ডা. মরিস বুকাইলিকে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। খৃষ্টান থেকে মুসলিম হওয়া ফ্রান্সের এই সার্জন কুরআন বিষয়ে তাঁর অনবদ্য গবেষণার মাধ্যমেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। ‘বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ তাঁর অমর রচনা। ‘মানবজাতির উৎপত্তি’ শিরোনামে পরে তিনি আরো একটি অসাধারণ বই উপহার দিয়েছেন বিশ্ববাসীকে। কুরআন নিয়ে তাঁর গবেষণার সূচনা, প্রেক্ষাপট, মানবজন্ম নিয়ে ডারউইনের অসার তত্ত্বের বিস্তার, ইসলাম গ্রহণ এবং তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ অরিজিন অব ম্যান নিয়ে এই সাক্ষাৎকারে তিনি খোলামেলা আলোচনা করেছেন। দাওয়াহ বিষয়ক দারুণ কিছু উপদেশও তিনি এখানে তুলে ধরেছেন। সরাসরি ইংলিশ থেকে মূল্যবান এই সাক্ষাৎকারটি আপনাদের কড়কমলে পেশ করছি- শাকিল আদনান
প্রশ্ন : কোন বিষয়টি কুরআন এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ নিয়ে গবেষণার জন্য আপনাকে প্ররোচিত করেছিলো এবং কেনো?
ডা. মরিস বুকাইলি: অন্যান্য ফ্রেঞ্চ নাগরিকের মতো শুরুতে আমারও এমন ধারণাই ছিলো যে, ইসলাম ধর্মটি খুবই মেধাবী এবং ধীশক্তির অধিকারী একজন মানুষ কর্তৃক উদ্ভাবিত এবং প্রচারিত- যিনি মুহাম্মাদ নামে পরিচিত। আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে- প্রভুর অপার অনুগ্রহে আমি একজন সার্জন হিসেবে প্র্যাকটিসের যোগ্য হয়ে ওঠতে পারলাম। আমার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা প্রতিবেশী এবং আমার সহকর্মীদের সাথে প্রায়শই আমি ইসলাম এবং খৃস্টান ধর্মের তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনায় মশগুল হতাম। তাদের কেউ কেউ আমাকে বলতেন ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান যথেষ্টই অল্প এবং ভুল জায়গা থেকে আহরিত। নিজেকে সঠিক ভেবে শুরুতে অবশ্য তাদেরকেই আমি সন্দেহ করায় বেশি উৎসাহ বোধ করতাম কিন্তু পরে তাদের কেউ কেউ আমাকে যখন কুরআনের খাঁটি ভার্সন এনে দিলেন আমার রেফারেন্সসমূহের বিপরীতে, আমি বাধ্য হলাম আমার সিদ্ধান্তগুলো পুনরায় যাচাই করতে। এই পুনর্পাঠ এবং যাচাই প্রক্রিয়ায় নিজেকেই আমি ভুল মতের অধিকারী হিসেবে আবিষ্কার করলাম। আমি আরও আবিষ্কার করলাম- যারা আমার শিক্ষক ছিলেন, সমস্যাগুলো নিয়ে তাদের নিজেদের ধারণাই ভ্রান্ত ছিলো এবং সেই ভুল তথ্যগুলোই তারা আমার কাছে সরবরাহ করেছেন। তখনো পর্যন্ত ইসলাম সম্পর্কে আমার জানাশোনা কেবল রেডিও-টিভির প্রোগাম, স্থানীয় ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আর্টিকেল ও সংবাদগুলো পর্যন্তই সীমিত ছিলো। বাস্তবতা বুঝতে পেরে সে মুহূর্তে আমি হতবুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম- আমার এখন কী করা উচিত? কীভাবে আমি আমার ভুল অবস্থান বদলাতে পারি এবং আমার উপলব্ধিটা সংশোধন করতে পারি?
