শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানীকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। আহলে ইলমের কাছে তা বাহুল্য ছাড়া আর কিছু নয়। খ্যাতিমান এ আলেমেদ্বীন অর্ধশতাব্দীরও বেশি কাল ধরে দ্বীনী ইলমের বিভিন্ন শাখায় বহুমাত্রিক অবদান রেখে চলেছেন। হাদীস শাস্ত্রে মুসলিম শরীফের ভাষ্যগ্রন্থ ‘তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম’ তাঁর অমর কীর্তি।
ও.আই.সি’র অঙ্গসংস্থা ‘মাজমাউল ফিক্বহিল ইসলামী’র তিনি স্থায়ী সদস্য ও ভাইস চেয়ারম্যান। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরীয়া এপিলেট বেঞ্চের বিচারপতি হিসেবে ২০০২ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি দারুল উলূম করাচীর নাইবে মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি করাচী থেকে প্রকাশিত ইংরেজী ম্যাগাজিন দি ইন্টেল্যাক্ট (The Intellect)-এ শাইখুল ইসলাম মুফতি মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানীর সহধর্মিণীর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে তা ‘উর্দু ডাইজেস্ট’ এপ্রিল ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারটির ভাষান্তর করেছেন ইবরাহীম আহমদ চৌধুরী। কমাশিসার পাঠকদের জন্য তার অনুবাদ পেশ করা হল।
মুফতী সাহেব তাঁর গোটা জীবন ইসলামের খেদমতে নিবেদিত থেকে কাটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ব্যাপক সফলতার পেছনে এটাও একটা কারণ যে তিনি ঘরে আপনার পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন। আপনি বলবেন কি কীভাবে আপনি তাঁর পাশে ছিলেন?
বিয়ের প্রথম দিনই আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম ঘরের কাজকর্ম এমনভাবে সামলাব যাতে আমার স্বামী তাঁর সবটুকু সময় দ্বীনের তরক্কী ও ইশা‘আতের (প্রচার-প্রসারের) কাজে ব্যয় করতে পারেন। এ কাজ আমি সওয়াবের উদ্দেশ্যেই করেছি। আমাদের বিয়ের আজ কত বছর হয়ে গেল, এখনও ঘরের ছোট বড় সব কাজ আমিই দেখাশোনা করি। সদাইপাতি আনা কিংবা কাপড়চোপড় কেনাকাটা ইত্যাদি গৃহস্থালি কাজে আমি তাঁকে বিরক্ত করি না। টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আমিই মেরামত করিয়ে নিই। উদ্দেশ্য একটাই মুফতী ছাহেব যেন দ্বীনের ইশা‘আতের কাজে পূর্ণ মনযোগ দিতে পারেন। এই সুযোগে বলে রাখি আল্লাহ তা‘আলা আমাকে একজন উত্তম ও আদর্শ জীবনসঙ্গী দান করেছেন। যিনি পরিবারকে একটি উত্তম দ্বীনী ও দুনিয়াবী পরিবেশ দান করেছেন। এজন্য আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ।
শাইখুল ইসলাম প্রায় বিদেশ সফরে থাকেন। কখনো কি তাঁর সঙ্গে যাবার সুযোগ হয়েছিল? যদি বিদেশ সফরে গিয়ে থাকেন তাহলে আপনি তাঁর সঙ্গে কীভাবে সময় কাটান?
অনেকবার আমি তাঁর সঙ্গে বিদেশ সফরে গিয়েছি। সাধারণত প্লেনে ওঠামাত্র মুফতী ছাহেব তাঁর ল্যাপটপে কাজ শুরু করে দেন এবং অবতরণ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যান। এই ফাঁকে আমি কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকি। হোটেলে পৌঁছে মুফতী ছাহেব তাঁর নির্ধারিত প্রোগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন আমি কুরআন তিলাওয়াত করি নতুবা কোনো দ্বীনী কিতাব অধ্যয়ন করি। আসলে দ্বীনী কিতাব অধ্যয়ন আমার প্রিয় একটি কাজ। ঘরে যেহেতু খুব একটা সময় হয়ে ওঠে না তাই বিদেশ সফরের সময়টুকুতে খুব কিতাব মুতালাআ করি। আজকাল আরবী ভাষাও শিখছি, যাতে আরবী কিতাবও মুতালাআ করতে পারি। কেনাকাটা কিংবা বেড়ানোর প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। অনেক মহিলাই আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দেন। কিন্তু হোটেলে অবস্থান করাই আমার পছন্দ। অবশ্য আমরা করাচীতে থাকি কিংবা লন্ডনে; ফজরের নামাযের পর আধঘণ্টা অবশ্যই প্রাতঃভ্রমণ করি। বিকেলে মেশিনে আধঘণ্টা হাঁটি। এ সময় কুরআন পাকের পূর্ণ একপারা তিলাওয়াত করে ফেলি। বিদেশে মুফতী ছাহেবের ব্যস্ততা শেষ হওয়ার পর সাধারণত অতিরিক্ত একদিন অবস্থান করেন। তখন আমাকে শহরের দর্শনীয় ও বিখ্যাত জায়গাগুলোয় বেড়াতে নিয়ে যান।
সন্তান বড় হয়ে যাওয়ার পর মায়েদের দম ফেলার ফুরসত মিলে। এখন আপনার দৈনন্দিন সময় কীভাবে কাটে?
