অনেক তরুণ-তরুণীরা হয়ত বিয়ে করতে চায় কারণ তাদের বন্ধুবান্ধবরা বিয়ে করে ফেলছে, কারও আবার বাবা-মা চাপ সৃষ্টি করছে বিয়ে করার জন্য, কেউ ঘরের পারিবারিক জীবনের সমস্যা থেকে মুক্তির জন্যও বিয়ে করতে চায়। কেউ কেউ অন্যের শারীরিক সৌন্দর্য দেখে বা অর্থ-সম্পদের কারণে বিয়ে করতে আগ্রহী হয়। কেউ কেউ খুঁজে একজন সঙ্গী, কেউ পারিবারিকভাবে শক্ত একটা অবলম্বন পেতেও বিয়ে করতে চায় যেটা একটা বিয়ের মাধ্যমে সম্ভব। আবার মুসলিম হিসেবে রাসূলের সুন্নাহ পালনের মাধ্যমে ইবাদাত হিসেবেও বিয়ে করতে চান।
আরেকটা মানুষের সাথে আজীবন থাকার অভিপ্রায়ে যখন যাত্রা শুরু হয় দু’জন ছেলে এবং মেয়ের, তখন তাদের অনেক রকমের প্রস্তুতির দরকার পড়ে। দু’টো পরিবারকে তারা জুড়িয়ে দেয়, এখানে আরেকটা পরিবারের সাথে *নিজেদেরকে* মানিয়ে নেয়ার ব্যাপার থাকে। অনেক ধরণের চারিত্রিক গুণ প্রয়োজন, যেগুলো ছাড়া দিব্যি সমস্যাবিহীন *সিঙ্গেল* লাইফ কাটানো গেলেও বিবাহিত তা অবধারিত প্রয়োজন। তাই এগুলোর অবর্তমানে যদি সম্পর্কে চাপ বা টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়, অন্য কাউকে দায় দেয়ার নেই, ভোগান্তি তো হবেই।
বর্তমান সময়ে টেলিভিশন মিডিয়া, কমার্শিয়ালের মাঝে ডুবে থেকে অনেক ছেলেমেয়েরাই বিয়েকে মডার্ন ডেটিং টাইপের কিছু ভেবে বসেন। কেবল অবিমিশ্র সুখ, উদ্দাম আনন্দ। অথচ, বিয়ের পর দেখা যায় টুথব্রাশ এখানে কেন, টাওয়েল ওখানে কেন টাইপের ছোট ছোট জিনিসেও অমিল পাওয়া যায় একজন আরেকজনের। বিয়ের প্রথম দিকে ভালোবাসা উপচে পড়ার কারণে এইসব অগ্রাহ্য করলেও কিছুদিন পর আরেকজনের এইসব ছোটখাটো অমিলগুলোও অসহ্যবোধ হতে থাকে।
পারিবারিক এই সম্পর্কের ব্যাপারে কুরআনে ব্যবহৃত শব্দ হলো — ‘আল মুহসানাত’, ‘আল মুহসিনিন’ যা ‘ইহসান’ শব্দটি থেকে এসেছে। [১] এই শব্দটির একটি অর্থ যেমনটা বুঝায় তা হলো — কোন একটি দুর্গ চারিদিকে সেনা দিয়ে শক্তিশালীভাবে সুরক্ষিত। সেইসূত্রে, একজন স্ত্রীকে দুর্গের ন্যায় কঠিন সুরক্ষা দেয় তার স্বামী — সুরক্ষা দেয় যাবতীয় দুঃখ থেকে, অস্থিরতা-শঙ্কা থেকে, অজ্ঞতা থেকে, লজ্জাহীনতা থেকে। একজন স্ত্রীরও একই রকম দায়িত্ব রয়েছে। তারা একে অপরের পোশাকের মতন। [২] বিয়ে তাই কেবল আনন্দ আর উচ্ছ্বাস নয়, দায়িত্ববোধের ব্যাপারও বটে।
ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সার্চ যেসব দেশ থেকে হয়, তার মধ্যে প্রথমদিকে বেশ কিছু মুসলিম দেশের নাম আছে। [৩] পারিবারিক অশান্তি এবং সংসার জীবনে তৃপ্তি না থাকাই এই কারণ বলে মনে করেন বোদ্ধারা। সংসার জীবনের শুরুতে আবেগ-উচ্ছ্বাস বেশি থাকে, দেখা যায় প্রথম ছ’মাস ছেলে-মেয়ে কেউই তাদের বন্ধুমহলে কোন সময়ই দেন না। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে তা হ্রাস পেতে থাকে। সবাই তার অধিকারের ব্যাপারে খেয়ালী হতে থাকেন, নিজের কর্তব্যের ব্যাপার ভুলে যেতে থাকেন। হ্যাঁ স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই দু’জনের প্রতি অধিকার রয়েছে, কর্তব্যও রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবারই উচিত নিজের কর্তব্যটা করে যাওয়া এবং অপরজনের কাছে আশা-আকাংখা না করা।
কথাটা অদ্ভুত ঠেকলো?
