ইলিয়াস মশহুদ :: ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মু’মিন হৃদে বয়ে আনে অনাবিল এক হাসি। ঈদ মানে মুসলিম জাতিসত্ত্বায় বয়ে যাওয়া খুশির আমেজ। কারণ, ঈদ মুসলিম জাতির অন্যতম ধর্মীয় এক উৎসব। রহমান মাওলার অপার দান। নববী যুগে মূর্তিপূজকরা বিভিন্ন উৎসব পালন করত। নস্টালজিক আনন্দ-আহ্লাদে মেতে উঠত। নিষিদ্ধ আনন্দে গা ভাসাত। যে কারণে সাহাবারা সেসব উৎসবে অংশ নিতেন না। তাঁরা নবী সা.’র দরবারে এসে সেসব উৎসবের কথা বয়ান করতেন। নিজেরাও শুদ্ধ উৎসব পালনের তামান্না করতেন। সাহাবাদের কথা শুনে নবীজি সা. তখন মনো:কষ্টে ভূগতেন। মনে মনে কামনা করতেন- আমার উম্মতকেও যদি খোদাপ্রদত্ত কোনো উৎসব পালনের ঘোষণা দেয়া যেত!
নবীজি সা.’র কামনা বলে কথা! এদিকে রহমান মাওলা আরশে উপবেশন করে তাঁর পেয়ারা হাবীবের এমন সব কামনা দেখে মুচকি হাসেন। অত:পর ঘোষণা দেন- “ওদের মত নষ্ট উৎসব নয়, যা শুধুই উৎসব; বরং আমি তোমাকে, কেয়ামত পর্যন্ত তোমার উম্মতকে প্রতি বছর এমন দু’টি উৎসব পালনের অধিকার প্রদান করছি, যা হবে একদিকে আনন্দের অন্যদিকে অফুরান সওয়াব কামাইর বাহন।” সেই থেকে আজ অবধি চলছে মুসলিম মিল্লাতের দুটি উৎসবের ক্রমধারা। চলবে কেয়ামত পর্যন্ত।
প্রতি বছর আমরা দুটি উৎসব পালন করে থাকি। একটি ঈদুল ফিতর অপরটি ঈদুল আযহা। যা একদিকে আনন্দের অন্যদিকে পারস্পরিক সম্প্রীতি রক্ষার অনন্য মাধ্যম।
ঈদুল ফিতর দীর্ঘ একমাস সিয়াম-সাধনার পর পহেলা শাওয়াল ফিতরা প্রদান আর ঈদুল আযহা হজে¦র প্রাক্ষালে ১০ই জিলহজ¦ কুরবানী বা পশু জবাইর মাধ্যমে আদায় করা হয়ে থাকে।
বছর ঘুরে খুশির বারতা নিয়ে আবারো ঈদ হাজির আমাদের মাঝে। ঈদুল ফিতর। এই ঈদ মুসলমানের। মুসলিম মিল্লাতের। ধনী-গরিব সবার। সর্বোপরী রোজাদারদের জন্য। যারা রোজাদার নয়, রোজা রাখেনি তাদের জন্য কোনো আনন্দ উৎসব বা ঈদ নেই।
ঈদানন্দ ইসলাম ধর্মের একটি ধর্মীয় উৎসব। ধনী-গরিবের অনাবিল আনন্দের একটি উৎসব। অথচ এই ঈদের আনন্দে ধনী-গরিবের মাঝে ব্যবধান লক্ষণীয়। কেউ একটি জামার জন্য ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে না, আবার কেউর কিরণমালা জামা ছাড়া চলেনা। কেউ নিজের বাড়ির ঈদের মাঠে একটি লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামায পড়তে পারে না, আবার কেউ দামী পাঞ্জাবি-স্যুট পড়ে ঈদের নামায পড়তে চলে যায় নেপাল বা দর্জিলিং। এই হল ঈদের আনন্দ। ধনী-গরিবের ঈদের বৈষম্য।
তবে বছরের বিশেষ এই দিনটির তাৎপর্য একজন বড়লোকের চেয়ে গরিবের কাছে অনেক বেশি বলে আমি বিশ্বাস করি। একজন গরিবের ঘরে ঈদের গুরুত্ব অপরিসীম। এক প্যাকেট সেমাই, এক কেজি চিনি, এক কেজি গরুর গোশত, ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে সাধ্যের মধ্যে কিছু জামা কাপড় কিনে দেওয়া, পকেট খরচের জন্য কিছু বাড়তি টাকা হাতে রাখা- এ যেন এক কল্পনাবিলাসী সুখের মত। অথচ এই সুখটুকু উপভোগ করতে গরিবের অবস্থা হয়ে উঠে নাভিশ্বাস। কিন্তু কিছু করার থাকে না, ঈদ বলে কথা। অন্য আর দশ জনের মত খানিকটা হলেও তো কিছু না কিছু করতে হবে। কোনো রকমে ঈদের আনন্দ শেষ হলেই বাঁচে! পরে বাড়ে নিজের দুর্ভোগ। এই হল গরিবের ঈদের আনন্দ।
বড় লোকের ঈদ তো হয় প্রতিদিন। এ আর নতুন কী? একজন রাজনীতিবিদের ঈদের আনন্দ হলো, ১০ টাকার নতুন নোটের কয়েকটি বা-েল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। কতিপয় কিছু গরীব মানুষকে একসাথে ৫টি দশ টাকার নোট গুজে দিয়ে ‘নে রে রহিম! এই নে, টাকাগুলো রাখ, ঈদের দিন কিছু কিনে খাবি।’ তখন সাথে থাকা চামচা জাতীয় পদার্থগুলো ফটো শট করে রাখবে প্রচারের জন্য। এটা হলো স্বাভাবিক একটি বিষয় গরিবের সাথে ঈদ উপলক্ষে একটা তামাশা করার। আসলে আমরা এমনই।
হয়তবা আমাদের ঈদ হবে নানা আয়োজনে, আর ওদের দিনটা কাটবে পথে পথে ঘুরে। আমরা কী পারিনা ওদেরকে নিয়ে ভাবতে? আনন্দময় একটি ঈদ উপহার দিতে?
