কমাশিসা ডেস্ক:
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১৫ হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে সর্বত্র এই মাদ্রাসাগুলো কোরআনের আলো জ্বালাচ্ছে মানব মনে। গ্রামের মানুষকে কোরআন শেখানোর জন্য মক্তব, ফোরকানিয়া এবং কোরানিয়া মাদ্রাসার নামে কওমি মাদ্রাসাগুলো দীর্ঘদিন ধরে সফলতার সঙ্গে কোরআন শিক্ষার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। হেফজ মাদ্রাসার পাশাপাশি কিতাব বিভাগ এবং আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে পরিচালিত মাদ্রাসাগুলো ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে মানুষের কাছে। মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা বছরের বিভিন্ন সময় সাধারণ এবং বিশেষ শ্রেণীর ডোনারদের থেকে কালেকশন করে মাদ্রাসার ব্যয়ভার নির্বাহ করে। মাদ্রাসা সচল রাখতে ছাত্র-শিক্ষক উভয়কেই বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করার জন্য অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা তাদের স্বজনদের সঙ্গে উদযাপন করতে পারে না মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা।
রাজধানীর স্বনামধন্য একটি কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছেন নোয়াখালী জেলার আনিসুর রহমানের একমাত্র সন্তান ওমর ফারুক। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের আলোকে চামড়া কালেকশনের দায়িত্ব পালনের কারণে গত তিন বছর ধরে মায়ের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে না ওমর ফারুক। সন্তানহীন ঈদ পালনের অনুভূতি জানতে চাইলে ফারুকের মা বলেন, ‘সন্তানহীন ঈদ যেন বেদনার আরেক নাম।’ ওমর ফারুকের মায়ের মতো ১৫ হাজার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ মায়েরই ঈদ কাটে সন্তানকে কাছে না পাওয়ার আকুতি আর নীরব চোখের জলে। ওমর ফারুকদেরও মন কাঁদে বাড়ির পথে চেয়ে থেকে। ঈদের ১০ দিন বাকি থাকতেই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ‘আপনার কোরবানির চামড়া অথবা উহার মূল্য মাদ্রাসায় দান করুন’- এমন আহ্বান সম্বলিত পোস্টার ও লিফলেটের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা করে থাকে। কোরবানির এক সপ্তাহ আগে মহল্লার প্রতিটি ঘরে চামড়া কালেকশনের বিশেষ চিঠিও বিলি করা হয়। এতকিছুর পরও কোরবানির দিন যখন কালেকশনে যায় তখন কোরবানিদাতা বলেন, ‘আহ! আরেকটু আগে আসলেই হতো। অথবা ১০, ২০ বা ৫০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘বেশি দিতে পারলাম না। আরও অনেক মাদ্রাসায় দিতে হবে।’ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির শ্রেষ্ঠ সন্তান মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যখন চাল-ডাল, তেল-নুন, আর চামড়ার জন্য মানুষের দুয়ারে ঘুরে বেড়ায় তখন তাদের ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা সমাজ এবং মানুষদের কাছে ক্ষুণ্ণ হয়। সমাজ মনে করে মাদ্রাসা মানেই মানুষের কাছে হাত পাতা; আর কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও এতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে খুব সহজেই। ফলে মাদ্রাসার গণ্ডি পেরোলেও হাতপাতার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে না অনেক শিক্ষার্থী এবং আলেম।
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘উপরের (দাতার) হাত নিচের (গ্রহীতার) হাত হতে উত্তম। যে ব্যক্তি (মানুষের কাছে হাতপাতা থেকে) পবিত্র থাকতে চায় আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখেন। আর যে পরমুখাপেক্ষিতা থেকে বেঁচে থাকতে চায় আল্লাহ তাকে স্বাবলম্বী করে দেন।’ (বুখারি, ১৪২৭; মুসলিম, ২৪৩৩।) মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের হাতপাতা এবং মানুষের দুয়ারে ঘুরে বেড়ানোর দিন ফুরাবে কীভাবে? কীভাবে সমাজের সামনে তারা আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত এবং স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারবে- এ সব বিষয় নিয়ে দুই বিশেষজ্ঞ আলেমের সঙ্গে কথা বলেছেন- আল ফাতাহ মামুন
মাওলানা মুহাম্মদ যাকীর হুসাইন
অধ্যক্ষ, তা’লিমুল উম্মাহ কাডেট মাদ্রাসা, খন্দকার রোড, জুরাইন, ঢাকা
প্রশ্ন : চামড়া কালেকশনের কারণে অনেক কওমি শিক্ষার্থীই স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারে না- বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
উত্তর : স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করা শিক্ষার্থীদের অধিকার। চামড়া কালেকশনের কারণে শিক্ষার্থীদের এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। কওমি মাদ্রাসার পাশাপাশি অনেক আলিয়া মাদ্রাসাও ছাত্রদের দিয়ে এমনটি করিয়ে থাকে। আজকাল অনেক কওমি মাদ্রাসা ছাত্রদের দিয়ে ‘কালেকশন সংস্কৃতি’ থেকে বেরিয়ে আসছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে।
প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে কালেকশন করানোর ফলে সমাজ ও শিক্ষার্থীর মনে কী প্রভাব পড়ে?
