বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১০:০০
Home / আকাবির-আসলাফ / মুজাহিদে যামান আল্লামা আমিন উদ্দীন শায়খে কাতিয়া রাহ.’র জীবন ও কর্ম

মুজাহিদে যামান আল্লামা আমিন উদ্দীন শায়খে কাতিয়া রাহ.’র জীবন ও কর্ম

অধ্যক্ষ আব্দুল হাই জেহাদী 

আকাবির-আসলাফ- ২৩

২০১০ সালের ঈদ-উল-ফিতরের আনন্দঘন মুহূর্তের পূর্বক্ষণেই লাখো ভক্ত মুরিদান ও ছাত্র তথা সিলেটের আলেমকুলকে শোকসাগরে ভাসিয়ে মহান মাওলার দরবারে হাজিরা দেয়ার আনন্দ নিয়ে পরপারে চলে গেলেন বাংলাদেশ– বিশেষত বৃহত্তর সিলেটের আলেমকুল শিরোমণি আশেকে রাসূল, ইলমে হাদীসের এক নিরলস খাদেম, খাদেমুল ক্বওম ও খাদেমে মিল্লাত, মুজাহিদে আযম নগরীর খেলাফত বিল্ডিং দারুল হাদীস আল মাদানীয়াসহ বৃহত্তর সিলেট ও নেত্রকোনার অর্ধশত মাদরাসা-মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক/মুহতামিম আধ্যাত্মিক জগতের এক বিরল ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা আমিনুদ্দীন শায়খে কাতিয়া। সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় প্রতিটি গ্রামে-পাড়ায়-মহল্লায় যার রয়েছে ভক্ত মুরিদান ও শুভাকাঙ্ক্ষি। যার দোয়া নেয়ার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শতশত মানুষ ভিড় জমাতেন যেখানেই তিনি যেতেন। তিনিও বৃহত্তর সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়াতেন ইলমে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে তথা তাবলীগে দ্বীনের কাজে, ওয়াজ-নসীহত প্রদানে। সকালে বাড়ি থেকে রওয়ানা দিয়ে পায়ে হেঁটে সন্ধ্যাবেলা ওয়াজ-মাহফিলে গিয়ে পৌঁছার শতশত নজির একমাত্র কাতিয়ার সাহেবের জীবনেই ঘটেছে। এই দীর্ঘ ৮-৯ ঘণ্টার চলার পথে রাস্তায় যাকেই পেতেন তাকেই নামাযের দাওয়াত দিতেন, দাড়ি রাখার কথা বলতেন, আল্লাহর হুকুম আর রাসূলের ত্বরীকা মেনে চলার জন্য বিনয়ের সাথে আহবান জানাতেন। আর ধনী ও প্রশাসনের লোকদের ধমকের সুরে আল্লাহর কথা ও মরণের কথা স্মরণ করে চলার প্রতি তাগিদ দিতেন। এমনকি তার সাথে কেউ সাক্ষাতে আসলেও তিনি আগে প্রশ্ন করতেন চলমান ওয়াক্তের নামাজ আদায় করেছেন কি না। না করলে আগে নামাজ আদায় করে আসতে বলতেন, এরপর কথা বলতেন। সাবেক স্পীকার মরহুম হুমাযূন রশিদ চৌধুরীও তার সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে এমনই অবস্থার সম্মুখীন হন। পরে তিনি নামাজ আদায় করে এসে দেখা করেন এরপর যাওয়ার বেলা তাকে মিসওয়াক জায়নামায আর খদ্দর কাপড় উপহার দেন। মরহুম হুমায়ূন রশিদ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই খদ্দরের পাঞ্জাবি মাঝেমধ্যে পরতেন। হযরত শায়খে কাতিয়ার এ রকম অনেক সংক্ষিপ্ত সফরের সাথী হওয়ার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল। শায়খে কাতিয়া রাহ. এবং শায়খে কৌড়িয়া রাহ. পরস্পর একান্ত কাছের মানুষ হওয়ায় এবং আমি কৌড়িয়া মাদরাসায় লেখাপড়া করায় পরবর্তীতে অধ্যক্ষ মাওলানা আকরাম আলী রাহ. আমার শ্বশুর হওয়ায় তাদের দু’জনের মধ্যেও গভীর সম্পর্ক থাকায় আমিও বেশ কিছুদিন তার সান্নিধ্য ও দোয়া নেয়ার তথা খেদমত করার সুযোগ পাই। একবার তার প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী কাতিয়া মাদরাসার