ঈদ মানে খুশি। শুধু খুশি নয়, মহাখুশির উৎসব। সেই ঈদে মানুষ সার্মথ্য অনুযায়ী প্রাণ খুলে কেনাকাটা করবে, এটাই স্বাভাবিক। না করাটাই বরং দুঃসংবাদ। বড়দের তুলনায় ছোট শিশুরাই এই দিনে নতুন পোশাক পরে বেশি আনন্দ পায়। বেশিরভাগই দেখা যায়, ধনী পরিবারের শিশুরা ঈদে দুই-তিন সেট পোশাক কিনে। নতুন পোশাক পরে ঈদের সকালে আনন্দে মেতে ওঠে। অথচ তাদেরই অনেক প্রতিবেশি গরিব, এতিম, শ্রমিক শিশুরা নতুন জামা তো দূরের কথা বরং ছেঁড়া পোশাক পরে অতি দুঃখে ঈদের দিনটা কাটায়। এদের দিকে কেউ একটু দয়ার দৃষ্টি দেয়না। এটা ঠিক নয়, তাদেরও তো আমাদের মতো ঈদের আনন্দ উপভোগ করার অধিকার আছে। কিন্তু তারা এই অধিকার পেয়েও অধিকারকে কাজে লাগানোর সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ তারা সমাজে দুর্বল, অনাথ, এতিম। কোথায় পাবে নতুন পোশাক কেনার অর্থ এসব শিশু? তারাতো অর্থনৈতিক দিক থেকে একেবারে নিঃস্ব। তাই আমাদে কর্তব্য হল, নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাদেরকে সাহায্য করা। নিজেদের শিশুদরে জন্য পোশাক কেনার সময় অল্প কিছু অর্থ বাচিয়ে প্রতিবেশি গরিব শিশুদের জন্যও কিনে তাদের মলিন মুখে হাসি ফোটানো। যেনো তারাও সকলের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে ঈদ উৎসবে সাড়া দিতে পারে।
বাংলাদেশে ঈদে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগের যেনো শেষ নেই, পথে পথে কত শথ ভোগান্তি আর হয়রানি। এর মূলে হরেক রকমের কারণও আছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের এখানে যথেষ্ট তৎপর নয়, তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নানা কিচ্ছা-কাহিনী। ঘুষ-দুর্নীতি আমাদের প্রাণশক্তিকে কেড়ে নিচ্ছে, মানুষের বিবেকের তীক্ষ্ম জায়গাগুলোকে তলানিতে নামিয়ে আনছে।
ঈদকে কেন্দ্র করে যদিও অন্যান্য বছরের তুলনায় এখন পর্যন্ত অস্বস্তির বড় কোনো খবর পাওয়া যায়নি, তবে যে কথাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ সেটি হলো, অধ:পতন ঘটেছে আমাদের ধৈর্য-বিবেক এবং নৈতিক মূল্যবোধে। মানুষ দিন দিন বড় বেশি অসুহিষ্ণু হয়ে উঠছে। হত্যাসহ সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা সে কথাই আমাদের জানান দেয়। সামগ্রিকভাবে আমরা অধৈর্য হয়ে উঠার পেছনেও কিছু বিষয় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে এখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে চলেছে, রাজনৈতিক খুন, হানাহানি, অবিচার এবং লুটপাটের কারণেই সাম্প্রতিক এই অধঃপতন বলে আমাদের ধারণা।
নানান অঘটনের এই দেশে তবু আমরা আশায় বুক বাঁধি। একটা ইতিবাচক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে সব মানুষ শান্তি এবং স্বস্তিতে বসবাস করতে পারবে। এবারের ঈদ আমাদের আরো বেশি সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করুক, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গেয়ে উঠি আনন্দের গান।
এটাও পড়তে পারেন
সিলেটের পবিত্র মাটি আবারও কলংকিত হলো রায়হানের রক্তে!
পুলিশ ফাড়িতে যুবক হত্যা: সিলেটজোড়ে চলছে রহস্য! এলাকাবাসীর প্রতিবাদ!! সিলেট নগরীতে রায়হান নামক এক যুবকের ...