আকাবির-আসলাফ- ২৪
জন্ম
বাংলার কৃতি সন্তান সিলেটের গৌরব ইত্তেবায়ের সুন্নতের মূর্তপ্রতিক আসলাফ ও দেওবন্দের উত্তরাধিকারী, সকল প্রকার কু-সংস্কারের মুখোশ উম্মোচনকারী, অপশক্তির বিরুদ্ধে আপোষহীন ব্যক্তিত্ব দারুল উলূম দারুল হাদীস কানাইঘাটের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হযরত আল্লামা ফয়েজ আহমদ সাহেব কানাইঘাটী রাহ. বাংলাদেশেল আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট জেলাধীন কানাইঘাট উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ গ্রামের এক দ্বীনদার মুসলিম পরিবারে ১৩৬৭ বাংলার ১লা কার্তিক মোতাবেক ১৩৮০ হিজরি রোজ মঙ্গলবার সুবহে সাদিকের সময় এই পৃথিবীতে গুভাগমন করেন।
তাঁর পিতার নাম মাওলানা গোলাম রাব্বানী ও মাতার নাম মোছা. নুরুন নেছা। বিংশ শতাব্দীর এ ক্রান্তিলগ্নে উম্মতে মুহাম্মদী সা.’র এদুর্যোগপূর্ণ মূহূর্তে জালালাবাদে যে ক’জন ক্ষণজন্মা মহামানবের আবির্ভাব হয়েছিল, তন্মধ্যে আল্লামা ফয়েজ আহমদ কানাইঘাটী রাহ. ছিলেন অন্যতম একজন। মানবীয় সব গুণ ও বৈশিষ্টের অধিকারী হওয়ার পরও প্রকৃত মানুষত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। আসলে ডিগ্রী-খ্যাতি অর্জন করা, বক্তা হওয়া, নেতা হওয়া সহজ কিন্তু মানুষ হওয়া কঠিন। বর্তমান যুগেও যখন নাকি মানুষের সংখ্যাধিক্যের কারণে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে পৃথিবী, তখন সবচেয়ে অভাব যে জিনিসটির সেটি হলো সত্যিকারের মানুষ ও মানবতা। এরকম একজন সত্যিকার মানুষত্ব ও মানবতার অভিব্যক্তি ছিলেন আল্লামা ফয়েজ আহমদ কানাইঘাটী রাহ.। সততা, সত্যনিষ্ঠা, ন্যায়-নীতি, ত্যাগ, সেবা, সংযম, উদারতা, সৎসাহস প্রভৃতি মহৎ মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটেছিল আল্লামা ফয়েজ আহমদ কানাইঘাটীর জীবনচিত্রে।
প্রাথমিক শিক্ষা
প্রাথমিক শিক্ষা স্বীয় পিতা মাতার তত্বাবধানে লাভ করেন। এরপর নিজগ্রাম লক্ষীপ্রসাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে কানাইঘাট লালারচক মাদরাসায় ভর্তি হন এবং অত্যন্ত সুনামের সাথে ছাফেলা ৩য় বর্ষ পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ কানাইঘাট দারুল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হয়ে সুখ্যাতির সাথে মাদরাসার সর্বোচ্চ ক্লাসের সমাপনী পরীক্ষায় ১ম বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীস পাশ করেন। আল্লামা ফয়েজ আহমদ কানাইঘািটীর হাদীসের উস্তাদ হচ্ছেন আল্লামা শহরুল্লাহ (চটিহুজুর) রাহ., মাওলানা ফয়জুল বারী শায়খে মহেষপুরী রাহ., মাও. আব্দুল হাফিজ কুওরের মাটি রাহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস লক্ষীপুরী দা.বা., হযরত মাওলানা আব্দুল লতীফ চাউরী রাহ., হযরত মাওলানা আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী দা.বা. প্রমুখ।
মাওলানার কৃতিত
মরহুম মাওলানা ফয়েজ আহমদ রাহ. রমযান মাসে এলাকার একটি মসজিদে ১০দিন এতেকাফে ছিলেন। তাঁর সাথীগণ বলেন যে, তিনি এই অল্প সময়ের মধ্যে ১৫(পনের) পারা কুরআন শরীফ হিফয করেন। মাওলানার নেছাবে যতবড় কঠিন কিতাবই দেওয়া হত না কেন, তিনি তা অত্যন্ত সহজ সরল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠদান করতেন। আরবী, উর্দূ, বাংলা, ফার্সি ভাষার পাশাপাশি, ইংরেজি ভাষায়ও তাঁর দক্ষতা ছিল ইর্ষান্বিত। মরহুমের জীবদ্ধশাতেই মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা শফিকুল হক আকুনী