ইউসুফ বিন তাশফিন::
– স্বপ্নবিলাস (৪র্থ পর্ব)
ডান হাতে পানি নিয়ে মনে হচ্ছে এক ঢুকে গিলে ফেলবেন। সারা জীবন সুন্নাতের পাবন্দ শাইখ তকিউদ্দীন আল-কিন্দী নিজেকে নিজের কাছে একটু বেশি অস্থীর মনেহলো। একটু কষ্ট করে হলেও স্বাভাবিক হওয়ার মতো পাতানো চেয়ারে বসে তিন তিনটি ঘুটে পানি পান করে আলহামদুলিল্লাহ বলে খালি গ্লাস বাড়িয়ে দিলেন বেগম জহুরা খাতুনের হাতে। স্বামীর হাত থেকে গ্রাস নিয়ে টেবিলের উপর রেখে চিন্তাশু মনে জিজ্ঞেস করলেন কেমন যেন পেরেশান লাগছে আপনাকে? না, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো আজ আমি একটু জেগে থাকবো। অবশ্য মাঝে মধ্যে মুতায়ালা ও তাসনিফাতের জরুরতে এভাবে বিনিদ্র রজনী কাটানো কোন নয়া বিষয় নয় ভেবে তিনি ভেসে গেলেন ঘুমের সাগরে। শাইখ আল-কিন্দির রুটিন হলো শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পরে বিতির আদায় করে ফজরের জন্য মসজিদে যাবেন। আজ একটু আগে জায়নামাজ বিছিয়ে লম্বা নামাজে সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। ফাঁফানো কান্নার আওয়াজ গিয়ে পৌছলো বেগম জহুরার কাচা ঘুমের কানে। বিড় বিড় করে দোয়া আর রোনাজারির আওয়াজ।’হে আল্লাহ আজ এই জমিনের উপর থেকে যেন তার নীচ হয়ে গেছে উত্তম। হাজার হাজার মসজিদ মাদরাসা আর ওলি আউলিয়া ও দরবেশের এই দেশে আজ প্রকাশ্যে চলছে তোমার নামের নাফরমানী। মাওলা ওরাতো কোন কোন মুসলমানের সন্তান! আজ আমাদের দুর্বলতার কারণে মুসলমানদের সন্তানরা খোদাদ্রোহী উঠছে। আমাদের অদুরদর্শিতার কারণে তারা এখন কাফিরের খপ্পরের শিকার। দিকে দিকে মিছিল হচ্ছে প্রতিবাদ হচ্ছে কিন্তু কোন কাজ হচ্ছেনা। প্রতিটি স্কুলে কলেজ ভার্সিটি যেন খোদাদ্রোহীদের আস্তানা।ওগো মাওলা কাল কবরে যদি তুমি প্রশ্ন করো-হে তকিউদ্দীন ! মসনদে বসে বসে বড় আয়েশে দারসে বোখারি দারসে তিরমিজি দারসে মুসলিম দিয়েছোতো খুব সুনামের সাথে। আর ওদিকে আমার বান্দারা শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে ঈমান হারা হচ্ছে। তুমি একটি বারের মতো খবর রাখনি কেন? আমার কোন জবান নাই।
আমরা তাগুতকে সমাজের বিস্তীর্ণ জায়গা খালি করে দিয়ে নিজেরা নিজেদেরকে মসজিদ মাদরাসার ভিতর বন্দি করে রেখেছি। ভাবছি এভাবেই সোজা জান্নাতে চলে যাবো! মাওলা আমাকে মাফ করো। ক্ষমা করো। আমার অযোগ্যতা ও দুর্বলতাকে কাটিয়ে যাতে এই ভুলপথে চলা মানুষগুলোকে হিদায়েতের পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারি সেই তৌফিক দাও। বেগম জহুরা আর বিছানায় স্থীর থাকতে পারলেননা। তড়িৎ উঠে এসে স্বামীর পাশে পিছনে বসে ভেজা ভেজা চোখে আমীন বলতে লাগলেন। অনেক্ষণ পর্যন্ত দোয়া চললো। স্বামী স্ত্রী উভয়ের চোখা চোখি হতেই হাতের ইশারায় বললেন বিছানায় চলে যাও ফজরে তোমাকে ডেকে দেবো। কিন্তু আজ আর বেগম জহুরার মন বিছানায় যেতে চাইলোনা। কিচেনে গিয়ে গরম এক গ্লাস দুধ এনে একটু হালকা ঠান্ডা করে স্বামীকে দিলেন পান করতে। বিতির শেষে জায়নামাজে অপেক্ষারত শাইখ আল-কিন্দী অর্ধেক গ্লাস পান করে হাতে দিয়ে বললেন শেষ করে নাও। ফজরের জন্য মসজিদের দিকে রওয়ানা হলেন।
বেগম জহুরা আজ একটু চিন্তিত। স্বামীকে বড় ধরনের এক টেনশনে পেয়ে বসেছে। তবে শেষ রাতের দোয়াতে যা শোনেছেন তাতে তিনি খুবই মুগ্ধ। তিনি ভাবছেন স্বামীকে কিভাবে এই জেহাদে সহযোগিতা করা যায়। উম্মাহর ফিকির তাকেও পেয়ে বসলো। ফজরের পর খানিক তেলাওয়াত অতঃপর সকলে মিলে টেবিলে বসে নাস্তা খাওয়া একসাথে ইহা তাদের খান্দানী অভ্যাস। আজকের টেবিল টকের জন্য সালমা খালিদ অপেক্ষার প্রহর গুনছে। নিশ্চয় আব্বা সারা রাত ফিকির করে আমাদের জন্য কোন দিকনির্দেশনা তৈরী করে রেখেছেন। বেগম জহুরাও কোন কোন সময় স্বামীকে মায়া ভরে শাইখ আল-কিন্দী বলে ডাকতে ভালবাসেন। বিশেষ করে খাবার টেবিলে বসলে এভাবে খুশগল্প হয়। কিন্তু আজ সবার চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। যাকে টেবিলে বসতে কখনো ডাকতে হতোনা সেই তিনি আজ নাস্তা খাবার ভুলে এক ভাবুক হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। সালমা বাবাকে অনুরোধ করে টেবিলে বসালো। কিন্তু কারো সাথে কোন কথা হলোনা।