একজন মু’মিন কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার উপরেই ভরসা করে। তার সমস্ত চাওয়া, সমস্ত আকাঙ্ক্ষার কথা কেবল আল্লাহর কাছেই হয়। মাটির তৈরি দুর্বল মানুষের উপরে যখন অনেক আশা-আকাংখার ভার ন্যস্ত হয় — তখন নিঃসন্দেহে সেই মানুষ এতটা ভার নেয়ার যোগ্য থাকে না।
আর তাই, মানুষ হিসেবে আমাদের আশাভঙ্গ হয়ে কষ্ট পেয়ে এলোমেলো হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বিয়ে করার আগে বিয়ে করার উদ্দেশ্য ঠিক রাখা প্রয়োজন। কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিই যেন মুখ্য থাকে, তাঁকে সন্তুষ্ট করার আশায়, চরিত্রকে ঠিক রাখতে, নির্লজ্জতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবনধারণ করছেন/করতে চান — এমন একজনকে মুসলিম/মুসলিমাহদের সঙ্গী করতে চাওয়া উচিত।
প্রকৃতপক্ষে পারিবারিক জীবন নিয়ে মানসিক কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। দেখলাম, ভালো লাগলো, প্রেম করো, ধুম করে বিয়ে করো — এই সবই ভুল চিন্তা ও কাজ যা অস্বাস্থ্যকর দাম্পত্য জীবনের সূচনা করে। একজন পশ্চিমা সাইকোলজিস্ট আর ম্যারিজ কাউন্সিলরের একটা লেখা পড়লাম যাতে তিনি জোর দিয়েছেন বিয়ের আগে থেকে বিবাহ পরবর্তী দ্বায়িত্বগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার ব্যাপারে। পারিবারিক আর ব্যক্তিগত পরস্পরের দ্বায়িত্ব গ্রহণ ও পালন এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্রশ্ন হলো, আপনি কীভাবে জানেন যে আপনি আসলেই বিয়ে করতে প্রস্তুত? আর আরো সূক্ষ্মভাবে বললে, আপনি যে আপনার পছন্দ করা একজন নির্দিষ্ট মানুষকেই বিয়ে করতে প্রস্তুত তা কী করে নিশ্চিত হলেন? আপনি বিয়ের জন্য প্রস্তুত কিনা, এটা জানার জন্য আপনার নিজেকে জানা জরুরি। এই কারণে কিছু ব্যক্তিগত হিসাব করতে বসতে হবে নিজের ভালো দিকগুলো জানতে আর নিজের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে। আপনার জানা দরকার আপনার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক কেমন, আর আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীর সাথে আল্লাহর সম্পর্ক আপনি কেমন আশা করেন?