প্রশ্ন: তারপর কী হলো?…
বুকাইলি: তখনকার সময়টা ছিলো অষ্টম ভ্যাটিকেন কনফারেন্সের পরবর্তী এবং নিরপেক্ষ চিন্তা প্রকাশে ইউিরোপীয় স্কলারদের সহনশীন মানসিকতা গড়ে ওঠারও পূর্বের- অর্থাৎ ১৯২৬ সালের আগে, মুসলিম এবং খৃস্টান স্কলারদের মধ্যকার বিতর্ক তখন চূড়ান্ত একটা পর্যায়ে অবস্থান করছে আবার কোনো প্রকাশ্য আলোচনার সুযোগও সে মুহূর্তে ছিলো না…
প্রশ্ন: আপনি কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করলেন?
বুকাইলি: তখন কেবলমাত্র একটা পথই আমার সামনে খোলা ছিলো। আরবী ভাষা শেখা এবং নিজে নিজেই পবিত্র গ্রন্থ কুরআন পাঠ করা এবং মূলভাষার নির্যাসসহ কুরআনের অর্থ বুঝতে চেষ্টা করা। পরের দু’টি বছর এই কাজেই নিজেকে আমি নিয়োজিত রাখলাম এবং আরবী ভাষা এবং সাহিত্য সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হলাম। এই প্রচেষ্টা আমাকে যোগ্য করে তুললো একাডেমিক পাঠের পাশাপাশি বিশ্বস্তভাবে কুরআনের গবেষণামূলক পাঠেও। প্রশ্ন: এই প্রচেষ্টা আর কীভাবে আপনাকে উপকৃত করলো? বুকাইলি: আমি তখনই নিশ্চিত হতে পারলাম- কুরআন একমাত্র আল্লাহরই বাণী এবং এটার একটা ছত্রও মানুষ কারো দ্বারা রচিত নয়। আমি এটাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম- মুহাম্মাদ সা. ছিলেন আল্লাহর প্রকৃত রাসূল।
প্রশ্ন: বিশ্ব এ মুহূর্তে ডারউইন মতবাদের শতবর্ষ উদযাপন করছে- আপনি কি এই ডারউইনবাদের সাথে সহমত পোষণ করেন, না দ্বিমত রাখেন?
বুকাইলি: না স্যার, আমি তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করি। ডারউইনের মতবাদটা সম্পূর্ণ ভুল একটা চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেছে এবং এটা তেমন কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার আলোকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তই নয় যেমন দাবি করা হয় যে, মানবজাতি এবং ডারউইন কর্তৃক উদ্ভাবিত বিবর্তনবাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। সারকথা হলো- তার চিন্তাগুলো ভুলভাবে আহরিত এবং ভুলপথে চালিত অনেকটা পিওর বস্তুবাদী মানসিকতার উপসংহার ছাড়া আর কিছু নয়। আমার সর্বশেষ বই- ‘অরিজিন অব ম্যান’- মানবজাতির উৎপত্তি- তে ডারউইনের মতবাদকে খ-ন করে বিস্তৃত ব্যাখ্যাসহ বিশেষ একটা আর্টিকেল সংযুক্ত করে দিয়েছি।
প্রশ্ন: আপনি কি তাহলে বলতে চান যে ডারউইন তার ভুল সম্পর্কে জানতেন?
বুকাইলি: হ্যাঁ। আমি মনে করি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভুল তিনি করেছেন। বিষেশজ্ঞগণ, যারা বস্তুবাদকে ভালোবাসেন- তারা এমন অসংখ্য থিওরি এ নিয়ে আবিষ্কার করেছেন যেগুলো পুরোই বেঠিক। মজার বিষয় হলো- তারা নিজেদের প্রতারণাগুলো সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। যাই হোক, খাঁটি বস্তুবাদী হয়েও তারা তাদের ভুল অবস্থানেই নিজেদের অবিচল রেখেছেন। আমার বইয়ে এমন বেশ ক’জন স্কলারের সমালোচনা করেছি আমি, যাদের মধ্যে ক’জন নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্বও রয়েছেন।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন আপনার রচনাবালি ফ্রান্সের বাইরেও যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে?
