সুদীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত শ্রান্ত বাকি ইবনে মাখলাদ। ভ্রমণজনিত ক্লান্তিতে বিষণœ অবসন্ন। সামানপত্র নিয়ে কোনোমতে উঠেছেন হোটেলে। একটি রুম ভাড়া নিয়ে তাতে আপাতত থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। সঙ্গের গাঁটুরিটা বেশ বড়ো। কতো কি গাঁটুরিতে! জামাকাপড়, কিতাবপত্র, দোয়াত-কলম, শুকনো খাবার, পানি; দূর সফরের আবশ্যকীয় জিনিসপত্র। সুদীর্ঘ ভ্রমণের পর কোথায় একটু বিশ্রাম নিবেন, দু’এক দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবেন; দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল সেরে উঠবেন, কিছুই করলেন না তিনি। সোজা চললেন মসজিদপানে। মন যে তার মানছে না। একমুহূর্ত তর সইছে না। যে উদ্দেশ্যে এসেছেন যদি সফল না হন। যদি উটকো ঝামেলা বেঁধে যায় বা যার উদ্দেশ্যে এসেছেন তিনি কোথাও চলে যান। ইত্যকার হাজারো দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত বাকির মন। তাই বিশ্রামটুকু আপাতত মুলতবি রেখে তখনই ছুটলেন মসজিদের দিকে।
সুদূর উন্দুলুস (স্পেন) থেকে শুনেছেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের সুনাম সুখ্যাতি। শুনে শুনে আকুল হয়ে উঠেছেন তাকে দেখার জন্য, তাঁর দরসে বসার জন্য এবং তাঁর ইলমসুধা পানে তৃপ্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু দূরত্বের কথা মনে হলেই বুকটা ধক করে উঠতো। অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেতো। কারণ, সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে, পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে, মরু-অরণ্য পাড়ি দিয়ে তবে পৌঁছতে হতো বাগদাদ। দীর্ঘ পথের কথা ভেবে মনটা দমে যেতো; আশার বেলুনটা চুপসে যেতো।
একবার ভেবে ভেবে তিনি খুবই উদ্দীপ্ত হলেন। সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞায় হলেন প্রত্যয়দীপ্ত। আর ভেবে কাজ নেই; এবার রওয়ানা হবেন। সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে, মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সত্যিই তিনি একদিন রওয়ানা হলেন।
বাগদাদের ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল। বিশ্বজোড়া তাঁর খ্যাতি। বিশাল তাঁর হালকায়ে দরস। দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে ইলম পিপাসুর দল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁর দরসে। মুসলিম বিশ্বের সর্বজনমান্য ইমাম। বিশেষত ইলমে হাদিসের অবিসংবাদিত ইমাম। তাঁর স্বীকৃতি পেলে অন্যরা বর্তে যান। কারো ব্যাপারে মুখ খুললে ইলমের আকাশ থেকে ঝরে যান। তাঁর দরসে শামিল হতে পারা যে বড়ো সৌভাগ্যের ব্যাপার!
