যখন রিপোর্টার ছিলাম…
সিদ্ধান্তটি আচমকা নয়। কিছুদিন থেকেই মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সংবাদপত্রের ওপর নতুন করে কড়াকড়ি আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার। ২৮শে আগস্ট ঠিকই সংসদে প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স নামে একটি বিল পাস হলো। যে বিল বলে সংবাদ মাধ্যমের ওপর আরেক দফা খড়গ নেমে এলো। তৎকালীন স্পিকার আবদুল মালেক উকিল বললেন, রাষ্ট্রবিরোধী কোনো প্রকাশনা সহ্য করা হবে না। যুক্তি দেখালেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বিধিনিষেধ আছে। আমাদের দেশেও থাকতে হবে। বিরোধী মত সংসদে প্রবল নয়। একমাত্র জাসদের আবদুল্লাহ সরকার সমালোচনা করলেন। তার মতে আইয়ুব আমলের কালাকানুনের চেয়েও এই বিল জঘন্য। সরকারের একতরফা প্রশংসা ছাড়া সংবাদপত্র আর কিছুই লিখতে পারবে না। সরকারের তরফে কোরবান আলী বলেন, সংবাদপত্রকে অবাধ স্বাধীনতা দেয়া যেতে পারে না। স্পিকার আবদুল মালেক উকিল হলিডের কড়া সমালোচনা করেন। এর সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খানকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। সংসদের কার্যবিবরণীতে এসবই স্থান পেয়েছে। সংসদ কাভার করতে নয়, এর লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম অন্য একটি কাজে। সংসদের পাস ছিল। সুযোগ পেয়ে ঢুকলাম। ঢুকেই দেখি উত্তেজনা চারদিকে। সাংবাদিকদের মধ্যেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স বিল সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হরণ করবে সবাই বলতে লাগলেন। সমালোচনার একপর্যায়ে মালেক উকিল বলেছিলেন, এই বিল সংসদে আনার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন একদিন পর এর প্রতিবাদ জানায়। এতে বলা হয়, মালেক উকিলের বক্তব্য সঠিক নয়। কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। হলিডে সম্পাদকের বিরুদ্ধে গালমন্দ ও কুৎসা সম্পর্কে বিএফইউজে নিন্দা জানায়। বলে একজন সম্পাদককে নিয়ে এভাবে গালমন্দ করা কিংবা তার জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা সত্যিই দুঃখজনক। এনায়েত উল্লাহ খানও সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে কিছু অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যও টেনে আনেন। যাতে করে শাসক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। পরিণতিতে হলিডে বন্ধ করে দেয়া হয়। সম্পাদককে নেয়া হয় কারাগারে। হলিডে সম্পাদকের লেখা ছিল সরাসরি আক্রমণাত্মক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ’৭৫ সালে চারটি পত্রিকা রেখে সরকার সব ক’টা পত্রিকা বন্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নেয় সে সম্পর্কিত কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন এনায়েত উল্লাহ খান। সে সময় যে বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা হতো তা হচ্ছে স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অতীতের ভূমিকা। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান আমলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য আপসহীন ভূমিকা পালন করেছে। সাংবাদিকদের রুটি রুজির সংগ্রামে শুধু একাত্মতা ঘোষণা করেনি, আন্দোলনেও শরিক হয়েছে। এ কারণেই সাংবাদিকদের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল আর যাই করুক সাংবাদিকদের স্বাধীনতার ওপর কোনো খবরদারি করবে না। শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকরা হতাশ হন। যুগে যুগে দেশে দেশে এমনটাই হয়েছে। বিরোধী দলে থাকলে রাজনীতিকরা সাংবাদিকদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেন। সোচ্চার থাকেন। কিন্তু যেই তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যান, তখন সাংবাদিকরা হয়ে যান শত্রু। এটাই বোধ করি নিয়তি। তারা ক্ষমতায় থাকাকালে এমন সব আইন করেন যার জন্য পরবর্তীকালে তাদেরকেই মূল্য দিতে হয়। ধরা যাক, ’৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন। এই আইন আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি প্রয়োগ হয়েছে। ’৭৫ সালের পট-পরিবর্তনের পর শাসকেরা আওয়ামী লীগ নেতাদের হয়রানি করেছেন। এই আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে ইচ্ছেমতো। জামিন নিয়ে জেল গেটে গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা এক নয়, অসংখ্য। বর্তমান আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আছেন যারা এর শিকার হয়েছিলেন। অনেকের হয়তো স্মরণে আছে, ১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারির ঘটনা। তোপখানা রোডে প্রেস ক্লাবের বিপরীতে ছিল মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের অফিস। ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর বোমা বর্ষণের প্রতিবাদে মিছিল করে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। মিছিলটি প্রেস ক্লাবের সামনে পৌঁছালে মারমুখী হয়ে ওঠে। ইউএসআইএস ভবনে একপর্যায়ে তারা মার্কিন পতাকার পরিবর্তে ভিয়েতনামের পতাকা তোলার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছোড়ে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মতিউল ও কাদেরের মৃত্যু হয়। গোটা শহর অচল হয়ে পড়ে। ডাকসুর ভিপি ছিলেন তখন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। স্বাধীনতার পর তিনিই প্রথম ডাকসুর সহ-সভাপতি। পুলিশি অ্যাকশনের প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে তিনি ঘোষণা দেন, বঙ্গবন্ধুকে দেয়া ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ বাতিল করা হলো। উত্তেজিত হয়ে তিনি সদস্য পদের কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দেন। আরও ঘোষণা দেন, এখন থেকে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বলা হবে না। দৈনিক বাংলা বিকেলে টেলিগ্রাম বের করে। এসব খবরাখবর টেলিগ্রামেও স্থান পায়। পত্রিকাটি বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিব হিসেবে উল্লেখ করে। এতে শাসক মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। রাতেই পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান ও সম্পাদক তোয়াব খানকে ওএসডি করা হয়। এটা ছিল এক অভিনব সিদ্ধান্ত। এর আগে কোনো সাংবাদিককে ওএসডি করা হয়নি। সাংবাদিক ইউনিয়ন সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এই যখন অবস্থা তখন সরকার হাসান হাফিজুর রহমানকে মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস এন্ড কালচারাল অ্যাটাসে নিয়োগ দেয়। পরে তোয়াব খানকে বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি করা হয়। পরিস্থিতি তখন নাটকীয়ভাবে অন্যদিকে মোড় নেয়। সাংবাদিকদের আন্দোলন থেমে যায়। জানিয়ে রাখা ভালো, দৈনিক বাংলা ছিল সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পত্রিকাটির নাম ছিল দৈনিক পাকিস্তান। পরে হলো দৈনিক বাংলাদেশ। এই নামে আরেকটি পত্রিকা থাকায় নাম পরিবর্তন করে দৈনিক বাংলা করা হয়। পত্রিকাটি সরকার পরিচালিত হলেও স্বাধীনতার পর পর প্রচার সংখ্যায় ছিল শীর্ষে। চলবে।
সূত্র. মানবজমিন।