বুকাইলি: হ্যাঁ। সম্প্রতি, এই ক’দিন আগে আমি দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো ঘুরে এলাম। সেখানে আমি শিক্ষিত শ্রেণীর অসংখ্য অনুষ্ঠান ও আলোচনায় আহূত হলাম যেগুলোতে অনেক স্কলারও উপস্থিত থাকতেন, তারা কথা বলেছেন আমার ‘মানবজাতির উৎপত্তি’ এবং প্রথম গ্রন্থ- ‘কুরআন, বাইবেল এবং বিজ্ঞান’ নিয়ে। এসব আলোচনায় নিজস্ব মতামত বিষয়ে আমাকে খুব কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যথেষ্ট যোগ্য আলোচক এমনকি বিপরীত মতবাদের কতিপয় উদ্ধত লোকজনের প্রশ্নবানেরও মুখোমুখি হয়ে। এসব আলোচনায় আমার বক্তব্য এবং মতামত জেনে অসংখ্য ছাত্র এবং স্কলার আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। তারা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন- আমার আলোচনা শুনে এই প্রথম তারা পৃথিবী এবং মানবজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে কুরআনের প্রকৃত বক্তব্য জানতে পেরেছেন। কেউ কেউ তো এমনও জানিয়েছেন- আমার লেখা পড়ে এবং লেকচার শুনে নিজেদের ভেতর তারা এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আবিষ্কার করেছেন, তাদের বিশ্বাস নতুনভাবে পুনর্গঠিত হয়েছে এবং এগুলো তাদের সত্যিকার মুসলিমে পরিণত করেছে। তারা নামাজ এবং মোনাজাতে এখন ভিন্নরকম আনন্দ এবং প্রশান্তি পাচ্ছেন। তারা আরো জানিয়েছেন- তথাকথিত কিছু পশ্চিমা গবেষকের মিথ্যা এবং ফালতু থিওরি পড়ে তারা বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছিলেন এবং প্রকৃত সত্যের পথ হারাতে বসেছিলেন।
প্রশ্ন: মানবজাতির উৎপত্তির বিষয়ে বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত কি? এবং কেনো বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে এ সম্পর্কে আমরা এমন বিতর্ক দেখতে পাই?
বুকাইলি: আমার বই- ‘অরিজিন অব ম্যান’ এ আমি বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলির এই বিষয়ক সংশয় এবং প্রমাণাদি সম্পর্কে বিস্তৃত বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছি। আমি পূর্বেকার স্কলারদের সমর্থিত বিভিন্ন থিওরি নিয়েও কথা বলেছি। তবে এখন তাদের মতবাদের মৌলিক ভিত্তিটা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, সেগুলো আসলে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক সূত্রনির্ভর ছিলো না। ১৮৫১ সালে ‘অরিজিন অব স্প্যাসিস’ বা প্রজাতিসমূহের বিবর্তন শিরোনামে ডারউইন তার প্রথম বই প্রকাশ করেন। এতে তিনি নিজের তথাকথিত বিবর্তনবাদের ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসেন। তিনি জানান- ‘প্রত্যেক প্রাণীর নিজের মধ্যে পুনর্সৃষ্টি হওয়া সম্ভব’। তবে তিনি এই বইয়ে আর কষ্ট স্বীকার করে ব্যাখ্যা করতে বা বৈজ্ঞানিক সূত্র ব্যবহার করে প্রমাণ করতে যাননি- কীভাবে মানবজাতির বংশানুক্রম বানর পর্যন্ত গিয়ে মেলে।
প্রশ্ন: তাহলে কারা এই অসার থিওরির প্রসারের জন্য দায়ী?