ইলমে হাদিসের জন্য তিনি সীমাহীন কষ্ট করেছেন। তাবৎ পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন। মুসলিমবিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন তিনি হাদিসে জন্য। পাহাড়-পর্বত, নদী-সাগর, মরু-অরণ্য সব একাকার করে ফেলেছেন। এমন কোনো বিখ্যাত মুহাদ্দিস নেই যার কাছে তিনি যাননি; যার জাম্বিল উজাড় করে আনেন নি। পুরো বিশ্বের ইলম তিনি ছেঁকে এনেছেন। বিশাল বিপুল কিতাব লিখে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। নিজেকে নিয়ে গেছেন আকাশের উচ্চতায়।
কুদরতের লীলা বোঝা দায়! বাকি ইবনে মাখলাদ মসজিদে গিয়ে জানতে পারলেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল অন্তরীণ আছেন। বাদশা কর্তৃক অবরুদ্ধ। কোথাও যেতে পারেন না, দরস দিতে পারেন না; কেবল বাড়িতে বসে থাকেন। কোনো কারণে তিনি বাদশার বিরাগভাজন হয়েছেন। সত্যকে সত্য বলাতে হয়েছেন তাঁর রোষানলের শিকার। মিথ্যাকে সত্যের প্রলেপ দিতে রাজি হননি বলে তাঁর জীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। বাদশার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, তার চাবুকের ঘা খেয়েও তিনি আছেন সত্যের ওপর অটল অবিচল।
সবসময় বাড়িতেই থাকেন। দূর দূরান্ত থেকে অনন্ত পিপাসা নিয়ে আসে তালিবে ইলমের দল। দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে একরাশ বেদনা নিয়ে চলে যায়। আর বাদশার প্রতি ক্ষোভে ঘৃণায় ফেটে পড়ে।
ঘটনা শুনে বাকি ইবনে মাখলাদ ভীষণ মর্মাহত হলেন। দুঃখ-বেদনায় হলেন ভারাক্রান্ত। যাকে দেখার জন্য, যার দরসে বসার জন্য সুদূর উন্দুলুস থেকে এসেছেন, তাকে হয়ত দেখা হলো না! তাঁর দরসে বসা হলো না! বেদনায় ভারাক্রান্ত হলেও তিনি ভেঙ্গে পড়লেন না। কৌশল খুঁজতে লাগলেন, কীভাবে তাঁর সঙ্গে দেখা করা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, তাঁর সঙ্গে দেখা অবশ্য করা যায়, তবে বাদশার কোপানলে পড়ার আশঙ্কা আছে। গোয়েন্দা লাগানো আছে। প্রত্যেকের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা হয়। কে পড়তে চায় উটকো ঝামেলায়, তাই ওপথ কেউ মাড়ায় না।
বাকি ইবনে মাখলাদ ছদ্মবেশ ধরলেন। ফকির সাজলেন। ছিঁড়াফাঁড়া ময়লা জামা। উশকু-খুশকু চুল। মাথায় জটাজুট। হাতে একখান লাঠি। একটু কুঁজো হয়ে চলছেন ইমাম আহমদের বাড়ি। অপরিচিত ভিক্ষুক দেখে কেউ তেমন গা করলো না। তিনি সোজা পৌঁছে গেলেন ইমাম আহমদের বাড়িতে। দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক দিলেন—আল্লাহর ওয়াস্তে ভিক্ষা দিন। কুদরতের অপার কারিশমা যে, দরজা খুললেন স্বয়ং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল!
