিশনের প্রতিবেদনটি ক্যারিবীয় দেশগুলো অনুমোদন করলে প্রথমে ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, নরওয়ে ও সুইডেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার পথ সুগম হতে পারে। তবে যদি আলোচনা ব্যর্থ হয়, তখন আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে।
কার্যপরিকল্পনা প্রণয়নকারী ব্রিটিশ আইনজীবী মার্টিন ডে বলেন, যাদের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হবে তার শীর্ষে থাকবে ব্রিটেন। কারণ, আমরাই ক্যারিবীয় অঞ্চলে গোড়ার দিককার উপনিবেশ স্থাপনকারী এবং দাস ব্যবসায়ও প্রথম থেকেই আমরা জড়িত।
মার্টিন ডে এবং অন্য আরো অনেকে এ প্রসঙ্গে বলেন, দাস ব্যবসায় ক্যারিবীয় অঞ্চলের সমাজব্যবস্থাকে এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যার বিরূপ প্রভাব সেখানে এখনো অনুভূত হয়।
ক্ষতিপূরণ আদায়ে গঠিত কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এক কোটিরও বেশি আফ্রিকানকে তাদের বাড়িঘর থেকে চুরি করা হয় এবং জোর জবরদস্তির মাধ্যমে ক্যারিবীয় অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়। তারা ইউরোপীয়দের দাসকৃত্তিতে নিয়োজিত এবং অস্থাবর সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এই ট্রান্সআটলান্টিক দাসবাণিজ্য মানব ইতিহাসের বৃহত্তম বাধ্যতামূলক অভিবাসন। মানুষের ওপর মানুষের অমানবিক আচরণের এর চেয়ে বড় নজির আর নেই।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এই শেকলে বাঁধা মানুষগুলো ছিল ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি লাভজনক পণ্য। শুধু মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে লাখ লাখ পুরুষ, নারী ও শিশুর জীবন ধ্বংস করে দেয়া হয়। দাসব্যবসার চার শ’ বছরে এক কোটিরও বেশি আফ্রিকানকে দাস বানিয়ে ক্যারিবীয় অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন এই ব্যবসায় নিষিদ্ধ হচ্ছিল, তখনো প্রায় ২০ লাখের মতো মানুষ ছিল দাস। ক্যারিবীয় অঞ্চলের এই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলোর স্বাস্থ্য সমস্যা সংশ্লিষ্ট দেশের জন্য বিরাট অর্থনৈতিক ঝুঁকি হিসেবে বিরাজমান।
প্রফেসর স্যার বেকলেস বলেন, ক্যারিবীয় অঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের বর্তমান বংশধরদের মধ্যে রোগব্যাধির প্রকোপ অন্য যেকোনো জনগোষ্ঠীর চেয়ে বেশি। তারা শিকার হয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের। হতে হয়েছে দাসত্ব, গণহত্যা ও বর্ণবাদের শিকার। জোটেনি পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য। ফলে হাইপারটেনশন ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মতো ভয়াবহ রোগ তাদের মধ্যে অনেক বেশি।
তিনি বলেন, তাদের মধ্যে অশিক্ষাও ব্যাপক। ব্রিটিশরা বিশেষভাবে কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়–কÑ এটা চায়নি। তাই তো ১৯৬০-এর দশকে যখন একের পর এক বিভিন্ন জাতি রাষ্ট্র স্বাধীন হচ্ছিল, তখনো দেখা যায়, তাদের ৭০ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর।
অভিযুক্তরা কী ভাবছে
ক্যারিবীয় দেশগুলোর এই উদ্যোগ নিয়ে সম্ভাব্য অভিযুক্ত দেশগুলোও নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বলেন, প্রস্তাবিত আইনি ব্যবস্থা সম্বন্ধে সরকার অবগত। দাসত্ব একটি ঘৃণ্য ব্যবস্থা। ব্রিটিশ সরকার দ্ব্যর্থহীনভাবে এর নিন্দা জানায় এবং এর উৎখাতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে একই সাথে সরকার এ-ও মনে করে যে, ক্ষতিপূরণ এর কোনো সমাধান নয়। বরং আমাদের উচিত একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মিলিতভাবে মোকাবেলার উপায় খুঁজে বের করার দিকে মনোনিবেশ করা।
তবে ব্রিটেন যা-ই বলুক, তারা ১৯৫০ সালে কেনিয়ায় সংঘটিত ‘মাউ মাউ হত্যাযজ্ঞের’ শিকারদের জীবিত বংশধরদের প্রায় দুই কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দিতে এবং ওই ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হয়েছে।
এ ক্ষেত্রেও ব্রিটেন ও অন্যান্য সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেটাই ঘটবে কি না, সেটা দেখার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে ক্যারিবীয় সরকারপ্রধানদের এই উদ্যোগ মানবজাতির জন্য ইতিহাসের একটি বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে যে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। পাপের শাস্তি চার শ’ বছর পর হলেও হয়।