০১. সুন্নী মুসলিম সমাজে তারাবীহর রাকাত কমানোর আন্দোলনটার সূচনা হয়েছে উপমহাদেশের অন্যতম বেদআতী গোষ্ঠী আহলে হাদেছের (হাদেছ মানে আপদ ও নতুন বিষয়) মাধ্যমে আজ থেকে ১৫০ বছর পূর্বে। এর আগে সারা বিশ্বের সুন্নী সমাজের কোথাও ৮ রাকাত তারাবীহ পড়া হতো না। অন্যদিকে আরব দুনিয়ায় তারাবীহর রাকাত কমানোর এ আন্দোলনটা আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে শুরু করেছিল পূর্ব ইউরোপের সুন্নী হানাফী মুসলিম দেশ আলবেনিয়া থেকে পিতা মৌলভী নূহ নাজাতির সাথে দামেস্কে হিজরতকারী জনৈক নাছিরুদ্দীন আলবানী (জন্ম আলবেনিয়ায় ১৯১৪ সালে এবং মৃত্যু ১৯৯৯ সালে জর্দানে)। এ লোকটি ছিল আবুল আলা মওদূদীর চেয়ে আরো বেশি স্বশিক্ষিত নির্বোধ ও চরম বেয়াদব প্রকৃতির মনগড়া চিন্তার লোক। তার যেমন কোনো একাডেমিক শিক্ষার সনদ ছিল না, তেমনি কোনো আলেমের কাছে প্রাইভেট পড়ার অভিজ্ঞতাও ছিল না। প্রথমে সে তার পিতার জীবিকার নির্বাহের মাধ্যম ‘ঘড়ি মেরামত’- এ মনযোগ দিলেও পরে সে সালাফীজম দ্বারা প্রভাবিত মিসরীয় লেখক রশিদ রেজার ‘আল-মানার’ ম্যাগাজিন পড়া শুরু করে এবং তাতে নাকি তার কি একটা লেখাও ছাপা হয়। এরপর সে পিতার নিষেধ অমান্য করে ব্যক্তিগত ভাবে হাদীছের কিতাব পড়ে উল্টা-পাল্টা কথা বলা শুরু করে। প্রথমে সে آداب الزفاف ‘বিয়ের বিধান’ শীর্ষক বই লেখেই তার বিতর্কিত হবার কাজে হাত দেয়। এ বইতে সে নারীর জন্য সর্বত্র সবার সামনে চেহারা খোলা রাখা বৈধ এবং নারীদের সবার জন্য সোনার অলঙ্কার পরা হারাম বলে দাবি করে (উল্লেখ্য, নারীর জন্য সোনার অলঙ্কার ব্যবহারে হাদীছে নিরুৎসাহ এলেও হারাম বলা হয়নি)। এতে সে হাদীছের উদ্ধৃতি দেওয়াতে আওয়ামদের অনেকে চমকে যান। এরপর সে শামে নবপ্রবেশ করা সালাফীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। এ সুবাধে সে একাডেমিক সার্টিফিকেট ছাড়াই নব আবিষ্কৃত পেট্রোডলারের উপর ভর করে গণধিকৃত সৌদি ওয়াহাবী গোষ্ঠী কর্তৃক পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত মদীনা ইউনিভার্সিটিতে হাদীছের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে সক্ষম হয়। অবশ্য অজ্ঞতা ও অহমিকাপূর্ণ কথাবার্তার অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে অল্পকিছুদিনের মধ্যেই সে ওখান থেকে বহিস্কৃত হয়। এরপর সে বৈরুতের المكتب الإسلامي নামক এক অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তার কাজের গতি বাড়িয়ে দেয়। এ সময় সে ‘তারাবীহর নামাজ’ নামে একটি কিতাব লেখে ইবাদত বিমুখ আরবদেরকে তাতে আরো বেশি অমননযোগী হবার পথ সুগম করে দেয়। সে সনদসহ ১০০টি হাদীছও মুখস্ত করতে না পারলেও মুহাদ্দিছগণের কিতাব ঘেঁটে মনমত তাদের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে ‘ছহীহ হাদীছ সিরিজ’, ‘দুর্বল হাদীছ সিরিজ’ লেখা শুরু করে। এ সময় সে ইখওয়ানী বুদ্ধিজীবি ডঃ কারজাবীর ‘ইসলামে হালাল-হারাম’ শীর্ষক একটি বইয়ের কিছু হাদীছ দুর্বল বলে আরো আলোচিত হয়। এরপর সে মুসনদ (সরাসরি সনদযুক্ত) ও নন-মুসনদ কিছু হাদীছের কিতাবের হাদীছের মান বের করার চেষ্টা করে এবং সে তার বিভিন্ন লেখায় নিজেকে সালাফী আকীদার অনুসারী হিসেবে পরিচিত করায় জাহিল সালাফীদের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি পায়। যাই হোক, সারাবিশ্বের সুন্নী ও সালাফী আলেমদের অনেকে তার বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে কিতাব লিখে তার মুখোশ উন্মোচন করেন। সে একই হাদীছকে এক জায়গায় ছহীহ ও আরেক