জলসায়ও আমাকে সংক্ষিপ্ত বয়ান রাখার সুযোগ দিয়ে ছোটদের প্রতি তার স্নেহ মমতা আর মনের উদারতার নজির স্থাপন করেন। এই ক্ষণজন্মা আল্লাহর ওলী মাওলানা আমিনুদ্দীন শায়খে কাতিয়ার পদচারণা পড়েনি এমন এলাকা বিশেষত ক্বওমী মাদরাসার সংখ্যা খুব কমই আছে। তার জীবনের শত বৈশিষ্ট্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি আগেভাগে যে কাউকে সালাম করতেন, মেহমানদারী আর মানবকল্যাণে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। মেহমান সাথে নিয়ে খেতে না বসলে তার খাবারই যেন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। মেহমানের খবর শুনলে তিনি খুব খুশি হতেন এবং সম্ভব হলে এগিয়ে নিয়ে আসতেন এবং অনেক পথ এগিয়ে গিয়ে বিদায় দিতেন। কম কথা বলতেন, তবে যা বলতেন গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাষায় স্পষ্ট বলতেন, আবার কখনো ধমকের সুরে বলতেন। আরেক কথায় মহান আল্লাহ পাকের রেজামন্দি হাসিলের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে ইলমুল ওহী অর্জন ও ইলমে তাসাউফের অমিয় সুধায় জীবনকে সুষমামন্ডিত করে যারা যামানার বুযুর্গ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন তন্মধ্যে মাওলানা আমীনুদ্দীন শায়খে কাতিয়া অন্যতম। নিজ এলাকা বিশেষত নিজ গ্রামের প্রায় ষোলআনা নারী পুরুষ কাতিয়ার শেখ সাহেবের মুরিদ ভক্ত অথবা শুভাকাঙ্ক্ষি। এমন নজির এ যামানার আর কোন পীর বুযুর্গ বা জ্ঞানী-গুণির আছে কি না আমার জানা নেই। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় সদাসয় হাস্যোজ্জ্বল আল্লাহর জিকিরে মশগুল এই আল্লাহর ওলী শায়খে কাতিয়া এলাকার মানুষকে কত ভালোবাসতেন আর মানবতার প্রতি তার কত দরদ ছিল এবং তিনি তার ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে দ্বীনের স্বার্থকে কতটা প্রধান্য দিতেন।
মাওলানা আমীনুদ্দীন শায়খে কাতিয়া ১৯১৮ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী কাতিয়া গ্রামে এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম শেখ মোহাম্মাদ কনাই মিয়া এলাকার অন্যতম তালুকদার ছিলেন। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ শেখ উপাধী অধিকারী হিসেবে এলাকায় সম্মানিত ছিলেন। শায়খে কাতিয়া নিজ গ্রামের প্রাইমারি স্কুল এবং পাঠলী প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়ার পর নবীগঞ্জ থানার দিঘলবাগ গ্রামে নিউস্কিম মাদরাসায় ৩ বছর লেখাপড়ার পর গোলাপগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বাঘা মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে ২ বছর লেখাপড়া করেন। এ সময় উপমহাদেশের খ্যাতনামা বুযুর্গ কুতুবে আলম আল্লামা হোছাইন আহমদ মাদানী রাহ. সিলেট আসলে তিনি মাদানী রাহ.’র সাথে ভারতের দেওবন্দ মাদরাসায় চলে যান। সেখানে কুতুবে আলমের একান্ত শাগরেদ হিসেবে তাঁর সান্নিধ্যে থেকে ৭ বছর লেখাপড়া করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করে দেশে চলে আসেন।
