সাদিকুর রহমান :: মাসজুড়ে পাঠক-লেখক-প্রকাশকের মিলনস্থলে পরিণত হওয়া বাঙালির প্রাণের অমর একুশে গ্রন্থমেলা শেষ হলো আজ। যেতে দিতে না চাইলেও সময় তার স্বাভাবিক নিয়মেই চলে। যার ফলাফল- সাহিত্য প্রেমীদের আবারও প্রাণের উৎসবে মিলিত হতে এক বছরের অপেক্ষায় রেখে বিদায় নিলো এই মেলা। তবে অন্য যেকোনও বারের তুলনায় বই বিক্রির হিসাবে নতুন রেকর্ড গড়েছে এবারের মেলা। এ বছর মোট বিক্রি হয়েছে ৪১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। গত বছর যা ছিল ২২ কোটি।
শেষদিন মেলায় আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তারিন মেহজাবিন জানালেন সেই বিদায় বেদনার কথা। তিনি বলেন, ‘পুরো একমাস একটা উৎসব বিরাজ করছিল এ এলাকাটাতে। বিকেল হলেই বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসে ভিড় করতো মেলায়। কাল থেকে এই মুখরতা থাকবে না সেটা ভাবতেই খারাপ লাগছে।’
প্রকাশকরা বললেন, এবারের বই মেলায় বরাবরের মতোই চাহিদার শীর্ষে ছিল গল্প, উপন্যাস। তবে গবেষণাধর্মী বই ও প্রবন্ধেরও চাহিদা ছিল।
সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘অন্য যেকোনও বারের তুলনায় এবারের মেলা অনেক সুন্দর ছিল। পাঠকরা তাদের পরিবারসহ আসতে পেরেছেন। বৃহৎ পরিসরে হওয়ায় তারা স্বস্তিতে ঘুরতেও পেরেছেন। তাছাড়া নিরাপত্তা জোরদার থাকার কারণে তাদের ভেতর কোনও সংশয়ও ছিল না। আশা করি আগামীতে এ বছরের ভুল-ত্রুটি শুধরিয়ে আরও জমজমাট মেলা অনুষ্ঠিত হবে।’
প্রকাশে সর্বাধিক বইয়ের তালিকায় কবিতা, সর্বনিম্ন অভিধান
এবারের বইমেলায় মোট নতুন বই এসেছে তিন হাজার ৪৪৪টি। গতবছর
এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭০০টি। এ বছর সর্বধিক ৯৩৯টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে উপন্যাস ৫২৯টি, গল্প ৫০৩টি, প্রবন্ধ ১৯৭টি, শিশুতোষ ১৬২টি, ছড়া ১১২টি, মুক্তিযুদ্ধ ১০১টি, জীবনী ৮১টি, ভ্রমণ ৫৪টি, বিজ্ঞান ৫৩টি, ইতিহাস ৪৮টি, গবেষণা ৪৫টি, সায়েন্স ফিকশন ৪৫টি, ধর্মীয় ৩২টি, চিকিৎসা স্বাস্থ্য ও অনুবাদ ২৫টি, রম্য ১৮টি, রাজনীতি ১৫টি, রচনাবলি, নাটক ১২টি, কম্পিউটার ৯টি, অভিধান ৬টি এবং অন্যান্য বই প্রকাশিত হয়েছে ৪২১টি। এ তালিকায় গতবছর প্রকাশের দিক দিয়ে শীর্ষে ছিল কবিতা ৮৭৭টি।
সর্বাধিক বিক্রিত বই
এ বছর মেলায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই। তার ‘ক্রেনিয়াল’ (তাম্রলিপি ), ‘স তে সেন্টু’ (সময়), ‘দুষ্টু হাতি এবং ইদুর’ (চন্দ্রদ্বীপ) ও ‘তিতুনি এবং তিতুনি’ (কাকলী) প্রত্যেকটিই ভালো বিক্রি হয়েছে। এছাড়া আনিসুল হকের ‘জেনারেল ও নারীরা’ (প্রথমা), দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘মাশরাফি’ (পরিবেশক ঐতিহ্য), ‘মীর মশাররফ হোসেন: অপ্রকাশিত ডায়েরি’, ‘প্লেটো রিপাবলিক’ ও ‘ভাষান্তরসমগ্র’ (পাঠক সমাবেশ), মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকার খাল পোল ও নদীর চিত্রকর’ (জার্নিম্যান বুকস), সাদাত হোসাইনের ‘অন্দরমহলো’ (ভাষাচিত্র), সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’ (সংহতি), রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ও কবীর চন্দ অনূদিত ‘আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ’ (অ্যার্ডন), হরিশংকর জলদাসের ’একলব্য’ (অন্যপ্রকাশ), ইমদাদুল হক মিলনের ’জিন্দাবাহার’ (অনন্যা) বইগুলো ভালো বিক্রি হয়েছে। এছাড়া প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বইও এবার ভালো বিক্রি হয়েছে।
বই বিক্রির নতুন রেকর্ড
