ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক : স্পেনের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে ভূমধ্যসাগরে বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জেও মুসলিম ঐতিহ্যের নিদর্শন রয়ে গেছে। এ দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পালমা শহরের প্রাচীন মহল্লায় মুসলিম নিদর্শনের ছড়াছড়ি। এ দ্বীপপুঞ্জের ইবিজা শহরে আবার রয়েছে উত্তর আফ্রিকার কার্থেজবাসীদের সভ্যতার নিদর্শন। উত্তর আফ্রিকার কার্থেজবাসী যারা মূলতঃ আরব-ফিনিসীয়, ইবিজা শহর প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রাচীন মহল্লায় নিরাপত্তা প্রাচীরের ভিতর সরু সরু সড়ক ও প্রাচীন ঘরবাড়ী রয়েছে।
স্পেনীয় খাদ্যে মুসলিম প্রভাব পড়েছে। তাদের খাদ্যে যে ফল ও সবজি ঢুকেছে, তা মুসলমানদের অবদান। “ডেজার্ট” খাবার ভোজনের শেষে পরিবেশন মুসলিম সংস্কৃতির অবদান। এছাড়া মিষ্টি, ‘নওগাট’ ও আইসক্রিমও স্পেনের খাদ্যে মুসলিম অবদান। কনফেকশনারী ও পেসট্রিও তো স্পেনে আরব মুসলমানদের অবদান। এই তথ্যগুলো সম্পর্কে প্রমাণের জন্য দেখুন স্পেন সরকার কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা “স্পেন” (পৃষ্ঠা ৩০-৩১)। “গাজপাচো” নামক ঠান্ডা আন্দালুসীয় স্যুপও তো মুসলিম ঐতিহ্যের। এর ভিতর থাকে টমেটোর টুকরো, জলপাই তেলে গোলমরিচ, ভিনিগার, রসুন প্রভৃতি।
পূর্ব স্পেনে আলকয় শহরে মুর (মুসলমান) বনাম খৃষ্টান নাটকীয় খেলা হয়। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ও অস্ত্রে কৃত্রিম কিল্লায় দিনকতক দখল নিয়ে এ এক মজার অভিনয় চলে এই শহরে। বহু পর্যটক তা দেখে। অভিনয়ের প্রথমে মুসলমান পরিচয়ের অভিনয়কারী কৃত্রিম কিল্লা দখল করে থাকবে। তারপর খৃষ্টান পরিচয়ের অভিনয়কারী। একবার প্রথম গোষ্ঠী কিল্লার দখল পরবর্তীকে না দিলে, পুলিশ ডেকে তা দেয়া হয়েছিল বলে টিভির তথ্যে জানা যায়।
স্পেনের ‘ফ্যাশন’ ও ‘হ্যান্ডিক্রাফটস’-এ প্রচুর মুসলিম প্রভাব। মুসলমানরা সেরামিক টাইলস ব্যবহার করে সুদৃশ্য শিল্প সৃষ্টি করত। টলেডো, গ্রানাডা, সেভিল ও ভ্যালেনসিয়া এখনও সেরামিক দ্রব্যের জন্য যার ভিতরে তৈজসপত্রও রয়েছে। চামড়া শিল্পে “কর্ডোভান” একটা ব্রান্ড নামে পরিণত হয়েছে। চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যে কর্ডোভা এখনও নামকরা।
সূচি শিল্পের মুসলিম ঐতিহ্য এখনও স্পষ্ট স্পেনে। টলেডো, সিউদাদ রিয়াল প্রভৃতি স্থানের সূচি শিল্পের নাম রয়েছে। মুসলিম আমলে টলেডো ও আলবাসেত ইস্পাত শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখনও দামাস্কাসের নামে “দামাসকেন” ইস্পাত ব্রান্ড-এর আছে খ্যাতি। দামাস্কাস ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র। টলেডোতে ইস্পাতের উপর সোনালী পাত বা সোনালী সূতা লাগিয়ে তরবারী চাকু-ছুরি ও অন্যান্য অস্ত্র-শস্ত্র তৈরি হত দামাস্কাসের অনুসরণে। ইস্পাতে এ ধরনের খোদাই কাজ খুবই সূক্ষ্ম ও সময় সাপেক্ষ। আমার স্ত্রী ও আমি টলেডোর হ্যান্ডি ক্রাফট দোকানগুলোতে সুদৃশ্য তরবারী দেখেছি। এগুলো সমগ্র পৃথিবীতে উপহার হিসেবে যায়। টলেডোর তরবারী অনেক সামরিক একাডেমীর প্যারেডের গর্ব।
স্পেনে মুসলিমরা প্রায় আটশো বছর ছিল। কতকটা বাংলাদেশে মুসলিমদের থাকার মতই। আটশো বছর থেকেও তারা আজ আর স্পেনে নেই। হালে সামান্য কিছু মুসলিম অভিবাসী নিম্নস্তরের কাজ নিয়ে সেখানে গেছে। স্পেনের ইতিহাস সংক্রান্ত পটভূমিকা জানলে মুসলিমদের উত্থান-পতনের বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এমন এক সময় ছিল যখন বলা হত ইউরোপ পিরেনিজ পর্বতে শেষ। এখনও তো স্পেন-পর্তুগালে গেলে বুঝতে পারবেন এটা ইউরোপ নয়, এটা মরক্কোর বর্ধিত এলাকা-সাংস্কৃতিকভাবে অবশ্য।
একটা মশহুর কথা “ফডরস এক্সপ্লোরি; স্পেন” বইয়ের: “স্পেন ইজ, স্পেন ওয়াজ” (পৃ.২২)- স্পেন হল তাই যা অতীতে ছিল অর্থাত্ স্পেনের যে আজ এই হাঁক-ডাক তা তার পুরাতন কৃতিত্ব ও ঐতিহ্যের জন্য যখন সে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ দেশ ছিল—ছিল ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজধানী, আর মুর মুসলিম, খৃষ্টান ও ইহুদী সবাই মিলে শান্তির দেশ গড়ে তুলেছিল।
ভিসিগথ জার্মান উপজাতির মূল দেশকে ‘ভানদালুসিয়া’ বলা হত। সম্ভবত: মুর মুসলমানরা সে শব্দ থেকে স্পেনের নতুন নামকরণ করে আন্দালুসিয়া। উল্লেখ্য যে, জার্মান ভিসিগথ উপজাতির শাসক থেকেই মুসলমানরা আইবেরীর উপদ্বীপ দখলে নেয়। “ফডরস এক্সপ্লোরিং স্পেন” বইয়ে লেখা রয়েছে, “স্পেনের খৃষ্টানরা মুরদের চেয়ে বেশী আদিম (সেকেলে) হলেও, আস্তে আস্তে তারা শক্তিশালী হল ও কয়েক শতকের ভিতর তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হল।” (পৃষ্ঠা ৩৩)
সৌজন্যে : দৈনিক ইত্তেফাক