তিনি দেশে প্রত্যাবর্তনের পর দেওবন্দ মাদরাসারই আদলে নিজ গ্রামে একটি ক্বওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্রতী হন। অবশেষে কাতিয়া গ্রামের ধর্মানুরাগী মুরবিবয়ানদের সক্রিয় সহযোগিতায় ১৯৫১ সালে কাতিয়া গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে এতিহ্যবাহী ইসলামী বিদ্যাপীঠ ‘‘জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম কাতিয়া’’ মাদরাসার গোড়াপত্তন করেন।
তিনি কুতুবে আলম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.’র অনুরক্ত এবং একান্ত শাগরেদ ছিলেন। জালালী তবিয়তও জেহাদী জযবায় উজ্জীবিত এই মর্দে মুজাহিদ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকেই ভয় করতেন না। এটা ছিল তান জীবনের আরেক বৈশিষ্ট্য। বৃহত্তর সিলেটে কোন এক সময়ে তথাকথিত সুন্নী ও ওয়াহাবী নামে ফেরকাবাজিতে সিলেট সরগরম হয়ে উঠেছিল। তখনকার তার ঘোর বিরোধীরাও তার সামনে এলে বিরোধিতা করার সাহস পেত না। তারাও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাকে যথাযথভাবে সম্মান প্রদর্শন করতো। হযরত শায়েখ কাতিয়া এ ব্যাপারে নিজ মুরিদানকে বলতেন যে, যারা আমার বিরোধিতা করে অথবা আমাকে গালি দেয় তাদেরকে কটু কথা বলিও না। সম্ভব হলে তাকে আমায় গালি দেয়ার পরিবর্তে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিও। তখনকার সময়ে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীর শিকার হয়ে শয্যাশায়ী অবস্থায় ফুলতলীর পীর সাহেব সিলেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হযরত শায়েখ কাতিয়া, কমলা, আপেল, আঙ্গুর নিয়ে ফুলতলী সাহেবকে হাসপাতালে দেখতে যান। তিনি ঘোরতর বিরোধীদেরকে সাথে নিয়ে খাবার খেতেও দ্বিধাবোধ করেন না। তিনি মেহমান ছাড়া খাবার খেতেন না। নিয়মিত তাহাজ্জুদ গোজার আল্লাহর এই ওলি জামাত ছাড়া নামাজ পড়তেন না। কখনো জামাত শেষ হয়ে যেতে দেখলে খুবই দুঃখ পেতেন আর শেষ হয়ে গেলে সাথীদের নিয়ে জামাতের সাথেই নামাজ আদায় করতেন। তিনি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উক্ত মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। উক্ত মাদরাসার ব্যয়ভার সংকুলান করতে অশীতিপর বৃদ্ধি শায়খে কাতিয়া বছরের পর বছর ধরে ১২টি মাসই বিভিন্ন স্থানে সফর করতেন। দেশ ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ মধ্যপাচ্যের সব কয়টি দেশেই তার অগণিত ভক্ত মুরিদান রয়েছেন। ঐ সকল মুরিদানের দওয়াতে তিনি প্রায় ৫০ বার বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। এছাড়াও মহান আল্লাহ তা’আলার একান্ত সান্নিধ্য লাভের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে প্রায় ৪০ বার হজ্বব্রত পালনের সৌভাগ্যে লাভ করেছেন।
শায়খে কাতিয়া সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার প্রায় অর্ধশতাধিক মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মাদারিছে ক্বওমীয়ার শিক্ষাবোর্ড ‘আজাদ দ্বীনি এদারায়ে তা’লিম বাংলাদেশ’ এবং সুনামগঞ্জ এদারার অন্যতম উপদেষ্টা পদে আসীন ছিলেন। বৃহত্তর সিলেটের অধিকাংশ মাদরাসা অথবা উপরোক্ত শিক্ষাবোর্ডগুলো কোন সমস্যা বা সংকটে নিপতিত হলে নিরুপায় হয়ে তার শরণাপন্ন হলে তিনি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার মাধ্যমে-এর সমাধান দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। তদনীন্তন পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান কর্তৃক মুসলিম পারিবারিক আইন পাসের বিরুদ্ধে সিলেটের সর্বস্তরের উলামা-মাশায়েখগণ প্রতিবাদমুখর হয়ে ঐতিহাসিক রেজিস্টারী ময়দানে এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক রেজিস্টারী ময়দানে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং রেজিস্টারী ময়দানের প্রধান গেইট তালাবদ্ধ করে রাখে।
