হাকীম সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::
ছবিটিতে বঙ্গবন্ধুর দু’পাশে বসে আছেন দুজন বর্ষীয়ান আলেম। তথাকথিত নব্য দেশপ্রমিকদের জন্যে এটা অবশ্য অস্বস্তিকর এক ছবি। এই দু’জন দেওবন্দ পাশ মাওলানা আবার বঙ্গবন্ধুর গুরু। দু’জন সরাসরি তার রাজনৈতিক শিক্ষক। তাদের হাত ধরেই তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান একদিন বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। দু’জনই কওমী মাদরাসার ছাত্র। এই দু’জন মাওলানা আবার আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি। একজন প্রতিষ্ঠাতা, অন্যজন একটানা দশ বছরের সভাপতি। তাদের সহচার্যেই রাজনীতির নেতা হয়ে উঠেছেন তিনি। দু’জন আলেমই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোধা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর জেনারেল রুদ্ধের ভাষায়, এই একজন মওলানা বাংলাদেশের প্রোফেট অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট।
দু’জনই ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার। একজন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রথম সভাপতি। অন্যজন পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রথম বাংলায় বক্তৃতাকারী। প্রথম একুশের হত্যাকান্ডের প্রকাশ্যে প্রতিবাদকারী।
দু’জনই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীর যুদ্ধা। দু’জনই আবার শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দির স্নেহাস্পদ শিষ্য ও ছাত্র।
তারপরেও কি বলবেন আলেমরা স্বাধীনতা বিরোধী ছিল? সেই দিন আর নেই, যা মন চায় তাই বলবেন? এখন ছবি কথা বলবে। ইতিহাস আবার জেগে উঠবে এই মোল্লা-মৌলভীদের হাতে। এখন চেপে রাখা ইতিহাসকে আলেম মুক্তিযুদ্ধা প্রজন্ম বের করে ছড়িয়ে দিবে বিশ্বময়। কিতাবের পাতায় বিবি তালাকের ফতোয়া খোঁজায় ব্যস্ত মৌলভীরা এখন ইতিহাসের পাতাও খোঁজে। আপনাদের কথার পাল্টা আমরাও কথা বলা চিনি। গালাগালি আর কটাক্ষ করার দিন ফুরিয়ে গেছে। কবি হেলাল হাফিজের ভাষায়, “আমিও গ্রামের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি।”
যোগ্য আর্দশ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরিতে কওমী মাদরাসা ব্যর্থ বলতে লজ্জা লাগে না আপনাদের? শরম করে না মাওলানারা দেশপ্রেমিক নন- এই কথাটি বলতে। যে মৌলভীরা আপনাদের রাজনীতি শিক্ষা দিল, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামীলীগকে জন্ম দিল, দীর্ঘদিন লালন ও পরিচর্যা করল, কোন বেহায়া মুখে বলেন মৌলভীদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কোন অবদান নেই? এটা নিসংকোচভাবে বলা চলে, যারা একাত্তরে আলেমদের অবদানকে অস্বীকার করে, তারা পিতৃ-পরিচয়হীন। গাম্য একটি প্রবাদ আছে “কার হুগদা খাও গো বান্দি, ঠাকুর চিন না।” যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি…
ইতিহাস সচেতন ক’জনে চিনেন বঙ্গবন্ধুকে পাশে বসিয়ে রাখা এই দু’জন মহান ব্যক্তিকে? এদেশের মানুষকে রাজনীতি, দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার দীক্ষায় দীক্ষিতকারী এই দুই মাওলানা কে, বলুনতো দেখি কি নাম দু’জনের? তারা আর কেউ নন, তারা হলেন- মাওলানা ভাসানী ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ রাহ.।
সামান্য পেছনের ইতিহাসটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ১৯৩৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় বঞ্চিত রায়ত-খাতকের র্দুদশা ও ঋনভার লাঘবের জন্য ‘নিখিল বঙ্গ রায়ত খাতক সমিতি’ গঠন করেন। সভাপতি ও সেক্রেটারী ছিলেন যথাক্রমে শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা তর্কবাগীশ। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত চাঁচকৈড় (নাটোর) সম্মিলনে মাওলানা তর্কবাগীশ ঋণ সালিশি বোর্ড স্থাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। (ফেব্রুয়ারি-১৯৩৩খৃ.) এই দাবী ধীরে ধীরে আন্দোলনে পরিণত হয় এবং ১৯৩৮ সালে ঋণ সালিশি বোর্ড স্থাপিত হয়। অথচ আজকে আমরা তাঁদের নামই ভুলে গেছি।