(স্বপ্নবিলাস ৫ম কিস্তি)
ইউসুফ বিন তাশফিন::
হজরত তাকি উসমানি দামাত বারাকাতুহুমের আহব্বান বাংলাদেশের উলামা সমাজকে নাড়িয়ে দিলো।সকলেই অনুভব করলেন নাড়ির টান। তিনি বলেন-‘আমরা যদি ইসলামি ইতিহাসের প্রসিদ্ধ জামেয়াসমূহের অনুসন্ধান করি তাহলে আমরা প্রসিদ্ধ চারটি জামেয়ার সন্ধান পাই। সর্ব প্রথমটি হলো জামেয়াতুল করাউইয়্যিন। দ্বিতীয়টি হলো তিউনিসিয়ার জামিয়া যাইতুনাহ। তৃতীয়টি হলো মিসরের জামিয়াতুল আযহার। চতুর্থটি হলো ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দ । ঐতিহাসিক ক্রমাধারাও অনুরূপ ।’
সন ২০২০ ডিসেম্বর। সমস্ত উলামায়ে কেরামের সম্মিলিত সভা আহব্বান করা হলো।দেশের ৯৫% মানুষ থেকে আলাদা থাকলে মুক্তি আসতে পারে না। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিগুলো হয়ে উঠেছে ইসলাম বিদ্বেষীদের অভয়ারণ্য।পুরো দেশ ও জাতিকে বিপথগামী করার জন্য তারা সেখানে বসে বসে কলকব্জা নাড়াচ্ছে। সময়ে সময়ে দ্বীন বিরোধী বিভিন্ন ইস্যু দাঁড় করিয়ে মানুষের ঈমানকে হালকা করছে। বিশ্বাসের ভিতকে করে দিচ্ছে নাড়বড়ে। এমনি পরিস্থিতিতে বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু করার ফলাফল শুভ হয় না। রাজনীতি অনকে হলো। মাদারিসে কওমিয়া কম কিসে ? কিন্তু অগ্রগতি নজরে আসছে না। কুফর শিরক বিদআত আল্লাহর নাফরমানির কোনো কূল-কিনারা হচ্ছে না।
কওমের নকীব আল্লামা তাকি উদ্দিন আল-কিন্দী ধীর স্থীরে ছোট্ট ১টি পুস্তিকা হাতে নিয়ে মাইক্নোফোনে পাশে দাঁড়াতেই সকলের চোখ ছানাবড়া। তিনি একজন নিভৃতচারি গবেষক। কোরআন হাদীস নিয়ে দিনরাত ঢুবে থাকা যার কাজ তিনিই আবার ডেলিগেট স্পিকার। তবে তিনি যে গভীর ধীশক্তির অধিকারী তা তার দুশমনরাও স্বীকার করে। পুস্তিকাটির শিরোনাম হলো ‘সার্বজনীন সমন্বিত শিক্ষা কারিকুলামের প্রয়োজনীয়তা’ – আল্লামা তকি ওসমানি। উর্দু ভাষার বয়ানটি বাংলা ইংরেজীতে তরজমা করে কয়েক লক্ষ কপি ছাপিয়ে কমাশিসার বদৌলতে বাংলাদেশের কোণায় কোণায় পৌছিয়ে দেয়া হলো। ছোট্ট এই পুস্তিকাটি যেন এটমের মত কাজ দিলো। ইতিমধ্যে যারা উপস্থিত হয়েছেন সবার আগে পড়া হয়েগেছে বিধায় বিষয় বস্তু কি তার আর তাকে দীর্ঘ বক্তৃতার মাধ্যমে বুঝাতে হয়নি। আল্লামা তকি উদ্দিন আল-কিন্দীর সাথে আগে অনেকের সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে তিনি যে এই সেই ব্যক্তি তা আজ সাক্ষাৎ প্রমাণ মিললো। ভাঙ্গাগড়ার কওমি বোর্ডগুলো এক করতে যার দিনরাত পরিশ্রম।
মাইক্রোফোনে কথা বলার আগে একজন সমাবেশের মাঝখান থেকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন যে বোর্ড এক হলে লাভটা হবে কি? হাতের ইশারায় বললেন, হ্যাঁ আজ এর জবাবও হবে। আরেকজন চিরকুট পাঠালেন যে, সিলেবাস সংস্কারের মানে কি? তাতে কোরআন হাদীসের বিরাট ক্ষতি হবে না? দুনিয়াদারী তাহলে আপনারা দ্বীনের ভিতর নিয়ে আসছেন? আল্লাহ তায়ালার হাম্দ ও ছানার পর শাইখ আল-কিন্দী বলতে লাগলেন- যারা শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকি উসমানির বয়ানটি ভালভাবে