ইমাম আহমদের পরিচয় পেয়ে তিনি আবেগে কেঁদে ফেলেন। পরে শোনান নিজের দীর্ঘ ভ্রমণের ইতিবৃত্ত। ইমাম আহমদ বড়ো বিচলিত হলেন। সান্ত¡না দিয়ে বললেন, দেখো, তোমরা যারা দূর দূরান্ত থেকে আসো, তোমাদের একটু খেদমত করতে পারলে আমারও ভালো লাগতো। কিন্তু কী করি বলো? বাদশা তো যেতে দিচ্ছেন না। এমনকি কেউ এলেও হয়রানি করেন। তাই ভয়ে কেউ আসেও না। বাকি ইবনে মাখলাদ তখন অদ্ভুত এক প্রস্তাব করে বসলেন। বললেন—হুজুর, আমি তো পরদেশী মুসাফির; আমাকে কেউ চিনবে না। প্রতিদিন আমি ফকিরের বেশে আসবো, আপনি আমাকে দু’চারটি হাদিস শুনিয়ে দিবেন; এতেই আমার চলবে। ইলমের প্রতি তার অদম্য আকর্ষণ দেখে তিনি প্রীত হলেন। তার অদ্ভুত প্রস্তাবও মঞ্জুর করলেন। তবে শর্ত দিলেন—কেউ যেনো জানতে না পারে। এভাবে চলতে লাগলো তাঁর হাদিসের দরস। বাকি ফকিরের বেশে আসেন। দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক দেন। ইমাম আহমদ দরজা খুলে দেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটা হাদিস শুনিয়ে দেন। হাদিসক’টা শুনে তিনি তাড়াতাড়ি কেটে পড়েন। এভাবে কয়েকশ হাদিস তিনি শুনে নেন।
এভাবে অনেক দিন কেটে গেলো। বাদশা একদিন মারা গেলেন। তার স্থানে এলেন আহলে সুন্নাতের অনুসারী বাদশা। ইমাম আহমদ মুক্তি পেলেন। তাঁর সুনাম-সুখ্যাতি আরো বেড়ে গেলো। বিশ্বজোড়া ছড়িয়ে পড়লো তাঁর মুক্তির সংবাদ। তালিবে ইলমরা আবারো হুমড়ি খেয়ে পড়লো তাঁর দরসে। দূর দূরান্ত থেকে আসতে লাগলো ইলম পিপাসুর দল।
বাকি ইবনে মাখলাদ বলেন, আমি তখন দরসে এলে আমাকে তিনি কাছে ডেকে নিতেন। খুবই মহব্বতপূর্ণ আচরণ করতেন। গর্বভরে বলতেন—এ হলো প্রকৃত তালিবে ইলম। পরে সবিস্তারে শোনাতেন আমার ছদ্মবেশের কাহিনী। তিনি পা-ুলিপি দিতেন, আমি পড়তাম। কখনো তিনি পড়ে শোনাতেন।
একবার আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম। প্রচ- জ্বরে মুমূর্ষুকাতর। ফলে দরসে শামিল হতে পারলাম না। আমাকে না দেখে তিনি বিচলিত হলেন। জানতে পারলেন, আমি অসুস্থ। তৎক্ষণাৎ তিনি ছাত্রদের নিয়ে চলে এলেন আমাকে দেখতে। হোটেলের ভাড়া ঘরে আমি শুয়ে আছি। মাথার নিচে ইট। গায়ে একখান চাদর। শিথানের পাশে কিতাবাদি। হঠাৎ একটা শোরগোল শোনা গেলো। লোকেরা বলাবলি করছে—দেখো, দেখো, এই যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল! মুসলিম বিশ্বের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ইমাম, এদিকে আসছেন! হোটেলের মালিক দৌড়ে এলো আমার কাছে। বললো, ইমাম সাহেব তোমাকে দেখতে আসছেন! খুশিতে আমি তো আত্মহারা।
একটু পরেই তিনি এলেন। বসলেন একদম আমার শিথানের পাশে। তালিবে ইলমের নুরানি কাফেলায় রুমটা ভরে গেলো। বাইরেও দাঁড়িয়ে রইল সমসংখ্যক। সবার হাতে কাগজ কলম। ইমাম সাহেব পাশে বসে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। সান্ত¡না দিলেন এবং কিছু দোয়া পড়লেন। দেখলাম তালিবে ইলমরা দোয়াটি লিখে নিলো। কিছুক্ষণ থেকে তিনি চলে গেলেন।
তিনি যেতেই হোটেলের সবাই এলো আমাকে স্বাগত জানাতে। আমার গুরুত্ব বেড়ে গেলো। আমাকে নিয়ে শুরু হলো টানাটানি। কেউ এনে দেয় বালিশ, কেউ বিছানার চাদর, লেপ-তোশক, হরেক রকম উপাদেয় খাবার। তারা এমনভাবে আমার সেবা করতে লাগলো যে, নিজ পরিবারে থাকলেও হয়ত এতোখানি সেবা জুটতো না। ইমাম সাহেবের বরকতে আমার সৌভাগ্যের দ্বার খুলে গেলো। (উলুওউল হিম্মাহ : ১৭৪)