জায়গায় দুর্বল বলা এবং এ ক্ষেত্রে আলেমদের গ্রহণযোগ্য মতামত ও নীতি বাদ দিয়ে প্রত্যাখ্যাত ও দুর্বল মত গ্রহণ করা নিয়ে জর্দানের এক আলেম تناقضات الألباني الواضحات ‘আলবানীর সুস্পষ্ট স্ববিরোধিতা’ নামে তিন খন্ডের একটি কিতাব লিখেছেন (ডাউনলোড লিঙ্ক কমেন্টে)। এতে আলবানীর অজ্ঞতা ও চুরি ধরা পড়ায় তার ভক্তরা এটির কোন জবাব লিখতে পারেনি। তাছাড়া সালাফী আলেমদের অধিকাংশই এ আলবানীকে জাহিল ও উগ্র মনে করে। তার বিরুদ্ধে বিন উসাইমীনসহ কয়েকজন সৌদি আলেম কিতাবও লিখেছেন। আলবানী তার বিভিন্ন রচনায় তার অল্পজ্ঞানজনিত গৌরবের কারণে মাযহাবের ইমামসহ পূর্বসূরী আলেমদের ব্যাপারে কটূক্তি করেছে। জর্দানের ওই আলেম এগুলো একত্রি করে قاموس شتائم الألباني ‘আলবানীর গালিকোষ’ নামে একটি কিতাব রচনা করেছেন (ডাউনলোড লিঙ্ক কমেন্টে)।
০২. সেলফী নির্বোধ সম্প্রদায় দাবি করলেও তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামাজ নয়। তাহাজ্জুদ সারা বছরই পড়া মুস্তাহাব। কিন্তু তারাবীহ সুন্নতে মোয়াক্কাদা। নবীজি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, من قام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه “যে রমজানে ঈমান নিয়ে সওয়াবের আশায় নামাজের জন্য দাঁড়াবে, তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” ছহীহ বোখারী (৩৮) ও ছহীহ মুসলিম (৭৬০)
অন্য আরেক হাদীছে হযরত আবু হুরাইরা বলেন, كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يُرغِّب فى قيام رمضان من غير أن يأمرهم فيه بعزيمة، فيقول: ((من قام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه)). أخرجه مسلم (رقم ٧٥٩).
অর্থঃ বাধ্যতামূলক নির্দেশ ছাড়া রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে (তারাবীহ) নামাজের জন্য দাঁড়াতে উৎসাহ দিতেন এবং বলতেন, “যে রমজানে ঈমান নিয়ে সওয়াবের আশায় নামাজের জন্য দাঁড়াবে, তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” ছহীহ মুসলিম (৭৫৯)
?
ভূয়া মুহাদ্দিছ লালবানী ও সেলফী মূর্খ তর্কবাজ সম্প্রদায় ছহীহ বোখারীতে বর্ণিত হযরত আয়েশার তাহাজ্জুদের যে হাদীছকে তারাবীহ বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করছে, ওই হাদীছের আগের হাদীছে (নম্বর ১৯০৮) একই আয়েশা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক রাতে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে লোকজনও তাঁর পিছনে ইক্তেদা করে এবং পরের দিন সে খবর ছড়িয় পড়লে দ্বিতীয় রাতে লোকজন আরো বড়ে যায়। পরের দিন খবরটি আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ায় তৃতীয় রাতে লোকজন আরো বেড়ে যায়। চতুর্থ রাতে মানুষ এত বেশি হয় যে, মসজিদে সবার জায়াগাও হলো না। ফলে নবীজি ছঃ তাদের নিয়ে তারাবীহ পড়তে আর বের হলেন না। এক পর্যায়ে কিছু লোক নামাজ! নামাজ! বলে আওয়াজ দিলো। তারপরও তিনি বের হলেন না। ফজর হলে তিনি বের হয়ে বললেন, “গত রাতে তোমাদের অবস্থা সম্পর্কে আমি অবগতই ছিলাম। কিন্তু আমার আশঙ্কা হয়েছে, আমি তোমাদের নিয়ে এভাবে নামাজ পড়লে রাতের নামাজ (তারাবীহ) তোমাদের উপর ফরজ হয়ে যাবে এবং তা পরিপূর্ণরুপে আদায়ে তোমরা অক্ষম থেকে যাবে।” এ হাদীছটি ছহীহ মুসলিমেও (নম্বর ৭৬১) রয়েছে। তো এ হাদীছটির পরের হাদীছে হযরত আয়েশা থেকে নবীজি ছঃ রমজানসহ সারা বছর রাতে ৮ রাকাতই পড়তেন বলে যে কথা বর্ণিত হয়েছে, তা পাঁচ কারণে ব্যাখ্যা ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়।
?