প্রতি বৃহস্পতিবার আমি হেরা ফাউন্ডেশন স্কুলে বয়ান করি। (হেরা ফাউন্ডেশন স্কুলটি ক্যামব্রিজ এডুকেশন সিস্টেম অনুযায়ী শিক্ষাদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান, যা দারুল উলূম করাচীর ক্যাম্পাসেই অবস্থিত)। বয়ানে সাধারণত মুফতী ছাহেবের কিতাব, ইসলাহী খুতুবাত থেকে অংশবিশেষ পড়ে শুনাই। হযরত মুফতী ছাহেবের পূর্ণ সুবিধার প্রতি লক্ষ রেখে তাঁর কাজের সময়ের সঙ্গে সমন্বয় করে আমার দিনের কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকি।
দিনের কার্যতালিকা এরূপ :
ফজরের নামাযের পর আমরা প্রাতঃভ্রমণে বের হই। সকাল সাড়ে সাতটায় নাশতা করা হয়। সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত মুফতী ছাহেব সহীহ বুখারীর দারস দেন। সে সময় আমি ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মুফতী ছাহেব ১০টায় ঘরে আসেন এবং বারোটা পর্যন্ত ল্যাপটপে কিতাব, প্রবন্ধ রচনা ইত্যাদির কাজে ব্যস্ত থাকেন। ১২ থেকে ২টা পর্যন্ত দফতরে বসেন। যোহরের নামাযের পর প্রায় সোয়া দুইটার সময় আমরা একসঙ্গে খাবার খাই। তারপর সাড়ে তিনটা পর্যন্ত বিশ্রাম নেন। তারপর মুফতী ছাহেব আবার দফতরে যান। সেখানে আসাতিযা, তালিবে ইলম এবং মেহমানগণ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
আসরের নামাযের পর তিনি ঘরে সময় দেন। মাগরিব পর্যন্ত সময় একান্তই পরিবারের জন্য। এ সময়টিতে সবাই একত্রে বসার প্রতি মুফতী ছাহেব খুব গুরুত্বারোপ করেন। তখন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। মাগরিবের নামাযের পর মুফতী ছাহেব সাধারণত গবেষণা ও রচনার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ কাজ এশা পর্যন্ত চলতে থাকে। এ সময় তাঁকে মোটেই পেরেশান করা হয় না।
এশার নামাজের পর পরিবারের সবাই একত্রে খেতে বসেন। খাবার শেষে তিনি দশ পনের মিনিট কোনো কিতাব থেকে ইসলামী ঘটনা পড়ে শুনান। এ মজলিশে নাতিপুতি সবার উপস্থিতি জরুরি গণ্য করা হয়। এরপর রাত বারটা অবধি তিনি রচনা ও গবেষণার কাজ চালিয়ে যান।
বর্তমানে আমাদের সমাজ পাশ্চাত্য কৃষ্টি-কালচারের আগ্রাসনের শিকার। এমতাবস্থায় নারীসমাজের ইসলাহের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
সর্বপ্রথম মহিলাদের জন্য বেশি বেশি দ্বীনী মাহফিলের ব্যবস্থা করা, যেখানে তাদের সামনে সবধরনের ধর্মীয় আলোচনা উপস্থাপন করা হবে। বিশেষ করে সালাফে সালেহীনের জীবনধারা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। এতে ইসলামী মূল্যবোধ ও রীতিনীতি অনুযায়ী তারা নিজেদের জীবন গড়তে অনুপ্রাণিত হবেন। আমি মনে করি ইসলাহী কাজ নম্রতা ও ভালবাসার সঙ্গে করা উচিত। লাঠি দিয়ে তাড়া করে নয়। এতে মানুষ আরো বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। অথচ নম্রতার সঙ্গে বুঝালে তা সবসময় কার্যকরি হয়। সুতরাং যে সব মহিলা দ্বীনের জ্ঞান রাখেন তাদের উচিত নিজেদের বন্ধুমহলে অথবা মহল্লায় নিয়মিত দ্বীনী মাহফিলের আয়োজন করা, যেখানে মহিলাদের দ্বীনের কথা শোনানো হবে। মা সন্তানের লালন পালন করে থাকেন, তাই তাকে অবশ্যই বিশেষভাবে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। এভাবেই তিনি সন্তানদের ইসলামী তরীকায় লালন পালন করতে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার অনিষ্ট থেকে বাঁচাতে পারেন।
আজকাল সমাজে তালাকের প্রবণতা বেড়ে গেছে। আপনার দৃষ্টিতে সুন্দর ও সার্থক বৈবাহিক জীবনের রহস্য কী?