উত্তর: প্রথমত, শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে কালেকশন করানো আদৌ উচিত নয়। এতে সমাজ ও শিক্ষার্থীর মনে বাজে প্রভাব পড়ে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষের কাছে আলেম ও মাদ্রাসার ছাত্ররা সস্তা হয়ে যায়। তৃতীয়ত, কালেকশনের অভিজ্ঞতাই আলেম মনে ‘হাতপাতা’ মনোভাব তৈরি করে দেয়। যা রাসূলের (সা.) ভাষায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ।
হাফেজ মাওলানা কাজী মারুফ বিল্লাহ
ভাষ্যকার, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন এবং স্যাটেলাইট চ্যানেল।
প্রশ্ন : ‘নিচের হাত থেকে উপরের হাত উত্তম’ যারা এমনটি শেখান তারাই মানুষের কাছে হাত নিচু করার প্রশিক্ষণ দেন- এ সম্পর্কে কী বলবেন?
উত্তর : আল্লাহ বলেন, ‘ও হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা নিজেরা কর না। আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা এমন কথা বল যা তোমরা কর না।’ (সূরা সফ, ৬১:২-৩।) মানুষের কাছে হাতপাতা কিংবা ধান্ধা করা ইসলাম সমর্থন করে না। যারা শরিয়তের জ্ঞান শিক্ষা দেন তাদের দিয়ে শরিয়ত অসমর্থিত কাজ প্রকাশ পাওয়া কাম্য নয়। ক্লাসে মানুষের কাছে হাত না পাতার সবক দিয়ে ক্লাসের বাইরে হাত প্রসারিত করার বাস্তব প্রশিক্ষণ দেয়া স্পষ্ট কোরআনবিরোধী কাজ।
প্রশ্ন : কালেকশননির্ভর প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
উত্তর : কালেকশননির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। জাকাত-ফেতরা আর কালেকশনের অর্থে পড়াশোনা করে বেড়ে ওঠার কারণেই একদল আলেম অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারছেন না। এগুলো আলেমদের ব্যক্তিত্বকে খাটো করে দিচ্ছে। যার দানের টাকায় আপনি মুফতি হবেন তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কীভাবে ফতোয়া দেবেন? বর্তমানে কওমি মাদ্রাসাগুলো আধুনিক হচ্ছে। অনেক কওমি মাদ্রাসাই ‘কালেকশন সংস্কৃতি’ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, যা আশার কথা। রাসূল (সা.)-এর সময় কালেকশন ব্যবস্থা ছিল স্বেচ্ছায় এবং প্রতিযোগিতামূলক। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসূল (সা.)-এর কাছে স্বেচ্ছায় নিজেদের সম্পদ দান করতেন। কোরআনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। কোরআন অধ্যয়নকালে তারা দানের ফজিলত ও প্রতিদান সম্পর্কে জানতেন এবং আল্লাহর পথে অকৃপণ ব্যয়ে উদ্বুদ্ধ হতেন। বর্তমান মুসলিম বিশ্ব কোরআন অধ্যয়ন ও গবেষণা ছেড়ে দেয়ার ফলে সম্পদের মোহ এবং দানে কৃপণতা তাদের পেয়ে বসেছে এবং কোরবানির পশুর চামড়া বা এর বিক্রয়লব্ধ অর্থ কওমি মাদ্রাসার আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে পড়েছে। এটি বন্ধ হয়ে গেলে অনেক মাদ্রাসাই বন্ধ হয়ে যাবে। এ অবস্থায় দেশের ইসলাম দরদি জনগণ এবং সরকারকে মিলেমিশে এক নতুন ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হবে। যে ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে সৃষ্টিশীল তরুণ সাহসী আলেম। যারা চির শান্তির ধর্ম ইসলামকে পৌঁছে দেবে বিশ্ব দুয়ারে। তখন আর ঈদের আনন্দ দিনে কওমি ছাত্রদের চামড়ার জন্য ছুটতে হবে না অন্যের দুয়ারে। প্রযুক্তি হোক আমাদের প্রেরণা। আল্লাহ হোক আমাদের সঙ্গী।
সুত্র: যুগান্তর