পড়েছেন তারা হাত উঠান। অর্ধেকের বেশি লোকের হাত উপরে উঠলো। তিনি আরজ করলেন যে, যদি এই পুস্তিকায় কোন ভুল থাকে, খেলাফে শরীয়ত কোন কথা থাকে, দ্বীনের ভিতর দুনিয়াকে প্রবেশের কোন কসরত থাকে তাহলে দাঁড়িয়ে আমার কথার জবাব দিন? কেউ আওয়াজ দিলোনা। সম্মেলনের শেষপ্রান্ত থেকে একজন যেন হাত উঁচিয়ে কী বলতে চাইছে। শেখ তাকি উদ্দীন আল-কিন্দীর চোখ এড়ায়নি। শাহাদত আঙ্গুলের ইশারায় দাঁড়াতে বললেন। ভদ্রলোক দাড়াঁতেই সকলের চোখ ফিরে গেল তার দিকে। তিনি বললেন, আমরা শাইখ তকি উদ্দীন আল-কিন্দীর কথা শুনতে চাই।
ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে বলে শাইখের কথা শুরু হলো। ভায়েরা আমার, আজ এমন এক বিষয় নিয়ে আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি যেখানে দীর্ঘ ৪৪টি বছর যাবত বাংলার মাটিতে ইসলামি আন্দোলনের সিপাহসালাররা ময়দানে তীহের মতো দিশাহারা অবস্থা। আজ ঘরে ঘরে নাস্তিক মুলহিদ। রাস্তায় রাস্তায় দ্বীনের অবমাননা। মাদরাসা গুলোকে জংগীর আস্তানা বলে পরিচিত করার অপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। ইংরেজরা যখন আমাদের দেশ দখল করলো, শাসন ক্ষমতা নিলো শিক্ষাব্যবস্থা ধংস করলো তখন থেকেই আমাদের দুর্গতির পালা শুরু। ১৮৬৭ সালে আমাদের শেষ সম্বল ঈমান আক্বিদা ও ইসলামি শিক্ষা তথা কোরআন হাদীসের জ্ঞানটুকু বাঁচিয়ে রাখার তাকিদে সেই ঘোর বিপদের দিন কায়ীদে মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন হুজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা ক্বাসিম নানুতবী রাহ দারুল উলুম দেওবন্দের গোঁড়াপত্তন করেন। দেওবন্দ আপন জাগায় আপন আলোয় উজ্জল সিতারা হিসাবে আছে থাকবে। কিন্তু আমরা দ্বীন ইসলামের সোনালী ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেকে ছিটকে পড়ি। আমরা ভুলে যাই জামেয়া আল-করউইনের কথা, জামেয়া আল-জাইতুন জামেয়া আল-আজহার আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যেতে থাকে। এমন একদিন ছিলো রাষ্ট্রের শাসক মিল্লাতের ফিকির মন্দ বিজ্ঞানের জটিল বিষয়ের আবিষ্কারক অংক ও এলজাব্রার জন্মদাতার সাথে হাফিজে কোরআন মুফাক্কিরে ইসলামরাও বের হতেন। সেখানে নামাজের সালাম ফিরানোর পর চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুত্র নিয়ে আলোচনা হতো। আজ আমরা বিভক্ত । এমন ভাবে বিভক্ত যে এই বন্টনকেই আমাদের নিয়তি বলে স্বীকার করে নিচ্ছি।
পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত আমরা করি। পড়ি ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো আর যাকাত আদায় করো’। আমাদের অবস্থা এমন যে শুধু যাকাত উসুল ও যাকাতখোরই আমাদের নাম লেগে গেলো। যে কালামে মজীদের পরতে পরতে বলা হয়েছে তোমরা দুনিয়াকে দ্বীনের মতো কর। আজ আমরা দ্বীনকে দুনিয়ার মতো করে দেখতে শুরু করেছি। আমরা আমাদের মোয়ামেলাত মোয়াশেরাতকে দিয়েছি ফাসিক ফুজ্জারদের কাছে ইজারা। আমরা ভাবছি আমরা এই নাপাক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নিয়ে দ্বীনকে