শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৪:৫৪
Home / অনুসন্ধান / ইরানের নির্বাচন কতটা পরিবর্তন আনবে?

ইরানের নির্বাচন কতটা পরিবর্তন আনবে?

98456_192মাসুমুর রহমান খলিলী ::

২৬ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শিয়াপ্রধান ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। এ সময় ইরানি সংসদ মজলিসের ২৯০টি এবং শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ পরিষদের ৮৮ সদস্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে সব ধরনের জনমত জরিপ ও পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সমর্থক সংস্কারবাদী ও উদারপন্থীরা সংসদের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করবে। কিন্তু বাস্তব ফলাফলে দেখা যায়, রক্ষণশীল মূলনীতিবাদীদের তুলনায় সংস্কারপন্থীরা ভালো করেছে ঠিক কিন্তু যতটা বলা হয়েছিল ততটা নয়। সংস্কারপন্থীরা ২৮.৬ শতাংশ ভোট পেয়ে মজলিসে ৮৩টি আসন লাভ করেছে। রক্ষণশীল মূলনীতিবাদীরা পেয়েছেন ২২.১ শতাংশ ভোট ও ৬৪টি আসন। আর উদারপন্থীরা পেয়েছেন, ৩.৪৪ শতাংশ ভোট ও ১০টি আসন। স্বতন্ত্র সদস্যরা ১৯ শতাংশের কাছাকাছি ভোট এবং ৫৫টি আসন লাভ করেছে।