সফল ও সার্থক দাম্পত্যজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব হচ্ছে স্বামীর পছন্দ-অপছন্দ স্ত্রীর বুঝতে পারা। এভাবে দাম্পত্য বন্ধন দৃঢ় হয়। পরস্পর আস্থা গড়ে ওঠে। আজকাল দেখা যায় স্ত্রী বাইরে বেরোয় মেকআপ করে, নতুন কাপড়চোপড় পরে। অথচ ঘরে অগোছালো হয়ে থাকে, আটপৌরে কাপড় পরিধান করে, সাজগোজের প্রতি মনযোগ দেয় না। অথচ স্ত্রীদের চলন এর বিপরীত হওয়ার কথা ছিল। ঘর থেকে যখন বের হবে তো হিজাব পরবে, সাদামাটা কাপড় পরবে। আর যখন ঘরে থাকবে স্বামীর জন্য সাজগোজ করবে। এভাবেই সুস্থ ও মনোরম পরিবেশের জন্ম হয়।
শাইখুল ইসলামের কোন অভ্যাস আপনার পছন্দ?
(মৃদু হেসে) মাশাআল্লাহ তাঁর সব অভ্যাসই আমার পছন্দ। আমার আত্মীয়-স্বজন সবাই রসিকতা করে বলে, আমরা এমন কোনো স্ত্রী দেখিনি, যে তার স্বামীর কথা তোমার মতো এত মনযোগ দিয়ে শুনে। এটা আল্লাহ তাআলার দয়া আর অনুগ্রহ যে তিনি আমাদের সর্বোত্তম জুটি বানিয়েছেন। এর কারণ সম্ভবত এই, আমরা একে অপরের কল্যাণ চাই এবং সওয়াবের জন্য কাজ করি।
খাবার দাবারে শাইখুল ইসলামের রুচি কী?
খাসির গোশতের সাদামাটা সালুন আর মাষকলাইয়ের ডাল আগ্রহভরে খান।
আমাদের সমাজে অনেক অনৈসলামী প্রথার ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে। দুর্নীতিরও জয়জয়কার। সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অসুস্থ প্রতিযোগিতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন পরিবেশে একজন মুসলমান নিজেকে এবং পরিবারের সদস্যদের কীভাবে নিরাপদ রাখবে?
কোনো পরিবার যদি ধর্মীয় জ্ঞান রাখে, ভালো-মন্দের মাঝে তফাৎ করতে জানে, তাহলে অতি সহজেই বর্তমান যামানার সব ধরনের অপকর্ম থেকে বাঁচতে পারবে। নৈতিক অধঃপতন সব যুগেই ছিল। তা থেকে বেঁচে থেকে তাক্বওয়ার উপর চলাই একজন মুসলমানের আসল কাজ। একটা কথা উল্লেখ করা দরকার; পরিবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মায়ের। মা চাইলে পুরো ঘরের পরিবেশ ইসলামী কিংবা অনৈসলামী ধাঁচে গড়ে তুলতে পারেন।
একবার ইংল্যান্ডের সফরে এক মুসলিম পরিবারে থাকার সুযোগ হয়েছিল। দেখলাম সে ঘরের বাচ্চাদের পাকিস্তানী বাচ্চাদের চেয়েও বেশি মাসনুন দুআ মুখস্থ। ঘরের মহিলা ও মেয়েরা পর্দা মেনে চলেন। পুরুষরা ইসলামী ফরজসমূহের প্রতি যতœবান। আমি তা দেখে বিস্মিত হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা ইংল্যান্ডের মতো অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে বসবাস করছেন, তা সত্ত্বেও আপনাদের জীবনযাপন শতভাগ ইসলামী। এটা কীভাবে সম্ভব হল?
তাঁরা বললেন, আমাদের ঘরের পরিবেশ সর্বদা ধর্মীয় ছিল। আসলে ঘরের ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুরা বাইরের নেতিবাচক প্রভাব থেকে সহজে বাঁচতে পারে। সুতরাং পিতামাতা যদি ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হন, তবে তাদের ছেলেমেয়েরাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। অতীতের মত এখনও ইসলামের উপর চলা অত্যন্ত সহজ। প্রয়োজন শুধু মুসলমানদের উদ্যম আর আত্মনির্ভরশীলতা ।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমাদের সময় দিয়েছেন এবং আপনার মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করে আমাদের উপকৃত করেছেন।
‘উর্দু ডাইজেস্ট’ এপ্রিল ২০১৫ থেকে।