ঘড়ির কাটা ৯টা। আধা ঘন্টা আগে মাদরাসায় গিয়ে শিক্ষক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। অতঃপর ৯:৫৯ মিনিটে ক্লাসের দরজায় উপস্থিত। ১০টার একমিনিট কম কিংবা বেশি হতেই পারেনা। তিনি টাইমের মানুষ। সারাটা জীবন চলেন নিয়মে বাঁধা ছকে। প্রতিদিন হাশাস বাশাস চেহারায় সালাম করে ক্লাসে প্রবেশ করেন কিন্তু রক্তিম চেহারা। লাল চোখ দুটো জানান দিচ্ছে যে আজ শাইখ আল-কিন্দীর ঘুম হয়নি বেশি। বসেই হামদ ও ছানা পড়ে বললেন- আজ কিতাবি সবক হবেনা। যে সবক দিতে দিতে কিতাবের পাতায় লালচে ধরেছে, মরিচা ধরেছে ওয়ালে, কত যে ডেস্ক ভেংগে খান খান হয়েছে, কত কার্পেট বদলানো হলো কিন্তু তাতে কি লাভ হয়েছে? বিল্ডিংগের বাহার মুজাইকের সৌন্দর্য্য খুবতো হলো! সমাজ কি পেল আমাদের কাছ হতে? আজ দেয়ালে পিঠ টেকার উপক্রম। মাত্র ৫% মানুষ যারা মাদরাসা শিক্ষার সাথে জড়িত! বাকি ৯৫% মানুষের ঈমানে অবস্থা কেমন আমরা পরখ করে দেখেছি? সংসদ থেকে সচিবালয়, পুলিশ থেকে আর্মি, প্রশাসন থেকে শ্বশান সব জায়গায় আজ কারা? আমরা আজ কেন অন্যের করুণার পাত্র? কেন আজ মা বোনের হিজাব টেনে টেনে ছিড়া হচ্ছে? কলেজ ভার্সিটিতে অলিতে গলিতে চলছে ইজ্জত লুন্ঠন! এই দারসে বোখারীর কি মর্যাদা রক্ষা করতে পারছি আমরা? পিনপতন নীরবতায় ছাত্ররা শাইখ আল-কিন্দীর কথা শোনছে। একজন সাহস করে বললো হজরত আমাদের পারমিশন দিন আমরা ঝাপিয়ে পড়বো! একটু হালকা কণ্ঠে মুচকি হেসে বললেন-বেটা তোমাকে ধন্যবাদ! আচ্ছা বলতো কিভাবে মোকাবেলা করবে? কি আছে তোমার কাছে? হজরত আমরা মিছিল করবো, লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় বেরোবো, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কুফরের আস্তানা মাটির সাথে মিশিয়ে দেবো!
আচ্ছা বেটা ইতিপুর্বে কি এদেশে মিছিল হয়নি? লাঠিসোটা নিয়ে কেউ বের হয়নি? জ্বালাও পোড়াও ভাংচুরের ইতিহাস কি কম হয়েছে? সবাই যেন হেরে গেল। তাদের বলার যেন আর কিছু বাকি থাকলোনা। তারপরও বললেন যে ঠিক আছে তোমরা তৈরী থাকো আমরা পরামর্শ কইরা লই। মাদরাসার দফতরে দুপুরের ব্রেইকে তামাম আসাতেজা উপস্থিত। মুহতামিম সাহেবও বসে আছেন বড় গদ্দিতে। নাজিমে তালিমাত কী যেন লিখছেন। পানদান চালনার ফাঁকে শাইখ তকিউ্দ্দীন আল-কিন্দী কিছু পত্রিকার কাটিং হাতে নিয়ে সমবেত আসাতেজায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইছেন। মুহতামিম সাহেব তাকে খুব সমীহ করেন। বললেন আপনি যেন কিছু ফরমানোর মোডে আছেন! তিনি সুযোগের সদব্যবহার করলেন। বললেন-সম্মানিত উলামায়ে কেরাম,নিশ্চয় আপনাদের নজর এড়ায়নি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি। পুরো দেশব্যাপী চলছে এক অঘোষিত যুদ্ধ। যে যু্দ্ধটা ইসলামকে মুছে ফেলার যুদ্ধ। মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্য মিটিয়ে দেয়ার এক নিকৃষ্ট মহড়া। আমাদের কি কোন দায় নেই জিম্মাদারী নেই?
হ্যাঁ দায় আছে জিম্মাদারী আছে এ কথা বলে মুহতামিম সাহেব আজ ছুটির পর চা পানের দাওয়াত দিয়ে সকলকে দফতরে আবার জমায়েত হওয়ার অনুরোধ জানালেন।
– স্বপ্নবিলাস (৪র্থ পর্ব)
(কমাশিসা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। সোনালী দিনের দ্বার উন্মোচনে কাজ করছে অবিরাম। ২০১৭থেকে বেফাক কেমন হবে তারই ধারণা নিয়ে ইহা একটি ধারবাহিক উপন্যাস- স্বপ্নবিলাস।)