এক. হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত বোখারীর তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে বর্ণিত এক হাদীছে (নম্বরঃ ১০৮৮) তিনি বলেছেন, “নবীজি ছঃ ফজরের দুই রাকাত সুন্নত ছাড়া রাতে ৭, ৯ অথবা ১১ রাকাত নামাজ পড়তেন।” তো এ হাদীছের উপর ভিত্তি করে নির্বোধ লালবানীর ভক্ত ও আহলে হাদেছ সম্প্রদায় তারাবীহকে ৮ এর পরিবর্তে ৪ রাকাতে নিয়ে এলে তাদের স্যুট-বুট-টাই পরা জেনারেল শিক্ষিতদের জন্য আরো সুবিধা হয় এবং তাদের দল আরো ভারী হবে।
?
দুই. হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত বোখারী ও মুসলিমের আরেক হাদীছে তিনি বলেছেন, كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا دخل العشر الأواخر أحيا الليل وأيقظ أهله وجد وشد المئزر “রমজানের শেষ দশক এলে নবীজি ছঃ সারারাত ইবাদত করতেন, স্ত্রীদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতেন এবং কোমর বেঁধে ইবাদতে আন্তরিক/পরিশ্রমী হতেন।” দেখুন ছহীহ বোখারী (হাদীছ নম্বর ১৯২০) ও ছহীহ মুসলিম (হাদীছ নম্বর ১১৭৫)।
সারারাত মিলে নবীজি ছঃ শুধু আট রাকাত নমাজ পড়তেন! অসম্ভব।
?
তিন. আরো কয়েকটি হাদীছে রাতে নবীজির ছঃ আট রাকাতের চেয়ে বেশি নামাজ আদায়ের কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন ছহীহ বোখারীর তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে বর্ণিত এক হাদীছে (নম্বরঃ ১০৮৭) নবীজির ছঃ চাচাতো ভাই ও তাঁরই স্ত্রী হযরত মায়মুনার ভাগিনা হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস বলেন, كانت صلاة النبي صلى الله عليه وسلم ثلاث عشر ركعة. يعنى بالليل
“রাতে বিতিরসহ নবীজির ছঃ তাহাজ্জুদ নামাজ ছিল ১৩ রাকাত।”
?
চার. নবীজি ছঃ হযরত আয়েশার সাথে সপ্তাহে সর্বোচ্চ একটি রাতই যাপন করতেন। তাই তার এ দাবিটি পুরোপুরি সত্য হতে পারে না। কারণ, তিনি বছরের ৩৬০ রাতের মধ্যে নবীজিকে ছঃ সর্বোচ্চ ৪০-৫০ রাতই পেয়েছেন।
?
পাঁচ. সনদ দুর্বল হলেও চারটি প্রসিদ্ধ মুসনদ হাদীছগ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে,
عن ابن عباس رضي الله عنهما ( أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّي فِي رَمَضَانَ عِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْرَ ). أخرجه ابن أبي شيبة في ” المصنف ” (2/ 164)، وعبد بن حميد – كما في ” المنتخب ” (رقم653)- والطبراني في ” المعجم الكبير ” (11/393)، و” المعجم الأوسط ” (1/243)، والبيهقي في ” السنن الكبرى ” (2/698).
“নবীজি ছঃ রমজানে বিতির ও আরো বিশ রাকাত নামাজ পড়তেন।” মুছন্নফে ইবনে আবু শায়বা (২/১৬৪), মুসনদে আবদ ইবনে হুমাইদ (৬৫৩), মু’জমে তবরানী কবীর (১১/৩৯৩) ও সুনানে বাহাকী কোবরা (২/৬৯৮)
এবার আসি হযরত আয়েশার ৮ বা বিতিরসহ ১১ রাকাতের হাদীছের সঠিক অর্থে। এ হাদীছ তথা হযরত আয়েশার কথার আগে একটি কথা উহ্য রয়েছে এবং তাহলো এই, “আমার জানামতে” অথবা “অধিকাংশ সময়”। অর্থাৎ, নবীজি ছঃ বছরের অধিকাংশ সময় বিতিরসহ ১১ রাকাত صلاة الليل রাতের নামাজ পড়তেন। সবসময় নয়। যেমন রমজানে বা এর শেষ দশকে তিনি আরো বেশি রাকাত অথবা বিশ রাকাত পড়তেন।
আল্লাহ সবাইকে ছহীহ বুঝ দান করুন।
(লেখাটির আগামী পর্ব দেখার অপেক্ষা কাম্য)
আবুল হুসাইন আলেগাজী
০৬. ০৬. ২০১৬, সোমবার