অনলাইন ডেস্ক :: স্বাধীন মত প্রকাশকারীদের জন্য ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের এক ধরনের গতিধারা (প্যাটার্ন) দেখা যাচ্ছে দেশটিতে। তীব্র চাপের মুখে রয়েছে নিরপে গণমাধ্যম। হত্যা করা হয়েছে কয়েকজন ধর্মনিরপে ব্লগার ও প্রকাশককে। কর্তৃপরে সমালোচনা করার ওপর আইনগত নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে এনজিওগুলো। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৫/১৬-এ বাংলাদেশ সম্পর্কে এসব বলা হয়েছে। ৪০৯ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গত বছরের রাজনৈতিক সহিংসতা ও দেশের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা। বিশেষ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর হাতে গুম, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি, নারী ও মেয়েদের ওপর সহিংসতা, মৃত্যুদ ও আইসিটির বিচার প্রক্রিয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।
ধর্মনিরপে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করায় ব্লগারদের ওপর হামলা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে এসেছে, উগ্রপন্থীরা ওই হামলা চালিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে চাপাতি হাতে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে অভিজিৎ রায়কে। তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা বেঁচে যান। আগস্টে ওয়াশিকুর রহমান, নিলয় নীল ও অনন্ত বিজয় দাস নামে আরো তিন ব্লগারকে হত্যা করা হয়। অক্টোবরে, ধর্মনিরপে সাহিত্যের এক প্রকাশককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আরেক প্রকাশক ও দুই ধর্মনিরপে লেখক হামলায় বেঁচে যান। ব্লগার ও প্রকাশকদের বিরুদ্ধে লেখালেখির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি কর্তৃপ।
গুম : সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বহু মানুষকে আটক করেছে। কিন্তু পরে তাদের আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালিত একটি জরিপে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশে অন্তত ৪৩ জন ব্যক্তি গুম হয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জন নারীও রয়েছেন। ছয়জনকে পরে মৃত পাওয়া গেছে। চারজনকে আটক করে পরে মুক্তি দেয়া হয়েছে। পাঁচজনকে পুলিশের হেফাজতে পাওয়া গেছে। বাকি ২৮ জনের সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি। ২০১৪ সালের এপ্রিলে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ ও হত্যার দায়ে আটক র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিচার অব্যাহত রয়েছে। এ মামলার বাইরে অন্য ঘটনায় জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও কর্মকর্তাদের কাউকেই বিচারের আওতায় আনা হয়নি।
নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার : পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের প্রচলন অনেক বেশি। নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত করার ঘটনা বিরল। মার্চে, জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্তৃপ প্রকাশ্যে নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি সুরাকবজ নিয়ে নালিশ জানিয়েছিল। পুলিশ কর্তৃপ যুদ্ধাবস্থায়, যুদ্ধের হুমকি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জরুরি অবস্থার সময় করা নির্যাতন ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য না করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। এ সময় জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা ও বেসামরিক প্রশাসনের নির্দেশে নির্যাতন হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম : জানুয়ারিতে সরকারের জারিকৃত নির্দেশনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে মানুষের সফর ও অনুষ্ঠান আয়োজনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ‘ইন্ডিজেনাস’ জনগণের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে সরকারের বাধ্যবাধকতা, বৈষম্য থেকে মুক্তি, স্বাধীনভাবে চলাচলের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আয়োজন ও সংগঠন করার স্বাধীনতার লঙ্ঘন ওই নির্দেশনা।
নারীর প্রতি সহিংসতা : বাংলাদেশ জাতীয় নারী আইনজীবী সমিতির মতে, জানুয়ারি ও মে মাসের মধ্যে ২৪০ টিরও বেশি ধর্ষণের অভিযোগ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, জ্ঞাত ধর্ষণের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে, তবে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা খুবই কম। সময়োপযোগী ও কার্যকরী তদন্তের অভাবের কারণেই এমনটি ঘটছে। অনেক নারী ও মেয়ে কর্তৃপরে কাছে ধর্ষণের ঘটনা জানাতে অনাগ্রহী। ধর্ষণের শিকার নারী ও মেয়েদের প্রমাণ করতে হয়, তাদের ওপর জোর প্রয়োগ করা হয়েছে। এমনকি শারীরিক পরীা-নিরীার মধ্য দিয়েও তাদের যেতে হয়।
মৃত্যুদণ্ড : সামিউল আলম রাজন হত্যাকাে অভিযুক্ত ছয়জনসহ বিভিন্ন মামলায় অন্তত ১৯৮ জনকে ফাঁসির সাজা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে ঐশী রহমান, যিনি ২০১৩ সালে নিজের বাবা-মাকে হত্যার দায়ে ফাঁসির সাজা পান। তার আইনজীবীদের যুক্তি, কথিত খুনের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছরেরও কম। তাই তার ফাঁসির সাজা হতে পারে না। তবে স্বাস্থ্য পরীায় ঐশীর বয়স ১৮ ছিল বলে উপসংহার টানা হয়েছে। আদালত ওই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ঘটনা তদন্তে প্রতিষ্ঠিত দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল (আইসিটি) আরো চার ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দিয়েছে। এ ট্রাইব্যুনালের কার্যপ্রণালীতে গুরুতর অনিয়ম ও ন্যায়বিচারের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে একটি সাংবিধানিক অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এ আদালতের বিচারিক এখতিয়ারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গতকাল তাদের এই বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ২০১৫ সালে বিশ্বের ১৬০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার খর্ব হওয়ার এক ধরনের গতিধারা পরিলতি হয়েছে। সংস্থাটির মহাসচিব সলিল শেঠি বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনার অধিকার হুমকির মুখে।’ তিনি আরো বলেন, ‘শুধু আমাদের অধিকারই নয় আমাদের রা করার আইনকানুন ও ব্যবস্থাও হুমকির মুখে।’ www.dailynayadiganta.com