বুকাইলি: মতলববাজ কিছু মানুষ এজন্য দায়ী। তারা ভুলভাবে এই থিওরির ব্যাখ্যা করেছে এবং নিজেদের মনগড়া মিথ্যে বক্তব্য দিয়ে সেগুলো ডারউইনের নামে চালিয়ে দিয়েছে। তারাই এটা প্রচার করে যে, ‘মানবজাতি মূলত বানর থেকে উদ্ভব হয়েছে’। অরিজিন অব স্প্যাসিস বইটি প্রকাশের পর আসলে ডারউইনের অনুসারী এবং খৃস্টান চার্চের যাজকদের মধ্যে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। কাঁদা ছোড়াছুড়ির এই সুযোগেই তৃতীয় পক্ষের মতলববাজেরা এই মতবাদ ছড়িয়ে দেয় এবং নাম জুড়ে দেয় ডারউইনের। বিজ্ঞান বা ডারউইনের মতো গবেষকদের এর সাথে মূলত কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রশ্ন: বিজ্ঞান সমর্থিত এসব উপদেশ, বিতর্ক, আলোচনা এমনকি কিছু ধর্মগ্রন্থও- যা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সহায়তায় তাদের ভুলগুলো তুলে ধরছে এবং দুর্বলতার পয়েন্টগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে, আমরা কি জানতে পারি- আপনার মতে পবিত্র কুরআনেও এমন বক্তব্য আছে কিনা যা বৈজ্ঞানিক সূত্র বা ব্যাখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তাদেরকে ভুল প্রমাণিত করে?
বুকাইলি: অমুসলিমদের ধর্মগ্রন্থগুলো যুগে যুগে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী দ্বারা নকল এবং পরিবর্তিত হয়েছে। এই ধারার সবচে’ পুরনো ডকুমেন্ট হলো ‘যেহোভা’, এটি লেখা হয়েছিলো নবম খৃষ্ট শতাব্দীর কোনো এক সময়ে। আকারে বৃহৎ না হলেও এই বইটি এই প্রকৃতির উল্লেখযোগ্য একটি ডকুমেন্ট। দ্বিতীয় বই (সেক্রোডোটাল) যদিও এটি বাইবেলের মুখবন্ধ বা ভূমিকা হিসেবে গণ্য হয়- এটি আলোকপ্রাপ্ত হয় খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে। এটিতে বর্ণিত হয়েছে পৃথিবী সৃষ্টি, পৃথিবীতে মানবজাতির উৎপত্তি এবং এর পরবর্তী ঘটনাসমূহ। বাইবেল আসে এরও পরে, তবে নতুন টেস্টমেন্টের অন্তর্ভুক্ত বইগুলো মানবজাতির এই সমস্যা নিয়ে তেমন কিছু বলেনি। এগুলো সেন্ট লুকের সংস্কারকৃত ওল্ড টেস্টমেন্টরই পুনরাবৃত্তি করে গেছে কেবল। কুরআন পৃথিবীতে এসেছে জিসাস তথা ঈসার আ. ছয় শত বছর পর এবং মানবসৃষ্টির রহস্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে যা ওল্ড টেস্টমেন্ট, নিউ টেস্টমেন্ট কিংবা অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থে কখনো ছিলো না, আজো নেই। এই বিষয়ে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো- কুরআন এক্ষেত্রে সবরকমের ভুল বা ঝোঁক ও আবেগী মন্তব্য থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, বাইবেলের নতুন-পুরনো টেস্টমেন্টের ক্ষেত্রে যা ভাবাই যায় না।
প্রশ্ন: আপনার মতে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোর এ বিষয়ে এতো অধিক পরিমাণ এবং জটিল ভুলের পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে?
বুকাইলি: পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোর সংকলকগণ, তাদের নিজস্ব দেমাগ বা অহংবোধ থেকে উৎসারিত অনুমানগুলো স্বর্গীয় বাণী হিসেবে এগুলোতে সংকলন করেছেন। তবে তাদের সব উদ্যোগই ছিলো নিজ নিজ যুগের পুনরাবৃত্তিমাত্র। সমসাময়িক বাস্তবতাকেই নিজস্ব কারিশমা অনুযায়ী তারা সংকলনের প্রয়াস পেয়েছেন। মানবজাতি এবং তাদের সৃষ্টিরহস্যের তাৎপর্যগুলোকে তারা নিজ নিজ সময়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল আচার ও অনুমান দ্বারা ব্যাখ্যা করে প্রচার করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তার ঘোষণা হিসেবে। বাইবেলের সব ব্যাখ্যাকার বা সংকলকদের দ্বারা নি:সন্দেহে এই ব্যাপারটাই ঘটেছে- হোন তারা ক্যাথলিক কিংবা প্রটেস্ট্যান্ট।
প্রশ্ন: গির্জা বা চার্চও কি এই সত্য স্বীকার করে এবং বক্তব্য সমর্থন করে?