এদিকে প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিতে সিলেট শহর লোকে লোকারণ্য, কিন্তু কেউ রেজিস্টারী ময়দানে ঢোকার সাহস পাচ্ছেন না এমতবস্থায় মর্দে মুজাহিদ শায়খে কাতিয়া তখনকার সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুযুর্গ রানাপিং মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা রিয়াছত আলী শায়খে ছখরিয়া রাহ.কে সাথে নিয়ে নিজহাতে গেইটের তালা ভেঙ্গে ফেলেন এবং যথাস্থানেই প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। রেজিস্টারী মাঠে উক্ত প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে তিনি জিন্দাবাজারস্থ হোটেল রমনায় অভ্যর্থনা কক্ষে টাঙ্গিয়ে রাখা আইয়ুব খানের ফটো ঈমানী জযবায় সাহসীকতার সাথে নিজ হাতে ভেঙ্গে জ্বালিয়ে দেন।
১৯৮০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সিলেট আগমন উপলক্ষে সিলেট বিমানবন্দর থেকে সার্কিট হাউস পর্যন্ত পুলিশী ব্যারিকেড রাখা হয়। তৎমুহূর্তে শায়খে কাতিয়া চন্দনটুলা থেকে দরগাহ মাদরাসায় যেতে চাইলে পুলিশ হযরতের রাস্তা আগলে দাঁড়ায়। ব্যাপার জানতে চাইলে জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টর জানায় এই মুহূর্তেই প্রেসিডেন্ট আসছেন তাই আপনাকে রাস্তা দেয়া সম্ভব নয়। যখন হযরত শায়খে কাতিয়া খুব উত্তেজিত কণ্ঠে হাতের আশা (গলা) উঁচিয়ে বলেন, তোমার প্রেসিডেন্টকে গিয়ে বল যে, ইসলামের প্রেসিডেন্ট এ মুহূর্তে আল্লাহর ঘরে যাবেন। যাও, আর আমার রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াও। সিংহবিক্রম সুলভ ধমক খেয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর ভয় পেয়ে যায় এবং তৎক্ষণাৎ তার রাস্তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের আমলে সুনামগঞ্জ এক্সিভিশন ভাঙ্গার জন্য হযরত শায়খের আহবানে হাজার হাজার মানুষের পদভারে যখন সুনামগঞ্জ শহর প্রকম্পিত, মিছিলে মিছিলে মুখরিত ঠিক তখনি ব্যাপারটি সুরাহার উদ্দেশ্যে সিলেটের একমাত্র মন্ত্রী সুনামগঞ্জের সন্তান এরশাদ সরকারের খাদ্য উপমন্ত্রী মেজর ইকবালের বাসায় যান। বাসা থেকে জানিয়ে দেয়া হয় মন্ত্রী এখন ঘুমিয়ে আছেন। বেলা তখন দুপুর ১২টা। শায়খ ধমক দিয়ে বলেন, ইকবাল সাহেবকে জাগাও, গিয়ে বলো আমার হাজার হাজার জনতা আজ সুনামগঞ্জে মৃত্যুবরণ করবে। আর তিনি দায়িত্বশীল মন্ত্রী হয়ে দিনে দুপুরে ঘুমিয়ে থাকবেন এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। হুজুরের গর্জনী শুনে মন্ত্রী মেজর ইকবাল ঘুম থেকে উঠে এসে সাথে সাথে তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। তৎক্ষণাতই নিজ গাড়িতে করে শায়খে কাতিয়াকে নিয়ে এসে সমাবেশে উপস্থিত হন এবং এক্সিভিশন বন্ধের ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয় সিলেটের যেকোন স্থানে ইসলাম ও সমাজবিরোধী কাজের আয়োজকসহ বাতিল সমাজের কাছে শায়খে কাতিয়া ছিলেন এক আতঙ্ক। অনেক প্রশাসক এমনকি মন্ত্রীও শায়খে কাতিয়ার সামনে দাঁড়ালে থর থর করে কাঁপতেন এবং তার দোয়া নিয়ে অন্যায় কাজ প্রতিরোধে তারা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে নিতেন।