অপবিত্র করবো না। দুনিয়াদার হবোনা। তাদের দেওয়া অর্থ আমাদের কাজে লাগানো যাবেনা। আসলে সত্যিই কী আমরা তাদের অর্থ গ্রহন করিনা? এই সমস্ত দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের খরচ আসে কোথা থেকে? কারা চাঁদা দেয়? কারা করে আর্থিক সহায়তা? দুনিয়া থেকে কতটুকু আলাদা হতে পারলাম? যে দুনিয়া ইজ্জতের সাথে আমাদের কাছে আসার কথা ছিলো তা আজ জিল্লতির সাথে আসছে আমাদের কাছে। আমরা রাষ্ট্রথেকে আলাদা থাকায় শয়তান খুব সন্তুষ্ট। কুফর আমাদের শুকরিয়া আদায় করছে। নাস্তিক মুর্তাদরা চায় আমরা যেন আমাদের হালতের উপর থাকি। কোন আলেম নামাজি দ্বীনদার পরহেজগার ব্যক্তি যেন প্রশাসনে না আসতে পারে সেই ফন্দি ফিকিরে আছে তারা।
আজ এই দেশে যেন ইসলাম এতীম হয়েগেলো। মুসলমানরা সংখ্যালঘু। মুর্তিপুজার জন্য ২০০কোটি টাকা জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ। রাষ্ট্র কুফরের সেবায় নিয়োজিত। দ্বীনদাররা রাষ্ট্রের সামান্যতম অধিকার থেকে বঞ্চিত। মাসজিদ মাদরাসার জন্য বরাদ্দ হয়েছে বিরাট কতগুলো শূন্য শূন্য শূন্য। বরং ইসলামকে সমূলে বিনাশ করার জন্য সকল আয়োজন চুড়ান্ত। ঠিক তখনি আমরা ভাবছি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যোগদান করবো কি না?
ঘরে ঘরে আজ সুদের বিস্তার। কারজে হাসানা এখন সমিতিতে চলে গেছে। একশ টাকাও আজ সুদের খপ্পরে নিপতিত। ব্যাংক অফিস আদালত সবখানে নীরবে চলছে ইসলামকে দাফনের সংকল্প। আর আমরা ভাবছি আমাদের মাদরাসাকে রাষ্ট্র থেকে পবিত্র রাখতে? দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে? সত্যিই আমরা সহীহ পথে আছি? আমরা আমাদের কবর খুঁড়ছি। নিজেদেরকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এমন পরিস্থিতি আর চলতে দেয়া যায়না। বিপদ এখন ঘরের বারান্দা থেকে দরজায় খাড়া। সময় একটুও হাতে নেই। তাই প্রথমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। সেই কাজের প্রথম পদক্ষেপ হলো একই বোর্ডের অধীনে আমাদের সকলকে চলে আসা। অতঃপর শাইখুল ইসলাম আল্লামা তকি উসমানির ফর্মুলা অনুযায়ী জামেয়া আল-করউইয়ীনের অনুসরণে সিলেবাস সংস্কারে আত্মনিয়োগ।
উপস্থিত উলামায়ে কেরাম যেন তন্ময় হয়ে শুনছিলেন বক্তব্য। আমরা কি আমাদের লক্ষপানের দিকে এগিয়ে যাবো? একথা বলার সাথে সাথে সবাই সম্বিত ফিরে পেলেন। সমবেত কণ্ঠে উচ্চারতি হলো ঐক্যের ডাক। ‘বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড’র উপর প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন ইতিহাসের পথচলা। সারা বাংলার ঘরে ঘরে আলেম সমাজের মাঝে বইছে এখন ঈদের আমেজ। কুফরের ঘরে চলছে দুঃখের মাতম। শীশাঢালা প্রাচিরের ঐক্যে ফাটল ধরাতে শুরু করেছে মুনাফিকদের আস্তানায়। ইসলামের লেবাছি দুশমনরা বিভ্রান্তি ছড়াতে চেষ্টা করছে। ঐক্য ভাংতে তারা হয়ে উঠেছে মরিয়া। কিন্তু বালাকোটের পোড়খাওয়া ঈমানোদ্বীপ্ত উত্তরসূরিদের ইসপাত কঠিন শপথে দুশমনের হুক্কাহুয়ায় চুল পর্যন্ত নাড়াতে সক্ষম হয়নি।
(ধারাবাহিক উপন্যাস স্বপ্নবিলাস ৫ম পর্ব)
চলবে…