রাহ. এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তাঁর বয়ান শুনার পর আমার অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয়। বিশিষ্ট সাহিত্যিক, মাসিক মদীনা সম্পাদক বলেন, মরহুম মাওলানার মত ৫/৭ জন আলেম বাংলাদেশের সাহিত্যিক হয়ে গেলে বাতিলের মোকাবেলা করা আরও সহজতর হত। তাঁর স্মরণ শক্তি এতই প্রখর ছিল যে, মিজানুস সরফ, নাহবে মীর, হেদায়তুন নাহু, মিজান মান্তিক, কাফিয়া, দুরুছুল বালাগাত, মাকামাতে হরিরি, মুখতাছারুল মায়ানী প্রভৃতি কিতাবাদি তাঁর অবিকল মুখস্থ ছিল। সরফ, নাহু এবং ফিকাহ্ ইত্যাদির কোন মাস্আলাহ নিয়ে তাঁর নিকটে গেলে অতীব বিনয়ের সাথে হাস্যোজ্জ্বল মুখে সরল সহজ ভাষায় সংক্ষিপ্তভাবে বলে দিতেন, যাতে তালাবা এবং সাথীদের কোন বেগ পেতে না হয়।
রাজনৈতিক জীবন
আল্লামা ফয়েজ আহমদ কানাইঘাটী রাহ. ছাত্র জীবন থেকেই জমিয়তের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। জমিয়তের সকল প্রোগ্রাম এবং কর্মসূচীতে প্রায়ই অংশ নিতেন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে জমিয়ত প্রার্থী বর্তমান কানাইঘাট দারুল উলূম মাদরাসার শায়খুল হাদীস ও শিক্ষা সচিব আল্লামা আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী দা.বা.’র পক্ষে ব্যাপক নির্বাচনী কর্মতৎপরতায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি মৃত্যু অব্দি সিলেট জেলা জমিয়তের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রচনা ও প্রকাশনা
হযরত তাঁর জীবনে অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ, নিবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ বাংলাদেশের সুপরিচিত ম্যাগাজিন মাসিক মদিনা, মাসিক মুঈনুল ইসলাম, মাসিক তৌহিদী পরিক্রমা, মাসিক আত-তাওহীদ, সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান, মাসিক পাথেয় ইত্যাদিতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়েছে। তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রবন্ধ “ইসলামী রাষ্ট্র আদিষ্ট না প্রতিশ্রুত” যা মাসিক মঈনুল ইসলামে তৎকালীন সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর লিখিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছ-
১. ইসলামী শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষা ২. উর্দ্দু চৌথীর বাংলা অনুবাদ
৩. খতবে নবুয়ত ও ক্বাদীয়ানি ধর্ম মতবাদ
৪. নারী স্বাধীনতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
৫. কুরআনে কারীমের মর্যাদা ও শ্রেষ্টত্ব ইত্যাদি।
ইন্তেকাল
১৯৯৯ ঈসায়ীর ২৩শে জুলাই শুক্রবার ১১-১০ মিনিটের সময় কানাইঘাট মাদরাসার ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থাগার মুহাম্মদী কুতুবখানায় হাজার হাজার কিতাবাদীর চর্তুবেষ্টনীর মধ্যখানে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন তিনি। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েসহ শত-সহস্র বন্ধু বান্ধব, ছাত্র, ভক্ত ও আত্মীয় স্বজনকে শোক সাগরে ভাসিয়ে মহান মাওলানার সানিধ্যে ইহকাল ত্যাগ করেন। ইন্নলিল্লাহি —- রাজিউন।
মরহুমের জানাযার ইমামতি করেন দারুল উলুম দারুল হাদীস মাদরাসার বর্তমান শায়খুল হাদীস ও শিক্ষা সচিব আল্লামা আলিমুদ্দীন শায়খে দুর্লভপুরী। পঞ্চায়েতি কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আমরা তাঁর রূহের মাগফিরাত ও দরজা বুলন্ধি কামনা করি।
সংগ্রহ ও সংযোজন : ইলিয়াস মশহুদ