রাজনৈতীক জীবনে হযরত শায়খে কাতিয়া জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের অন্যতম কেন্দ্রীয় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ৬ থানা নিয়ে গঠিত আপার কাউন্সিলের প্রার্থী ছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের টিকিটে দুইবারই এ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বিজয়ী প্রার্থীর নিকটতম প্রতিদ্বনদ্বী ছিলেন।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজ এলাকা তথা ৯নং পাইলগাঁও ইউনিয়নকে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে হেফাজত করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। নিজ ইউনিয়নের হিন্দু বসতীপূর্ণ গ্রামগুলোকেও রক্ষা করেন। পাকিস্তানী হানাদার সম্পর্কে শায়খে কাতিয়ার মন্তব্য ছিলো যে, এদের নির্বিচারে গণহত্যা, অন্যায় নির্যাতন ও বর্বরতা প্রমাণ করে এদেশে তারা বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না।
হযরত শায়খে কাতিয়া কুতুবে আলম মাদানী রাহ.’র খলিফা ছিলেন, যদিও তিনি সরাসরি এ খেলাফত লাভ করতে পারেনি। বর্তমানে হযরত শায়খে কাতিয়ার ইজাযত প্রাপ্ত খলীফা রয়েছেন অনেকেই। এর মধ্যে অনেকেই দেশের খ্যাতনামা আলেম ও বুযুর্গ তথা শায়খুল হাদীস ও মুহাদ্দিস পর্যায়ের।
পারিবারিক জীবনে তিনি ৫ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের জনক। তারা হলেন-খোদেজা, সুফিয়া, হাফছা, মাওলানা ইমদাদউল্লাহ-নায়েবে মুহতামীম কাতিয়া মাদরাসা, ক্বারী ওবায়দুল্লাহ-প্রসিদ্ধ ক্বারী, ইসমাইল, ইউছুফ, জুলেখা, মাওলানা ইছহাক প্রমুখ।
মাওলানা আমিনুদ্দীন শায়খে কাতিয়া বেশ কিছুদিন যাবত অসুস্থ ছিলেন। নগরীর রায়নগরের তার এক মেয়ের বাসায় প্রায় অবস্থান করতেন। মাঝেমধ্যে হাসপাতাল ক্লিনিকে ভর্তি করা হতো। জানাযায় গত ৩০ রমজান তিমি মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় বাড়ি যাওয়ার জন্য দুপুরের আগেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এই বলে যে, আমার এলাকার মানুষের সাথে মুলাকাত করব তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিব। দুপুর একটার দিকে শারীরিক অবস্থার লক্ষণ ভালো নয় দেখে পরিবারের লোকজন তাকে বাড়ী না যাওয়ার পরামর্শ দেন আর এরই মাঝে ২/১৫ মিনিটের সময়ই তিনি মাওলার যিকির করতে করতে পরপারে চলে যান। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। নগরীর ঐতিহ্যবাহী শাহী ইদগাহ ময়দানে লাখো লাখো মুসল্লির উপস্থিতিতে ঈদুল ফিতরের জামাতের পরই তার নামাজে জানাজা আদায় করা হয়। এর আগে রাতভর সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার ভক্ত মুরিদান ও আলেম-ওলামা গাড়ি ভরে ভরে এসে তাদের প্রিয় আধ্যাত্মিক নেতাকে দেখে যান নয় সড়ক মাদরাসায়।

লেখক- ইসলামী চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...