বুকাইলি: হ্যাঁ, স্যার। দ্বিতীয় ভ্যাটিকেন কনফারেন্সে এই সত্যকে চার্চগুলোও স্বীকার করে নিয়েছে, তবে এটাকে তারা ‘ওল্ড এবং নিউ টেস্টমেন্টসমূহের বৈপ্লবিক ধারা বা প্রকৃতি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তারা স্বীকার করে নিয়েছে- এই বাইবেলগুলোর বেশ কিছু অংশ সরাসরি ত্রুটিপূর্ণ এবং পরস্পরবিরোধী।
প্রশ্ন: এই প্রেক্ষাপটে কুরআন বিষয়ে আপনার মতামত কি?
বুকাইলি: এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণই ব্যতিক্রম। কুরআন সংশ্লিষ্ট সব স্কলার এ ব্যাপারে নি:সন্দেহ যে, কুরআন আল্লাহর বাণী- জিব্রীল আমীনের মাধ্যমে যেভাবে নবীজীর সা. ওপর এটা অবতীর্ণ হয়েছে হুবহু সেভাবেই অবিকৃত রয়েছে। আমি খুবই যতœ এবং সতর্কতার সাথে পুরো কুরআন পাঠ করেছি এবং গোটা কুরআনের একটা শব্দ বা বাক্যেও বিজ্ঞান সম্পর্কিত কোনো সূত্র বা ব্যাখ্যার ব্যতিক্রম কিছু পাই নি। এসময় উল্টো বরং আমি উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছি যে, কুরআনের শব্দ-বাক্যগুলোর প্রকৃত সত্য এবং বাস্তবতা বিগত ১৪০০ বছর ধরে শুধু অবিকৃতই থাকেনি বরং সত্য ও সঠিক হিসেবে প্রমাণিত হয়ে চলেছে। হাজারো পরীক্ষা কিংবা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও একবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এটাই প্রমাণ করে কুরআন শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তারই বাণী। একজন মানুষ যতোই জ্ঞানী হোক, যতো উঁচু শ্রেণীর মুণি-ঋষী-দার্শনিক বা মেধাবী হোক, প্রকৃতি এবং বিশ্ব নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী সত্য উচ্চারণ করা বা সেটাতে নির্ভুল থাকা সম্ভব নয়। কুরআন খুব সহজে এটা করেছে এবং বিগত ১৪০০ বছরেও কেউ তাতে কোনো ত্রুটি আবিষ্কার করতে পারে নি। মানবজীবনের ব্যাখ্যায় বাইবেলের ধারণা যা বিজ্ঞানের সাথে সরাসরি সংঘাত সৃষ্টি করে যে, বিভিন্ন জাতির কেবল আকার-প্রকারেই জীবন সদা উৎক্ষিপ্ত ও সহনশীল এবং এর ফাংশনে কোনো বিবর্তন বা উন্নতি নেই। অন্যদিকে কুরআনের বিবৃতি অনুযায়ী- মানবেতিহাসের বিভিন্ন পরম্পরায় এই মনবজাতি ব্যাপকরকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে। আমি মনে করলাম বিশ্বের সকল খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদেরকে বাইবেলের এই ভুল তথ্য বা গরমিল সম্পর্কে জানানোটা খুব দরকারি। যেহেতু আমার গবেষণায় এই ব্যাপারটা খুবই নিরপেক্ষ, বাস্তব এবং সরাসরি ধরা পড়েছে, তাই আমি বারবার করে প্রায়শই আমার মতামতটা তাদের জানাতে চাইলাম- ব্যাপকভাবে তা জনসমক্ষে প্রচারের আগেই। এক্ষেত্রে সব ব্যাপারেই পাদ্রী বা ধর্মতত্ত্বকে পাশ কাটিয়ে অমি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছি। যখনই কোনো বিষয় এসেছে সংশয়মূলক হিসেবে বা আরো ব্যাপক তত্ত্ব-তালাশের দাবি নিয়ে, আমি চেষ্টা করেছি সমালোচনা এবং চ্যালেঞ্জের কষ্টিপাথরে সেগুলো যাচাই করেই সামনে এগুতে।
প্রশ্ন: আপনি কি ইসলাম গ্রহণ করেছেন?