অন্য যেকোনও বছরের তুলনায় এ বছরের মেলায় বই বিক্রির নতুন রেকর্ড গড়েছে। সমাপনী অনুষ্ঠানে গ্রন্থমেলা ২০১৬-এর প্রতিবেদনে বিক্রির তথ্য উপস্থাপন করেন জালাল আহমেদ। তিনি বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত বিভিন্ন বিষয়ে এবারে নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৪৪৪টি। গতকাল ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি ১ কোটি ৩৯ লাখ ৬৩ হাজার ৪শত ৫৮ টাকার বই বিক্রি করেছে। ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি বাদে অন্যান্য প্রকাশনার বিক্রি হয়েছে ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বাংলা একাডেমিসহ গ্রন্থমেলায় মোট বিক্রয়ের পরিমাণ ৪১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। গত বছর সর্বমোট বিক্রি হয়েছিল ২২ কোটি টাকা।
মেলায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা
এ বছরের মেলা বেশকিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্ম দিয়েছে। মেলার অষ্টম দিনের মাথায় মেলা পরিচালনা কমিটির নিয়ম ভেঙে স্টল নির্মাণ করায় ২১টি প্রকাশনীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ(শোকজ) দেয় বাংলা একাডেমি। পাশাপাশি আগামী বইমেলায় এসব প্রকাশনীকে ব্লাক লিস্টেড করা হবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে এমন অভিযোগে ১৬তম দিনে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় লেখকসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। জব্দকৃত বইটির নাম ‘ইসলাম বিতর্ক’। মেলার ২২তম দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে শিশু চত্বরের পাশে প্লাটফর্ম প্রকাশনীর (স্টল নাম্বার ৪৯২) স্টলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। সিসি ক্যামেরায় দেখা যায় সন্ধ্যা ৬টা ০৭ মিনিটে দুই তরুণ আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে ওই স্টলটিতে। মেলার ২৪তম দিনে হঠাৎ ঝড়ের পর অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় মেলা সাময়িকভাবে স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। মেলা প্রাঙ্গণ পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় ১ ঘণ্টা পরই আবার মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে মেলায় আবাসন র্শীর্ষক বক্তৃতাও ছিল বিতর্কিত।
একনজরে এবারের মেলা
এ বছর গ্রন্থমেলায় ছয় হাজার বর্গফুটের ১৫টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ ছিল। একাডেমি প্রাঙ্গণে ৮৩টি প্রতিষ্ঠানকে ১১১টি ইউনিট এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৩২০টিসহ মোট ৫৪০টি ইউনিটে মোট ৪০১টি প্রতিষ্ঠানের জন্য স্টল বরাদ্দ ছিল। লিটল ম্যাগ চত্বরে ৯২টি প্রতিষ্ঠানকে তাদের প্রকাশনা প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। মেলা প্রাঙ্গণকে বিশিষ্টজনদের নামে ১৫টি চত্বরে বিভক্ত করা হয়। আইএফআইসি ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় মেলার অবকাঠামো নির্মাণ ও সাজসজ্জার সব কাজের দায়িত্বে ছিল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ইভেন্ট টাচ।
সমাপনী অনুষ্ঠান
সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠান। এতে শুভেচ্ছা ভাষণ প্রদান করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। গ্রন্থমেলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গ্রন্থমেলার সদস্য-সচিব ড. জালাল আহমেদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথির বক্তব্য প্রদান করেন সংস্কৃতি সচিব বেগম আক্তারী মমতাজ। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কার প্রাপ্তদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। উৎস: বাংলা ট্রিবিউন।