পশ্চিমা মিডিয়া ইরানের এই ফলাফল প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির অবস্থানকে শক্তিশালী করবে বলে উল্লেখ করছে। এই মূল্যায়ন পূর্ববর্তী পার্লামেন্ট ও বিশেষজ্ঞ পরিষদে সংস্কারপন্থীদের অবস্থানের সাথে তুলনা করা হলে বেশ খানিকটা সঠিক মনে হবে। কারণ আহমাদিনেজাদের শেষ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী হোসেন মুসাভির আন্দোলনের কারণে এর আগের সংসদ নির্বাচনে অনেক সংস্কারপন্থী অংশ নিতে পারেননি। সে সময় সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ, আর আসন ছিল ৫২টি। এর বিপরীতে মূলনীতিবাদীরা ৫৬.৮ শতাংশ ভোট এবং ১৬৫টি আসন লাভ করে। এবার সংস্কারবাদী ও উদারপন্থীদের আসন ৩১টি বেড়েছে যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ছিল আরো ৯৪টি। কিন্তু আগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাসান রুহানির ৫২ শতাংশ ভোট লাভের সাথে তুলনা করা হলে এবার সংস্কারপন্থীরা তেমন ভালো করতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞ পরিষদের ফলাফল সে তুলনায় অনেক ভালো। এখানকার ৮৮টি আসনের মধ্যে আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানির পিপলস এক্সপার্ট তালিকা থেকে ২৯ জন জয়ী হয়েছেন। রক্ষণশীল আলি মোভাহিদী কিরমানির তালিকা থেকে জয়ী হয়েছেন ২৩ জন। প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির ফ্রেন্ডস অব মডারেশন তালিকা থেকে জয়ী হয়েছেন ২২ জন। মোহাম্মদ ইয়াজদির সোসাইটি অব সেমিনারি টিচার তালিকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ১০ জন আর আলি আকবর মুহতাসিমপুরের অ্যাসোসিয়েশন অব কমব্যটান্ট ক্লারিকস তালিকা থেকে জয়ী হয়েছেন মাত্র চারজন। আয়াতুল্লাহ রাফসানজানি এবং রুহানির তালিকার কেউই আগে বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য ছিলেন না। এই বিশেষজ্ঞ পরিষদ আগামীতে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নির্বাচন করার কথা। বর্তমান নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছেন। ফলে পরিষদের এই মেয়াদেই নতুন নেতা নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ হিসেবে আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি হতে পারেন দেশটির পরবর্তী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা।
বিদায়ী বিশেষজ্ঞ পরিষদ ছিল একচেটিয়াভাবে রক্ষণশীল মূলনীতিবাদীদের প্রভাবিত। তারা এবার ৫১টি আসন হারিয়েছেন। যদিও নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী নিজে অভিযোগ করেছিলেন রক্ষণশীল অভিভাবক পরিষদ অনেক সংস্কারপন্থী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করেছেন যাদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ পরিষদ সদস্য প্রার্থী আয়াতুল্লাহ খোমেনির নাতি হাসান খোমেনিও রয়েছেন। অবশ্য ৪০ বছর বয়সী হাসান খোমেনি বিশেষজ্ঞ পরিষদ সদস্য হওয়ার মতো পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতার অধিকারী নয় বলে উল্লেখ করেছে বিশেষজ্ঞ পরিষদ।
ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অদ্ভুত যার সাথে অন্য কোনো দেশের তুলনা করা যায় না। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ‘রাহবার’ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপরিচালনার সাথে যুক্ত সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত। জনগণ প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত করেন মজলিসের ৫টি সংরক্ষিত আসন ছাড়া বাকি ২৯০ জনকে। চার বছর মেয়াদের জন্য তারা নির্বাচিত হন। আর আট বছর মেয়াদি বিশেষজ্ঞ পরিষদের ৮৮ জন সদস্য নির্বাচিত হন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে। এই বিশেষজ্ঞ পরিষদ নির্বাচিত করে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাকে। তাকে পদচ্যুত করার মতো পরিস্থিতি দেখা দিলে সে ক্ষমতাও এই বিশেষজ্ঞ পরিষদের হাতে রয়েছে।
অন্য দিকে আরেক ক্ষমতাধর গার্ডিয়ান কাউন্সিল বা অভিভাবক পরিষদের অর্ধেক সদস্য নির্বাচিত করেন সংসদ সদস্যরা। বাকি অর্ধেক শরিয়াহ বিশেষজ্ঞ রাহবার নির্বাচিত করেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের, কিন্তু তাদেরকে সংসদের অনুমোদন পেতে হয়। আর মন্ত্রিসভাসহ রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রধানসহ সব শীর্ষ পদের নিয়োগে চূড়ান্ত অনুমোদন প্রয়োজন হয় রাহবারের। তাদের সবাইকে দায়বদ্ধ থাকতে হয় সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার কাছে।
এর মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো যে, কেউ চাইলে ইরানের সংসদ বা অন্য কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। প্রার্থী হতে হলে তাকে পাঁচটি শর্ত পূর্ণ করতে হবে। অন্যান্য দেশে নির্বাচন কমিশন এই প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকে। ইরানে এ দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে অভিভাবক পরিষদের হাতে। কোনো নাগরিক ইসলামি বিধিবিধান মান্যকারী অথবা ইরানের বর্তমান ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক কাঠামো ও সংবিধানে বিশ্বাসী না হলে তিনি নির্বাচনের যোগ্য বিবেচিত হবেন না। পাশ্চাত্যে বা মুক্ত গণতন্ত্রের সাথে এ ক্ষেত্রে ইরানি ব্যবস্থার একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। ডেমোক্র্যাট পার্টির অন্যতম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সেন্ডার্স নিজেকে সমাজতন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার পরও প্রাইমারিতে অন্যতম প্রধান প্রার্থী হিসেবে আছেন। সমাজতন্ত্রীরা পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে নিয়মিতভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকে। ইরানে এটি সম্ভব নয়। অবশ্য ইরানের এই কঠোর অবস্থার পেছনে বিপ্লবের সময়ে ফেদাইন ই খালক ও তুদেহ পার্টির অন্তর্ঘাতী কার্যক্রম ভূমিকা রেখেছে।
ইরানে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ রয়েছেন তবে সেখানে গতানুগতিক অর্থে রাজনৈতিক দল নেই। নির্বাচনের সময় কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। রক্ষণশীল মূলনীতিবাদী, সংস্কারবাদী ও উদারপন্থীরা আলাদা আলাদা তালিকায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ইরানের রক্ষণশীল ও সংস্কারপন্থীদের পার্থক্যের বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের সাথে তুলনা করা যায়। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দুই দেশের দল বিশেষের ক্ষমতা থাকার পার্থক্য কিছুটা বোঝা যায়। তবে পররাষ্ট্রনীতি যা মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পার্থক্য তেমন থাকে না।
ইরানে হাসান রুহানিকে সংস্কারপন্থী হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু তার সময় দেশটি সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী নীতি নিয়েছে সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনের ব্যাপারে। পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরকে সংস্কারপন্থীদের ক্ষমতায় থাকার ফল হিসেবে তুলে ধরা হয়, কিন্তু যে সংসদ এটিকে অনুমোদন দিয়েছেন তার ৮০ শতাংশ এমপি ছিল রক্ষণশীল মূলনীতিপন্থী।
ইরানের যে আঞ্চলিক ও বিশ্বনীতি রয়েছে তাতে সংস্কারপন্থীরা ক্ষমতাবান হলে পরিবর্তন আসতে পারে বলে যে ধারণা পোষণ করা হয় বাস্তবতার সাথে তা মিলে না। তবে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিতাত্ত্বিক শিয়া সংখ্যালঘুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো নতুন যে নীতি গ্রহণ করেছে তাকে এগিয়ে নিতে ইরানের সংস্কারবাদী নেতারা বেশি উপযোগী। খাতামি রাফজানজানি বা হাসান রুহানির কথাবার্তায় ইরানি প্রভাব বিস্তারের মূল এজেন্ডা সবসময় প্রকাশ্য হয় না। কিন্তু আহমাদিনেজাদের মতো রক্ষণশীল নেতারা নিজেদের অবস্থান ও বিশ্বাসের কথা বলে ফেলেন। এ দিক থেকে পাশ্চাত্যের জন্য তূলনামূলক পছন্দের হলো সংস্কারপন্থীরা। ইরানের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অবকাঠামো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রবেশের সুবিধার জন্যও সংস্কারপন্থী নেতৃত্বের প্রয়োজন মনে করে পাশ্চাত্য। www.dailynayadiganta.com

mrkmmb@gmail.com

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...