বুকাইলি: শুরুতেই অমি এ বিষয়টি একদম পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, বিসমিল্লাহ শব্দটা জানার আগেই আমি এ ব্যাপারে সন্দেহমুক্ত ছিলাম- প্রভু একজনই এবং তিনিই সকল ক্ষমতার আধার। প্রভু আমাকে যখন কুরআন নিয়ে গবেষণার সুযোগ করে দিলেন, আমার আত্মা এই সত্য আবিষ্কারে কেঁদে ওঠলো যে কুরআন ছিলো প্রভুরই বাণী যা তার সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদের সা. ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। আমার বই- ‘কুরআন, বাইবল এবং বিজ্ঞান’ এ আমি এগুলো উল্লেখ করেছি এবং বইটি তাৎক্ষণিক সাফল্যসহ গোটা খৃস্টান বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা ধারণার দিককে পাশ কাটিয়ে এই বইয়ে নিজেকে আমি নিয়োজিত করেছি সম্পূর্ণ একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যমান সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে, যাতে কেবল একটা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা না আসে বা ব্যক্তিগত মতামত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা বড় হয়ে দেখা না দেয়। এটা এজন্য যে বিশ্ব যেনো আমাকে একজন ধর্মতাত্ত্বিক মনে করার পরিবর্তে শুধুই একজন একাডেমিশিয়ান ও গবেষক মনে করে এবং সহজেই বইটি গ্রহণ করতে পারে। আমার বিশ্বাস এবং আস্থা, এটাতো প্রভুই ভালো জানেন কার মনে কী আছে। আমি শুরুতেই উপলব্দি করে নিয়েছিলাম- যদি আমি আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বইটি উপস্থাপন করি- তাহলে মানুষ আমাকে বিশেষ একটি শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে ধরে নেবে এবং আমি যা-ই বলি বা করি, সেটাকে তারা বিশেষ সে পক্ষের চিন্তা-ভাবনা বা কাজ হিসেবে গণ্য করবে এবং প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে। আমি আমার উদ্দিষ্ট শ্রেণীটিকে খুব ভালো করে জানি এবং বুঝতে পারি তাদের মানসিকতা। তাই তাদেরকে আমি নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছি যে, আমার সব উচ্চারণ এবং বক্তব্যগুলো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আলোকেই, কোনো বিশেষ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।
প্রশ্ন: দারুণ বলেছেন। তবে যেহেতু আপনি বললেন যে প্রভু খুব ভালো করেই জানেন কার হৃদয়ে কী আছে, তো আমরা কি জানতে পারি মানবহৃদয় সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
বুকাইলি: মানবহৃদয় দৃশ্যমান বা প্রত্যক্ষ কোনো অঙ্গ নয়। এটা হলো মানুষের বিশ্বাসের বসতি এবং এক অনন্ত আলোর উৎস।
প্রশ্ন: পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের মিশন এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
বুকাইলি: মানুষের কাছে আসা বা নৈকট অর্জনের সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো যোগাযোগে তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করা। এই বিস্তৃত ভাবনা থেকেই আমি বৈশ্বিক ভাষা ব্যবহার করি- যাতে সব দেশের সব ভাষার মানুষই খুব সহজে এবং পরিপূর্ণভাবে ভাব বুঝে ওঠতে পারে। আপনি যে ভাবনা বা জীবনধারার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন, সেটা এমন পন্থায় পরিবেশন করতে হবে যাতে আপনি নিজে স্বচ্ছন্দ এবং