আপনার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য তাগিদ এবং প্রয়োজনীয়তা আপনি এই চিন্তাভাবনার মাধ্যমে বের করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ। এছাড়া বেশিরভাগ মানুষকেই দেখা যায় তারা কী- এটা বুঝার আগেই তারা বিয়ে করে ফেলে, ফলে নানাবিধ জটিলতা হয়, অস্বস্তিকর পারিবারিক সম্পর্কের পেছনে এর ভূমিকা থাকে।
সম্ভাব্য পছন্দ? যখন কেউ সম্ভাব্য জীবনসঙ্গী নির্বাচনের কাছাকাছি চলে আসেন, তখন থেকেই ইস্তিখারা নামায আদায় করা প্রয়োজন, পরিবারের এবং বন্ধুদের মাঝে যারা জ্ঞানী এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন মানুষ- তাদের সাথে আলাপ করা দরকার। আলাপ ও উপদেশের জন্য যিনি ধর্মীয় জ্ঞানে এবং আচরণে উন্নত- এমন মানুষের পরামর্শই নেয়া দরকার। ইসলামে আল্লাহর স্মরণকারীদের মাঝে পরামর্শ খুবই কল্যাণময় এবং প্রয়োজনীয়।
বিয়ে হলো দ্বীনের অর্ধেক। এটি জীবনে নেয়া সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর একটা। তাই সম্ভাব্য জীবনসঙ্গীর ব্যাপারে, তার আচার-আচরণ সম্পর্কে, দ্বীনের ব্যাপারে তার অবস্থান, তার চরিত্র সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব খোঁজ নেয়া ভালো। আর তার স্বভাব, ব্যবহারের সাথে অপরজনের মিলবে কিনা, এটা নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে।
জীবনসঙ্গী পছন্দ করার আগে একটা কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
“চারটি বিষয়কে সামনে রেখে মেয়েদেরকে বিয়ে করা যেতে পারেঃ তার ধন সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার রূপ-সৌন্দর্য ও তার ধর্মপরায়নতা। এক্ষেত্রে ধর্মপরায়ন স্ত্রী লাভে বিজয়ী হও, তোমার হাত কল্যাণে ভরে যাবে।” [বুখারী ও মুসলিম] – [৫]
উস্তাদ নুমান আলী খানের একটা অসাধারণ আলোচনা আছে বিয়ের উপরে। বিবাহিত অবিবাহিত সবারই উপকার হবার কথা এই আলোচনা থেকে।
সমগ্র পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিবার। পরিবারে অশান্তি থাকলে মুসলিম সমাজে অরাজকতা তৈরি হবে। পরিবারে শান্তি না থাকলে তা চরিত্র স্খলনের সম্ভাবনা তৈরি করে দেয়। পরিবারে প্রশান্তি না থাকলে সদস্যরা তাদের দ্বীনের দায়িত্বসমূহ পালনে উদাসীন এবং অমনোযোগী হয়ে পড়তে পারেন। আর তাই, এই সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মুসলিম তরুণদের উচিত প্রেম করতে ঝাঁপিয়ে না পড়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণার্থে চরিত্রকে রক্ষার জন্য চোখকে, মনকে সংযত করা। একজন সফল মু’মিন হতে হলে নিজেকে সংযত রাখা জরুরী। [৪] পাশাপাশি দরকার আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দুআ করা। একটা সুন্দর দু’আ হলো- “রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াযিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্কুররাতা আ’ইয়ুনিন ওয়া জা’আলনা লিল মুত্তাক্কিনা ইমামা”।
অর্থ- “হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।” [সূরা ফুরক্কানঃ ৭৪]
আল্লাহ আমাদের মুসলিম ভাই এবং বোনদের সহায় হোন, তাদের রহম করুন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের যোগ্য করে দিন। সুন্দর সুন্দর পরিবার গঠনের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর কলুষতা থেকে মুক্ত থাকুক, নতুন প্রজন্মকে সত্যিকার দ্বীন উপহার দেয়ার যোগ্য হোক নতুন পরিবার গড়া মুসলিম মুসলিমাহরা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রহম করুন।