কওমী মাদ্রাসাগুলো সরকারের অধীনে না আসার পেছনে এর পরিচালনাকারীদের বিভক্তিই অন্যতম কারণ বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। আর তাদের এই বিভক্তির পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক মতাদর্শ।
অনলাইন ডেস্ক :: অন্যদিকে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সনদের স্বীকৃতি দিতে সরকার উদ্যোগ নিলেও হেফাজতে ইসলামের হুমকির পর তাতে ভাটা পড়েছে; হেফাজত ‘চুপ’ থাকায় চুপ রয়েছে সরকারও।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ঢাকার ডেমরায় বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক), গোপালগঞ্জে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া, সিলেটে আজাদবিনি এদারায়ে তামিল মাদারিসিল, চট্টগ্রামে এত্তেহাদুল মাদারিসিল আরাবিয়া এবং বগুড়ায় তানজিমুল মাদারিসিল নামে অঞ্চলভিত্তিক পাঁচটি ‘বোর্ড’ এর মাধ্যমে কওমী মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হচ্ছে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী বেফাকের চেয়ারম্যান। আর গোপালগঞ্জ বোর্ডের পরিচালনার দায়িত্বে আছেন গওহরডাঙা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রূহুল আমীন।
অন্যদিকে মাওলানা জিয়া উদ্দিন ও আব্দুল বাসেদ বরকতপুরি সিলেট বোর্ড, বগুড়া বোর্ডে আব্দুল হক হাক্কানী, মাহমুদুল হক বেওথা ও আব্দুর রহমান এবং চট্টগ্রাম বোর্ডে আব্দুল হালিম বোখারী পরিচালনার দায়িত্বে আছেন।
বেফাকের অধীনে পরিচালিত পাঁচ হাজার দুটি কওমী মাদ্রাসায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। অন্য চারটি বোর্ডের প্রতিটির অধীনে রয়েছে এক থেকে দেড় হাজার কওমী মাদ্রাসা।
কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল শাহ আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান, শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরীদ উদ্দীন মাসঊদকে কো-চেয়ারম্যান এবং রূহুল আমীনকে সদস্য সচিব করে ১৭ সদস্যের কমিশন গঠন করে সরকার।
কমিশনের বেশ কয়েকজন সদস্য ফরীদ উদ্দীন ও রূহুল আমীনকে সরকার সমর্থক হিসাবে অভিযোগ করলে আহমদ শফী কো-চেয়ারম্যান-১ পদে আশরাফ আলী ও সদস্য সচিব পদে আব্দুল জব্বারের নাম দিয়ে কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানান। এদের মধ্যে আব্দুল জব্বার বেফাকের মহাসচিব।
একই সঙ্গে বেফাকের নামে কওমী সনদের স্বীকৃতি দেওয়া, বেফাককে অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় করা, সরকারি অনুদান না নেওয়া এবং কওমী মাদ্রাসার পাঠপদ্ধতি পরিবর্তন না করাসহ আটটি প্রস্তাব তুলে ধরেন আহমদ শফী।
বেফাকের এসব দাবি নিয়ে অন্য চারটি বোর্ড আপত্তি জানালে আহমদ শফীসহ বেফাক নেতারা ওই কমিশনে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। পরে কমিশনের অন্যরা মিলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়।
আব্দুল জব্বার দাবি করেন, ২০১২ সালের ৮ এপ্রিল কওমী মাদ্রাসা বোর্ডের পক্ষ থেকে বোর্ডের প্যাডে হাতে লেখা দুই পাতার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের জন্য দেওয়া হলেও রূহুল আমীন ও ফরীদ উদ্দীন তা সরিয়ে নিজেদের বানানো পাঁচ পাতার কম্পিউটার কম্পোজ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীকে দেন।
রূহুল আমীন ও ফরীদ উদ্দীনকে সরকারের ‘দালাল’ অ্যাখ্যা দিয়ে জব্বার বলেন, তাদের জালিয়াতির কারণে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কওমী নেতাদের প্রকৃত দাবি-দাওয়া যায়নি।
তবে গওহরডাঙা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রূহুল আমীন বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সরকারের লোক- এই অভিযোগ ঠিক না।”
কওমী মাদ্রাসা সরকারের অধীনে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, “কোনো কিছুর জন্ম না হলে কী করে তাকে অলঙ্কৃত করবেন?”
কমিশন যে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে, তা নিয়ে বেফাক নেতাদের কোনো অভিযোগ রয়েছে কি না- সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি। তবে সেই প্রতিবেদন নিয়ে কিছু বলেননি বেফাক নেতারা।
কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের বার বার বলে এলেও এনিয়ে সরকারের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আর কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
কমিশনের প্রতিবেদন পাল্টে ফেলা নিয়ে জব্বারের দাবির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “কওমী নেতারা তাকে এসব বিষয় কখনও বলেননি। এতদিন পর বেফাক নেতারা এ বিষয়গুলো কেন তুলছেন?”
এদিকে কওমী মাদ্রাসার বেশিরভাগ নেতাই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি বলে মনে করছেন ফরীদ উদ্দীন মাসউদ।
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে কওমী নেতারা মাদ্রাসাগুলোকে সরকারের অধীনে দিতে চান না বলেও মন্তব্য করেন শোলাকিয়ার এই ইমাম।
তিনি বলেন, “কমিশনের বৈঠকে আমি অংশ নিয়েছি। আমার মনে হয়েছে হাতেগোনা কয়েকজন বাদে কওমী বোর্ডগুলোর নেতারাই চান না কওমী মাদ্রাসাগুলো শৃঙ্খলের মধ্যে আসুক।”
গোপালগঞ্জ বোর্ডের বাইরে কওমী নেতাদের অন্য চারটি বোর্ডের মাওলানারা চারদলীয় জোটের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
হেফাজত চুপ, চুপ সরকারও
২০১৩ সালের ৯ মার্চ শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে দেশজুড়ে সংগঠিত হয়ে ওই বছরের ৬ এপ্রিল লংমার্চ ও ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আলোচনায় আসে হেফাজতে ইসলাম।
অনেক আগেই সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
মতিঝিলে হেফাজতের অবরোধের পর ওই বছরের শেষ দিকে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সনদের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু এনিয়ে হেফাজতে ইসলাম দেশে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিলে পিছু হটে সরকার।
হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির যোগসাজশ রয়েছে স্বীকার করেই আব্দুল জব্বার বলেন, “আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণেই তাদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের যোগাযোগ।
“কিছু মিল আছে এটা ঠিক। কারণ রাজনীতি ডানপন্থি-বামপন্থি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। ওলামারা তো বামপন্থি রাজনীতি করতে পারে না, এটা বাস্তবতা।”
আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থিদের কাছে টানতে না পারাকে আওয়ামী লীগের ‘দুর্বলতা’ মন্তব্য করে জব্বার বলেন, “আওয়ামী লীগ আছে বামদের নিয়ে। তাদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্বও বাম ধারার।”
মতিঝিলে হেফাহতে ইসলামের কর্মসূচিতে যোগ দিলেও মঞ্চে উঠেননি জানিয়ে জব্বার বলেন, “ওটা স্বতন্ত্র আন্দোলন, তবে গোষ্ঠী আমরা একই। কওমী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে সরকার উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাতে চায়।”
শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, “কওমী মাদ্রাসাকে মূল ধারায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। আমরা তাদের সহযোগিতা দিতে চাই এবং সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখব।” সূত্র. বিডি নিউজ২৪.কম।