একই সাথে সেটা উদ্দিষ্ট শ্রেণীর কাছেও পছন্দনীয়। আমার বই- কুরআন, বাইবেল এবং বিজ্ঞানে আমি পাঠকদের কুরআনের সত্য পৌঁছে দিতে নতুন এক পন্থা প্রয়োগ করেছি, এটি তাদের কাছে সহজবোধ্য হবার পাশাপাশি কুরআনের প্রকৃত মূল্য তুলে ধরতেও সামর্থ্য রাখে। আমার এই সামগ্রিক এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বইটির ব্যাপক প্রসারে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। প্রথমত- খৃস্টসমাজের কেন্দ্রীয় বা মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আগ্রহের জায়গাটা খুঁজে বের করেছি আর নিশ্চিত করেছি কোন ধারাটা তাদের সহজাত প্রবৃত্তি আকৃষ্ট করতে অধিক ফলপ্রসূ। এ কারণেই এমন সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এই বইগুলো প্রকাশের পর আমি প্রচুর চিঠি পেয়েছি প্রখ্যাত সব শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাধারণ অনেক নাগরিকদের কাছ থেকেও; এগুলোতে তারা আমার কুরআন গবেষণার পদ্ধতি নিয়ে নিজেদের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন, অকপট সমর্থনও জানিয়েছেন। বাইবেল বিষয়ক আমার মতামতগুলো নিয়েও তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং যে সংশয় ও গরমিলগুলো আমি দেখিয়েছি সেসবের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। একবার আমার বাসায় কিছু খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের আমি আপ্যায়ন করলাম। ঘরোয়া এই জমায়েতে তারা ইসলাম বিষয়ক আমার রচনাগুলো নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলেন এবং বাইবেলের গরমিল ও সমালোচনামূলক বিশেষ পয়েন্টগুলোও জেনে নিলেন, পরে সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য।
প্রশ্ন: আজকাল আপনি নতুন কী করছেন?
বুকাইলি: মালয়েশিয়া সরকারের সাথে গভীর বন্ধুত্বের সূত্রে আমরা এখন যৌথ উদ্যোগে চেষ্টা করছি ‘বিজ্ঞান, কুরআন এবং মানবজাতির উৎপত্তি’ শীর্ষক একটা মুভি বানাতে। ‘দাওয়া ইসলামিয়া’ এর প্রাদেশিক শাখা কুরআন নিয়ে একটি মুভি বানাবার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে এবং প্ল্যানটা চূড়ান্ত করতে প্রযোজক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকও সম্প্রতি প্যারিস ঘুরে গেছেন। এটি একটি রঙিন মুভি হবে। মুভিটির ৫৫ মিনিট শুধু কুরআন এবং কুরআনের বিষয়-সংশ্লিষ্ট ইতিহাসের জন্য বরাদ্দ থাকবে। কুরআনের আয়াতগুলোও এই মুভিতে শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হবে। মুভিটি যেহেতু ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে, এটি নির্মাণের জন্য ৬ লাখ ডলার বাজেট সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রস্তুতিও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। শুরুতেই এটিকে মোট পাঁচটি ভাষায় মুক্তি দেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে ভাষার সংখ্যা দশে উন্নীত হবে। প্রথম প্রিন্টটি হবে ইংলিশে, তারপর আরবী, ফ্রেঞ্চ; তারও পর অন্যান্য ভাষায়। আশা করছি- ইসলামের প্রচার এবং কুরআনের সত্যতা তুলে ধরতে বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বে এটি দারুণ ভূমিকা রাখবে।
সাক্ষাৎকার অনুবাদ ও রচনা: শাকিল আদনান, sakiladnan3@gmail.com